পটুয়াখালীতে সর্পদংশনে চিকিৎসা থাকলেও সাপের কামড়ে কেন এতো মানুষের মৃত্যু?
উপজেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৩:৩৫ অপরাহ্ন, ১৯শে জুন ২০২৩
গরমকাল বা বর্ষাকালে গ্রামবাংলায় সাপের কামড়ের ঘটনা প্রায়শই ঘটে। আর সাপের কামড়ে মৃত্যুও হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় সতর্কতা ও সচেতনতা থাকলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রাণহানি এড়ানো যায়। এ জন্য সাপের কামড় সম্পর্কে সচেতনার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এমনই জানালেন এনিম্যাল লাভার্স অব পটুয়াখালীর সদস্যরা তারা জানান,সাপে কামড়ালে অবশ্যই নিকটবর্তী সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে,যদি আশেপাশে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থাকে সেক্ষেত্রে সেখানে নিয়ে গেলে ভালো হয়।
এক্ষেত্রে সবার জেনে রাখা উচিৎ সরকারি কোন হাসপাতালে সর্প দংশনের চিকিৎসা হয়,প্রত্যেক উপজেলায় এন্টিভেনম থাকার কথা থাকলেও রাখা সম্ভব হয়না কারণ প্রশিক্ষিত ডাক্তার এবং অনেক সময় রোগীর ক্ষেত্রে আইসিউ লাগতে পারে,তবে পটুয়াখালী জেলায় পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজসহ ৩ টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এন্টিভেনম সর্প দংশনের চিকিৎসা হয়,এটা পটুয়াখালীবাসীর জন্য আশীর্বাদ।
বাংলাদেশে জেলার হসপিটাল গুলোতে সর্পদংশনের চিকিৎসা কম থাকলেও পটুয়াখালী জেলায় ৩ হসপিটালে এর চিকিৎসা হয় এছাড়াও রয়েছে, পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিউ সুবিধাও। এত কিছু থাকা সত্ত্বেও অসচেতনতার কারণে পটুয়াখালী জেলা মানুষই সর্পদংশন বেশি মারা যাচ্ছেন, এর অন্যতম কারণ হলো ওঝা/কবিরাজে এবং কুসংস্কারে অগাধ বিশ্বাস।
এনিমেল ল্যাভার্সের এক সদস্য বলেন, গত কয়েক দিন আগে আমার বাবা কে সাপ দংশন করে বিকেলে,আমি যেহেতু দূরে থাকি আমার কানে আসতে আসতে এক ঘন্টা প্রায় দেরি হয়ে যায়।যখন জানতে পারি তখন বাড়ি ফোন দিয়ে শুনি বাবাকে নিয়ে ওঝার কাছে গেছেন এবং দুইটা ঝাড়াও দিয়েছেন,আমার বাড়ি থেকে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজে যেতে সময় লাগে বেশি হলে ৩০ মিনিট সেখানে তারা হাসপাতালে না গিয়ে ওঝার কাছে গেছেন। যাইহোক ভাগ্যক্রমে যে সাপে কামড় দিয়েছিলো সেটা ছিলো নির্বিষ সাপ ভাগ্যক্রমে আমার বাবা বেঁচে যান। আমার পরিবারে সবাই শিক্ষিত এবং আমি বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করি তাও আজ ৫ বছর কিন্তু তার ফলাফল হিসেবে এই পেলাম।
রাকায়েত আহসান, কলাপাড়া উপজেলা টিম লিডার,স্নেক রেস্কিউয়ার জানান, পটুয়াখালী জেলার মানুষ এখনও অসচেতন ,এই কয়েক বছর কাজের অভিজ্ঞতায় পটুয়াখালী জেলায় যে কজন সাপে কাটা রোগী মারা যেতে দেখেছি সবাই হাসপাতালে না গিয়ে ওঝার কাছে গেছেন। এবং পটুয়াখালী জেলার মত ওঝা/কবিরাজ আমি অন্য কোথাও দেখিনি,লাস্ট গত ২২ সালের আগস্ট মাসে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এন্টিভেনম ছিলো না কারণ এন্টিভেনম এর ডেট এক্সপায়ার হয়ে গেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা যায় সর্প দংশনের রোগী হাসপাতালেই আসে কম যারাও আসে শেষ মুহুর্তে যখন ডাক্তারের হাতে কিছু থাকেনা।
