কোরবানির আত্মত্যাগের শিক্ষা সুস্থ সমাজ গঠনে ভুমিকা রাখে
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০২:৪৬ অপরাহ্ন, ২৩শে জুন ২০২৩
মানব জীবনে ত্যাগেই সুখ। মানবতার কল্যানে মুলত সব সুখ নিহিত থাকে।ত্যাগে সুখ তার জলন্ত প্রমান হচ্ছে প্রতি বছর মুসলমানদের কোরবানির উৎসব।কোরবানি মুলত নিছক কোন উৎসব নয়। বিশ্বের প্রতিটি মুসলমানের এ কোরবানির মধ্যে জড়িয়ে আছে তাদের পারিবারিক,সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা।আমরা জানি, যাদের মাধ্যমে এ কোরবানির দেয়ার ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছিল তাঁরা ছিলেন একজন নবীদের পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) আর অন্যজন ছিলেন তারই পুত্র হজরত ইসমাইল (আঃ)।স্বপ্নে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে নবীদের পিতা তাঁর প্রাণপ্রিয় সন্তান হযরত ইসমাইল (আঃ) কে শুধু আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য জবাই করার সিদ্ধান্ত নেন ও স্বপ্নের বিষয়টি তাঁর পুত্রকে অবহিত করেন।বিষয়টি শুনে ৬-৭ বছরের শিশু পুত্র সম্মতি দিলেন।
পিতা পুত্রের সম্মতির মধ্যে দিয়ে আল্লাহপ্রেম ও পারিবারিক শিক্ষার একটি সুন্দর চিত্র ফুটে উঠেছে।মুলত কোরবানির উদ্দেশ্য ছিল প্রত্যেক মানুষ নিজে মানবিক হবে,মানবিক হওয়ার পাশাপাশি মহান সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য প্রদর্শন করবে ও নিজে নিজকে মানবতার কল্যানে ত্যাগ করার মানসিকতা সৃষ্টি করবে ও জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে আনুগত্যশীল হবে,আল্লাহ প্রেম ও মানুষের কল্যানে সব সময় নিজকে উৎসর্গ করবে।
কেননা প্রতিটি মানুষকে আল্লাহ প্রেমে অনুগত হতে হবে,আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে।জীবনে প্রতিটি মানুষকে আনুগত্যশীল হওয়ার কোন বিকল্প নেই। সৃষ্টিকর্তার প্রতি সত্যি মানুষ আনুগত্যশীল কিনা তা মহান আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকে যাছাই করবেন।
তাই পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে 'তোমাদের অবশ্যই ভয়,দারিদ্র্য, সম্পদ ও জীবনের ক্ষয়ক্ষতি করার মাধ্যমে পরীক্ষা করবো।’ (সুরা আল বাকারা -১৫৫) আমরা জানি,মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন শুধু তার নির্দেশিত পথে ইবাদত করার জন্য।আল্লাহ বলেন,‘আমি জিন ও মানুষকে এ জন্য সৃষ্টি করেছি যে,তারা শুধু আমার ইবাদত করবে।(সুরা আয যারিয়াত - ৫৬)
কেননা মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরনের মুল উদ্দেশ্য ছিল মানব কল্যান করা,মহান আল্লাহর ইবাদত করা।পৃথিবীতে প্রতি বছর মুসলমানদের কোরবানি দেয়ার যে প্রচলন রয়েছে তাতে মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা হয়ে থাকে,ইবাদত পালন সহ মহান আল্লাহকে স্মরণ করা হয়ে থাকে। পবিত্র কোরানে মহান আল্লাহ বলেন,'এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথপ্রদর্শন করেছেন। সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্মপরায়ণদের।( সুরা হজ্ব : ৩৭)
কাজেই আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের সকলকে আল্লাহর ইবাদত করতে হবে ও আল্লাহর শ্রেষ্টত্ব ঘোষণা সহ তাকওয়া অর্জন করতে হবে।কেননা তাকওয়া অর্জন ও আল্লাহ সন্তুষ্টি ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা কখনও সম্ভব নয়। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় কোরবানির সময় যে কোন হালাল পশু জবাই করা হয় তার মধ্যে দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি আদায় করার চেষ্টা করা হয়।হালাল পশু জবাই করার পর ঐ পশুর মাংস পাড়া-প্রতিবেশী,আত্মীয় স্বজনের মাঝে বিলি-বণ্টন করা হয়।
