প্রফেসর মোসলেম আলী ছিলেন একজন সংস্কৃতিবান শিক্ষক
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৯:৫১ অপরাহ্ন, ১৬ই এপ্রিল ২০২৩
আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই, শারীরিকভাবে না থাকলেও তার অসামান্য কীর্তির মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের নয়নের মাঝখানে যেন ঠাঁই করে নিয়েছেন, বেঁচে আছেন, থাকবেন যতদিন আমরা বেঁচে থাকব। অমন অনুভব থেকে তার সদ্যবিদায়কালে অশ্রু সজলনেত্রে ও ব্যথাহত চিত্তে আমাদের মুখে তার বিদায়ের বারতা উচ্চারিত হয়। আর তা হয়তো ওই জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্বের আলোতে উদ্ভাসিত প্রাণময় ও মননশীল মনের উপলব্ধির বিষয়। আরও মনে হয় তার অমর কীর্তির চেয়ে তিনি যেন মহৎ হয়ে উঠেছিলেন। আর তাই হয়তো বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের কোনো একটি সফলতার মাঝে নিজেকে রুদ্ধ করেননি বা থেমে যাননি বরং তাকে পেছনে ফেলে সম্মুখপানে এগিয়ে গেছেন, নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছেন। সুদীর্ঘ জীবনকে সদাকর্মব্যস্ত করে উপভোগ করতে সক্ষম হয়েছেন। আজ তিনি না থাকলেও তার কর্মময় জীবনের চিহ্ন রয়ে গেছে সেকালের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্মৃতির মণিকোঠায়। প্রয়াত প্রফেসর মোসলেম আলী মহোদয় নাটোর জেলার সিংড়া থানার জোরমল্লিকা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৬ এপ্রিল ২০২১ তারিখে রাজশাহীর সিডিএম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ১৯৬৩ থেকে শুরু করে ১৯৭২ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত রাজশাহী কলেজে রসায়নশাস্ত্রের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মাঝে ১৯৬৭ সালে কয়েক মাস সিলেট এমসি কলেজে কর্মরত ছিলেন। রাজশাহী কলেজের ওই সুদীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি অনন্যসাধারণ প্রতিভা, প্রজ্ঞা ও সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন এবং বহু শাস্ত্র বিষয়ে নিজেকে কিছুটা অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ ও পারদর্শী করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।
দরিদ্র, বঞ্চিত ও সম্ভাবনাময় তরুণদের প্রতি তার ছিল সহজাত দুর্বলতা। এমন অনেক ছাত্রছাত্রীর সহযোগিতায় তার হস্ত প্রসারিত হয়েছিল। অধ্যবসায়, সততা ও নিষ্ঠার বলে গড়ে তোলা ব্যক্তি ও পেশাগত জীবনে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য গুণগ্রাহী যারা দেশে-বিদেশে কর্মে নিয়োজিত আছেন। স্যারের মুখে শুনেছিলাম, সাবেক জনপ্রিয় কেবিনেট সচিব আলী ইমাম মজুমদার তার অধীনে ডেপুটি সেক্রেটারি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯১ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব পদে পদায়ন পেয়ে এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বিদায়কালে এক বেদনাবিধুর ঐতিহাসিক মুহূর্ত রচিত হয়, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সেদিন বেদনা অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি।
সেদিন ফুলে ফুলে অশ্রুজলে যেন কলেজ প্রাঙ্গণ কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। বিদায় নিয়ে তিনি রাজশাহী গমনকালে দুই গাড়ি ফুল পাঠাল দল-মত নির্বিশেষে সেকালের এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীরা। এর পর ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সময়ে যুগ্মসচিব ও মহাপরিচালক জাতীয় জাদুঘরের দায়িত্ব পালন শেষে তিনি এলপিআরে গমন করেন। ওই সময়ে তিনি দেশে ও দেশের বাইরে অনেক কর্মসূচিতে নেতৃত্বদান করেন। সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে তিনি ইরান, ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ডসহ অনেক দেশ ভ্রমণ করেন। অবসরজীবনে প্রথমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন এবং পরে ১৯৯৬-১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সময়ে সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন তিনটি বিভাগের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে সৃষ্ট প্রকল্পের (উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি) প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এর পর তিনি ২০০০ থেকে ২০০৩ সময়ে সায়েদাবাদে আরকে চৌধুরী ডিগ্রি কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ওই দায়িত্ব পালন শেষে ২০০৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে তিনি বাংলাদেশ এগ্রোপ্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (ইঅচঅ)-এর উপদেষ্টা হিসেবে প্রায় দেড় যুগ বাংলাদেশের কৃষি ও শিল্পভিত্তিক রপ্তানিতে অবদান রেখেছেন। ওই দায়িত্ব পালনকালে দেশে কৃষিভিত্তিক শিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাহায্যে সৃষ্ট একটি প্রজেক্ট পরিচালনার সুযোগ লাভ করেন। ইংরেজি ভাষায় তার জ্ঞানের গভীরতার সুবাদে ইঅচঅ-এর কর্মক্ষেত্রের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাহায্যপুষ্ট ওই প্রজেক্ট পাওয়া সহজ হয়েছিল বলে তার মুখ থেকে জানা যায়। সে কারণে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের দ্বারা বিশেষভাবে সম্মানিত ও মূল্যায়িত হয়েছিলেন এবং ওই প্রকল্প থেকে তাকে সম্মানজনক আর্থিক সম্মানীও প্রদান করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইঅচঅ-এর উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুবাদে ওই সংগঠনের কর্ণধার ও নির্বাচিত সভাপতি মেজর জেনারেল (অব) আমজাদ খান চৌধুরী (প্রাণ), অঞ্জন চৌধুরী (স্কয়ার), ফখরুল ইসলাম মুন্সীর সঙ্গে তিনি কাজ করার সুযোগ লাভ করেন।
এমন বর্ণাঢ্য ও বহুমাত্রিক কর্মজীবনের অধিকারী ছিলেন প্রয়াত প্রফেসর মোসলেম আলী। তিনি তিন কন্যা, দুই পুত্র, নাতি-নাতনি, আত্মীয়-স্বজনসহ অসংখ্য স্নেহধন্য ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। প্রার্থনা করি তিনি পরপারে জান্নাতবাসী হোন। পরিশেষে তার উদ্দেশে কবিগুরুর কবিতার দুটি চরণ, এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ মরণেও তাই তুমি করে গেলে দান।
লেখক: ড. মো. মোস্তাফিজার রহমান, সাবেক অধ্যক্ষ, নওগাঁ সরকারি কলেজ