এই হলো আমাদের পটুয়াখালী জেলার অবস্থা,আমরা স্বেচ্ছাসেবী প্রাণিকল্যান সংগঠন মানুষ কে রক্ষা করতে স্নেক রেস্কিউয়ার তৈরী করেছি এবং প্রতিনিয়ত সাপ সহ সকল ধরনের বন্যপ্রাণী নিয়ে মানুষ কে সচেতন করে আসছি,কিন্তু তারপরো সর্প দংশনের খবর এমন সময় পাই যখন সময় শেষ কিছু করার মত আর সুযোগ থাকেনা।
এনিম্যাল লাভার্স অব পটুয়াখালী স্বেচ্ছাসেবী প্রাণিকল্যান সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা, এইচ এম শামিম জানান ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করে। পটুয়াখালী জেলা সহ বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলে কাজ করে,সংগঠনের ৫০+ সদস্য রয়েছেন যার ভিতরে বন অধিদপ্তর থেকে ২৫ জন সদস্য বন্যপ্রাণী হ্যান্ডলিং,বন্যপ্রাণী আইন ও ফরেনসিক ব্যবস্থাপনা,বন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত।
পটুয়াখালী জেলার প্রত্যেক উপজেলায় আমাদের সদস্য রয়েছে,যারা বেওয়ারিশ কুকুর,বিড়াল সাপ সহ সকল ধরনের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ও জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে,বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট ও বন বিভাগ এই বিষয় আমাদের প্রশাসনিক সহযোগিতা করে থাকেন,কিন্তু কাজ সংগঠনের নিজস্ব অর্থায়নে করি।
এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে অনুরোধ পটুয়াখালী জেলার সচেতন নাগরিকদের কাছে অনুরোধ থাকবে দয়া করে। আপনার পরিবার,আত্মীয় স্বজন,বন্ধু বান্ধব যেখানেই সুযোগ পান এই বিষয় সচেতন করুন এবং সর্প দংশনের রোগী হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।।
বাংলাদেশের ২৯ প্রজাতি বিষধর সাপ পাওয়ার রেকর্ড রয়েছে যার ভিতরে স্থল ভাগে ১২-১৩ প্রজাতির বিষধর সাপ বাকি সামুদ্রিক সাপ।
যার ভিতরে পটুয়াখালী জেলায় সচারাচর ৩-৫ প্রজাতি বিষধর সাপ দেখা যায় তবে ক্রেইট প্রজাতির সাপ ও রয়েছে যা সচারাচর দেখা যায়না কারণ তারা রাতে চলাচল বেশি করে বিধায় মানুষের নজরে কম আসে।
কালাচ সাপ উষ্ণতা খোজে যে কারনে মানুষের বিছানায় ওঠে পরে,মানুষ যখন রাতে ঘুমের ঘরে নরাচরা করে তখন সাপ কামড় দেয়,কালাচের দাত অন্যান্য বিষধর সাপের থেকে বিষ দাত ছোট বিধায় দংশনের চিহ্ন বুঝা যায়না যে কারনে কালাচ সাপের দংশনে বেশি মানুষ মারা যায়।
পটুয়াখালী জেলায় রাসেল'স ভাইপারের দেখা কয়েক বার মিললেও সচারাচর দেখা যায়নি,সুধু কয়েক বার কলাপাড়া উপজেলায় দেখা গিয়েছে।
বর্ষার সীজনে কৃষক রা এবং রাতে চলাচলের সময় মানুষ বেশি দংশনের শিকার হয়,কৃষি কাজ করার সময় এজন্য গাম বুট ব্যবহার করা উচিৎ,ঝোপঝাডড়ে চলাচলে লাঠি ব্যবহার করা উচিৎ,রাতে চলাচলের সময় টর্চ ব্যবহার করা উচিৎ,বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখা উচিৎ,এবং রাতে অবশ্যই মসারী টানিয়ে ঘুমানো উচিৎ।
সামুদ্রিক সাপ বেশিরভাগ বিষধর হলেও এদের দ্বারা মানুষ দংশনের রেকর্ড খুবই কম,যদিও দংশন করে সেক্ষেত্রে ড্রাই বাইট বেশি করে,সমুদ্রে মাছ ধরার সময় জেলেদের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে,সামুদ্রিক সাপ জালে ওঠে পরলে তাকে হাত দিয়ে ধরা থেকে বিরত থাকতে হবে। ভারতীয় উপমহাদেশে আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ সাপ রাসেল'স ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া যা আমাদের পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় কয়েকবার দেখা গেছে,তবে ভয় পাওয়ার মত কিছু নেই এরা হটাৎ এক এক জায়গায় উদয় পরে, বর্তমান বর্ষার মৌসুমে এদের এবং মানুষের সংঘাতের পরিমাণটা বেড়ে যায়।