সমাজে বিলি বন্টনের যে রেওয়াজ রয়েছে বা যে বিধি ইসলামে রয়েছে তা হতে মানুষে মানুষে পারস্পরিক সহযোগিতা,সহানুভূতির যে শিক্ষা পাওয়া যায় তা মানবিক সমাজ গঠনে একটি গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা রাখে।
অন্যদিকে কোরবানিতে পশু জবাই করার পর রান্নাকৃত মাংস ভাই,বোন,আত্মীয় স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদেরকে ডেকে তাদের সাথে বসে এক সাথে খাওয়া ও তাদেরকে আপ্যায়ন করার মধ্যে দিয়ে সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও মমত্ববোধ তৈরি হয়ে থাকে যা একটি সুন্দর সমাজ গঠনে ভুমিকা রাখে।
আমরা জানি,পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে,রয়েছে তাঁর নিজস্ব চিন্তা চেতনা তারপরও প্রতিটি কোরবানে ২ বা ৩ বা ৪ বা ৫ বা ৬ বা ৭ জন মিলে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে হালাল পশু দিয়ে কোরবানি সম্পন্ন করার মধ্যে দিয়ে প্রতিটি মুসলমান ইসলামী শিক্ষা ও উদারতার সাক্ষর রাখে।মুলত কোরবানি আমাদের এই শিক্ষা জানান দেয় তা হলো আমাদের অন্তরে যে অমানবিক দিক গুলো থাকে তা পুরোপুরি বিসর্জন দেয়া বা ত্যাগ করা।
এক কথায় বলা যায় আমাদের আত্মঅহঙ্কার ও শ্রেষ্টত্বমনোভাব বিসর্জন দেয়া।কোরবানি মধ্যে দিয়ে আমাদের কে আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন করতে হবে ও মানবিক গুণে গুণান্বিত হতে হবে।পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন,'আর কোরবানির উটকে (পশু) আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন বানিয়েছি,তাতে তোমাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ।সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান অবস্থায় সেগুলোর ওপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো, যখন সেটি পড়ে যায় তখন তা থেকে খাও।যে অভাবী,মানুষের কাছে হাত পাতে না এবং যে অভাবী সাহায্য চায়,তাদের খেতে দাও (সূরা হাজ্জ-৩৬)।
তাহা ছাড়া কোরবানির পশুর মাংস ৩ ভাগে ভাগ করার যে নিয়ম ইসলামী শরীয়তে রয়েছে তা সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে। মুলত,কোরবানি মানুষ কে আত্মত্যাগ শেখায়,ভালোবাসতে শেখায়,নৈতিক দায়িত্ব বোধে মানুষকে উজ্জীবিত করে।এই সমাজে একজন বিত্তশালী মানুষের নৈতিক দায়িত্ব কি তা জানান দেয়, একজন বিত্তশালী গরিব, দুঃখী ও অসহায় মানুষকে সব সময় সাহায্য-সহযোগিতা করবে কোরবানি তার শিক্ষা দেয়।
কাজেই মহান আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইব্রাহিম (আঃ) ও ইসমাইল (আঃ) আত্মত্যাগের যে উদাহরন সৃষ্টি করেছেন তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আত্মত্যাগের মাধ্যমে এই সমাজের দুঃস্থ, অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফুটানো আমাদের দায়িত্ব।
অন্যদিকেকোরবানি হতে আত্মউৎসর্গের শিক্ষা নিয়ে সমাজের প্রতিটি বিত্তশালী মানুষ গরীব ও দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াবে,সমাজ উন্নয়নে,মানবিক সমাজ গঠনে তারা অগ্রনী ভুমিকা রাখবে এটি সকলের প্রত্যাশা।
আরএক্স/