তৃতীয় লিঙ্গ: ‘বিধাতার সৃষ্ট নান্দনিক বৈচিত্র’


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৪:১০ অপরাহ্ন, ২৯শে মে ২০২৩


তৃতীয় লিঙ্গ: ‘বিধাতার সৃষ্ট নান্দনিক বৈচিত্র’
সাইফুল ইসলাম চৌধুরী

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা হলো সমাজের নিপীড়িত-অবহেলিত-বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। ইংরেজি Third Gender, Transgender, Queer,  বা Harmaphrodite যার অনুবাদ হিসাবে হিজড়া-উভয়লিঙ্গ-নপুংসক-বৃহন্নলা-তৃতীয় লিঙ্গ শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে হিজড়া শব্দটি বহুল ব্যবহৃত। ফার্সিতে হিজড়া শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো “সম্মানিত ব্যক্তি”। ভারতবর্ষে হিজড়া শব্দের বহুল প্রচলন দেখা যায় মুঘল আমলে। মুঘলদের সময় তাঁরা খুবই বিশ্বস্ত কর্মচারি হিসাবে গণ্য হতো। পরবর্তীতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে “ক্রিমিনাল ট্রাইব” হিসাবে আখ্যা দিয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠীর চলাফেরা ফৌজদারী আইনের আওতায় নজরদারীতে আনা হয়। 


প্রায় সকল হিজড়া  মানসিকভাবে নিজেদের মেয়ে মনে করে। এ বিষয়ে গবেষক Serana Nanda বলেন: “ Female soul entrapped in a mail body”


পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অদৃশ্য ও প্রায় দূর্ভেদ্য দেয়ালের আড়ালে থেকে বেড়ে ওঠার ফলে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কাছে সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের পরিচয় অনেকটা অধরাই থেকে যায়। তাই অনেক ক্ষেত্রে সক্ষমতা থাকার পরও কেউ তাদের কাজে নিয়োগ দিতে চায়না। মূল্যবোধের ঘাটতিতো ক্ষুধা নিবারণ করতে পারেনা। তাই পেটের তাগিদে তাঁরা পথেঘাটে, বাজারে , যানবাহনে হাত পাতে, চাঁদা তোলে। 


২০১৯ সালে ওয়ার্ল্‌ড হেল্থ এ্যাসেম্বলি ইন্টারন্যাশনাল ক্ল্যাসিফিকেশন অব ডিজিজেস(আইসিডি-১১) এর একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘মানসিক ও আচরণগত ব্যাধিগুলো’ অধ্যায় থেকে ট্রান্সজেন্ডার সম্পর্কিত বিষয়গুলো বাতিল করে। এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ মানসিকভাবে যেমন সুস্থ, তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যও প্রাকৃতিকভাবে স্বাভাবিক। কিন্তু অজ্ঞতাজনিত সামাজিক কুসংস্কার এই অসহায় জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করেছে।


মানুষের শরীরের প্রতিটি কোষে রয়েছে ২৩ জোড়া করে ক্রোমজোম। এর মধ্যে ২২ জোড়া অটোজোম এবং অবশিষ্ট ০১ জোড়া হলো সেক্স ক্রোমজোম। মূলত এই ০১ জোড়া সেক্স ক্রোমজোমের ত্রুটির কারণে একটি শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয়। আর তখনই একটি শিশু ছেলে বা মেয়ে না হয়ে তৃতীয় লিঙ্গের শিশু হয়ে জন্মলাভ করে। পুরুষের বেলায় ক্রোমজোমের গঠন XY, মেয়ে শিশুর বেলায় ক্রোমজোম XX আর তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া শিশুর বেলায় তা XXY  অথবা XYY. একটি শিশুর ক্রোমজোম কিরূপ হবে তা সম্পূ্র্ণ প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। 


তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা সমাজের অংশ, রাষ্ট্রের নাগরিক। তাদেরও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে দিতে হবে। পরিবারের অন্য সদস্যদের মত করে বড় হবে, শিক্ষা লাভ করবে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে। তাঁদেরও রয়েছে সাংবিধানিক অধিকার। সংবিধানের ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদে নাগরিক হিসাবে তাঁদের অধিকার (সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার) সুরক্ষিত। শুধুমাত্র জনসচেতনতা এবং তাদের নিজেদের সচেতনতার অভাবে তাদের প্রাপ্য অধিকার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাঁদের প্রতি ঘৃণা নয়-স্নেহ, ভালোবাসা ও মমতা প্রয়োজন। প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণে তৃতীয় লিঙ্গের একটি অংশ মানবেতর জীবনযাপন করে থাকেন। তবে অপর একটি অংশ তাদের স্ত্রী সন্তান থকার পরও নিজেদের শারীরিক গঠন পরিবর্তন করে হিজড়া হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে থাকেন, চাঁদাবাজিসহ নানা অনৈতিক কাজে জড়িত হয়ে পড়েন। তবে ভিন্ন চিত্রও রয়েছে। করোনাকালিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হিজড়ারা দলবেঁধে করোনা রোগিদের সেবা করে প্রশংসা কুড়িয়েছে। সম্প্রতি ঢাকায় বঙ্গবাজারে আগুন লেগে সবকটি দোকান পুড়ে গেলে দোকানীদের সহায়তায় তাঁরা এগিয়ে আসেন যা তাঁদের মানবিক দিকটি সবার সামনে ফুটে ওঠে।