চন্দ্রবোড়া সাপ মূলত পদ্মার চরাঞ্চল সমূহে বেশি লক্ষ করা যায়। এছাড়াও উত্তরবঙ্গের কিছু অঞ্চলে এদের উপস্থিতি রয়েছে।
এরা শুকনো জায়গা পছন্দ করে। নীচু ঘাসের জমি, ক্ষেত যেখানে ইঁদুর সহজ প্রাপ্য এরকম জায়গা এদের পছন্দের।এরা ঈঁদুর, গিরগিটি,ছোট সরীসৃপ, ব্যাঙ, হাঁস -মুরগির বাচ্চা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।
ঠান্ডা আবহাওয়ার চন্দ্রবোড়ারা দিনে সক্রিয় থাকে আবার গরম আবহাওয়ায় রাতে বেশী সক্রিয় থাকে। চন্দ্রবোড়া সাপ গড়ে সাড়ে চার ফুট থেকে ৫ ফুট মতো লম্বা হয়।
এরা যদি নিজেদের বিপদের সম্মুখীন মনে করে তাহলে শরীরের উপরের অংশ S শেপে বাকিয়ে নেয়, যেটাকে স্ট্রাইক পজিশন বলে। এসময় এরা জোড়ে হিস - হিস আওয়াজও করতে পারে।
এদের ভেনম হচ্ছে মূলত হেমোটক্সিন। হেমোটক্সিন এর প্রভাবটা একটু মারাত্মক।এর ফলে কামড়ের জায়গা বাজে ভাবে ফুলে যায়,অসহ্য ব্যাথার উদ্রেক হয়।দেরী করে চিকিৎসা না করালে দেখা যায়, রোগী হয়তো বেঁচে যায়।কিন্তু কামড়ানোর অঙ্গটা বাদ দিতে হয়। হেমোটক্সিন রক্তকে জমাট বাধতে দেয় না এর ফলে রক্তক্ষরণ শুরু হয়।লোমকূপ, চোখ দিয়েও রক্ত ক্ষরণ হতে পারে।
চন্দ্রবোড়া সাপে কাটা রোগীকে ১০০ মিনিটের ভিতর এন্টিভেনম দিতে পারলে রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব।তবে রোগী যদি বেশি ভয় পায়, তাহলে অতিদ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
তবে পুরোপুরি সুস্থ হতে সময় লাগে। দেখা যায়, ব্যাথা প্রায় ২-৪ সপ্তাহ পর্যন্তও থেকে যায়। ক্রেইট প্রজাতির সাইলেন্ট কিলার নামেও পরিচিত তবে ক্রেইটের Banded Krait বা শঙ্খিনি বরিশাল অঞ্চলে দুমুখো সাপ বলে চিনে কিন্তু কোন সাপের দুই মূখ হয়না যদিও হয়ে থাকে সেটা জীনগত কারণে,এর লেজ ভোতা টাইপের বিধায় মানুষ দুমুখো বলে থাকে,শঙ্খিনি মুলত মারাত্মক বিষধর সাপ হলেও এই সাপে কামড়ের রেকর্ড বাংলাদেশে নেই,এরা খুবই লাজুক এবং মানুষের জন্য উপকারী সাপ,এরা যে স্থানে থাকে অই স্থানের আশেপাশে অন্যান্য বিষধর সাপ সহ অন্যান্য সাপের উপস্থিতি কম দেখা যায়।
সর্প দংশনে করণীয়:
প্রথমত রোগীকে আতংকিত হতে দেয়া যাবেনা,তাকে বুঝাতে হবে সাপে কামড়ের চিকিৎসায় রোগী সুস্থ হয় এবং বাংলাদেশের বেশিরভাগ সাপই নির্বিষ।
রোগীকে নড়াচড়া কম করতে দিতে হবে,সাপে দংশন করলে শক্ত করে বাধন দেয়া যাবেনা ততাতে অঙ্গহানী ঘটতে পারে।
হাতে,পায়ে আংটি,চুড়ি,ঘড়ি,তাবিজ,ঘাঘা,নুপুর, তাগা, খুলে ফেলতে হবে এবং খাবার,পানি ইত্যাদি থেকে বিরত রাখতে হবে।
যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে বাম পাশ করে সুইয়ে সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
২০২৩ সালের জুন মাসের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৭ হাজারের বেশি মানুষ বছরে সাপে কামড়ে মারা যায়,যার ভিতর বরিশাল ও খুলনা বিভাগ এগিয়ে,তাই আমাদের জনসচেতনতা আরো বারাতে হবে যেহেতু আমাদের জেলায় ৩ টি উপজেলায় এন্টিভেনম রয়েছে সর্প দংশনের চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে তাই কুসংস্কার ভুলে ওঝা/কবিরাজের কাছে না গিয়ে দ্রুত রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে, বলে জানান পটুয়াখালী এনিমেল ল্যাভার্সের সদস্যরা।
আরএক্স/