আরও পড়ুন: জুলিও কুরি পদক: বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু


বর্তমানে বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়া জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ভোটার তালিকার নিবন্ধন ফরমের  ক্রমিক নম্বর ১৭ সংশোধন করে লিঙ্গ নির্বাচনের ক্ষেত্রে পুরুষ ও মহিলার পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সমাজসেবা অধিদফতর কর্তৃক প্রণীত প্রতিবন্ধী সনাক্তকরণ জরিপ ফরমেও পুরুষ মহিলা ও হিজড়া অন্তর্ভুক্ত করা হয়। 


জনশুমারি ২০২২ অনুসারে সারাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১২৬২৯ জন (সময়ের আলো ডট কম)। বেসরকারি অনেক সংগঠন দাবী করেন এ সংখ্যা লক্ষাধিক হতে পারে। ফেনী জেলায় এ পর্যন্ত  ৯৭ জনের তথ্য পাওয়া গেছে।। তবে পরিবারে থাকা এ জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জরিপে তথ্য দিতে রাজি হন না মর্মে জানা যায়। সচেতনভাবে তথ্য দিলে এ সংখ্যা আরও কয়েকগুণ হতে পারে।


আরও পড়ুন: বাংলাদেশে গণমাধ্যমের বর্তমান হালচাল ও প্রাসঙ্গিক কথা


সরকার হিজড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের লক্ষ্যে নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। সমাজসেবা অধিদফতর ‘হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি’ নামে একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এর আওতায় ৫০ উর্দ্ধ জনগোষ্ঠীর জন্য রয়েছে মাসিক জনপ্রতি ৬০০/- টাকা করে বিশেষ ভাতা। ০৬-১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে স্তরভিত্তিক উপবৃত্তির ব্যবস্থা। প্রাথমিক স্তরে ৭০০/-, মাধ্যমিক স্তরে ৮০০/-, উচ্চ-মাধ্যমিক স্তরে ১০০০/- এবং উচ্চ স্তরে ১২০০/- টাকা।  বাংলাদেশের যে কোনো এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা তৃতীয় লিঙ্গের একজন ব্যক্তি ঐ এলাকা হতে এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। এক্ষেত্রে ১৮ উর্দ্ধ ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ১৮ বছরের নিচে বয়স হলে জন্মনিবন্ধন সনদ থাকতে হবে। সমাজসেবা অধিদফতরের এমআইএস (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) এ ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে অথবা সরাসরি আবেদনগ্রহণপূর্বক হিজড়া ব্যক্তির তথ্য যাচাই করে নীতিমালা অনুসরণপূর্বক প্রকৃত হিজড়া জনগোষ্ঠীর তালিকা প্রণয়ন করে বরাদ্দ অনুযায়ী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে G2P পদ্ধতিতে EFT  এর মাধ্যমে মোবাইল একাউন্ট/ এজেন্ট ব্যাংকিং একাউন্টে ভাতার অর্থ পরিশোধ করা হয়।  তাছাড়া ১৮-৫০ বছর বয়স সীমার মধ্যে থাকা হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য রয়েছে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা যার মাধ্যমে তাঁরা স্বাবলম্ভী হতে পারেন।


আরও পড়ুন: স্মৃতিধন্য ১১৭ নম্বর কেবিন এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম


হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সঠিকভাবে পরিচর্যা করা গেলে তারাও সমাজে মর্যাদার সাথে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কর্মকর্তা তানিশা ইয়াসমিন চৈতি – তিনি একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ- একজন ট্রান্সজেন্ডার। এছাড়া ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস এ কর্মরত হো চি মিন, ব্র্যাক ব্যাংকে কর্মরত অন্কিতা, এনজিও ব্লাস্টের জুনিয়র অ্যাডভোকেসি অফিসার শোভা সরকার, ঝিনাইদহের কালিগঞ্জের ত্রিলোচনপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ঋতু, ২০১৭ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ‘জয়ীতা’ পুরস্কার জয়ী আরিফা ইয়াসমিন ময়ূরী- তাঁরা সকলেই তৃতীয় লিঙ্গের সফল মানুষ।


সৃষ্টিগতভাবে কোনো মানুষই পরিপূর্ণ নয়। প্রত্যেক মানুষই কোনো না কোনোভাবে অসম্পূর্ণ। একজন  হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজে দায়ি নয়। এটি সৃষ্টিকর্তার অপরাপর সৃষ্টির মতই একটি নান্দনিক জিনগত বৈচিত্র মাত্র। সমাজের সকল মানুষের মধ্যে তাঁদের সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হলে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলোর সামগ্রিক উন্নয়নের পথ সুগম হবে। বর্তমানে চিকিৎসা শাস্ত্র যথেষ্ঠ আধুনিক ও উন্নত হয়েছে। জন্মের কিছুদিনের মধ্যে তৃতীয় লিঙ্গের শিশুকে সময়মত  চিকিৎসা দিতে পারলে তাদের পক্ষে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব বলে বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে।


লেখক: সাইফুল ইসলাম চৌধুরী, উপপরিচালক, সমাজসেবা অধিদফতর, ফেনী