ঢাকা কলেজের স্মৃতির পাতায় জ্ঞানসাধক কাজী মোতাহার হোসেন
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:০১ অপরাহ্ন, ৩০শে জুলাই ২০২৩
আল জুবায়ের,ঢাকা কলেজ: কাজী মোতাহার হোসেন। তিনি ছিলেন একাধারে একজন বাংলাদেশি পরিসংখ্যানবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও জাতীয় অধ্যাপক। যাকে নিয়ে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলতেন,‘আপনভোলা নিরহংকার মানুষ, বিদ্বান ও গুণী।’ যাঁকে নিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছিলেন, “একজন উদারমনা মুসলমান ও সেই সঙ্গে দেশপ্রাণ বাঙালি এবং সকলের উপর একজন সৎ মানুষ।” তাঁর সাহিত্যের মূল্যায়ণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- তাঁর রয়েছে ‘স্বচ্ছ প্রাঞ্জল ভাষা, ‘বলবার সাহস’ ও ‘চিন্তার স্বকীয়তা’। এই মানুষটিই বাংলাদেশে মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীলতা বিকাশের এক অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। এতসব গুনের অধিকারী যে মানুষটিকে নিঃসন্দেহে 'অলস্কয়ার'হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।
আজ ৩০ জুলাই, ঢাকা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী বাংলাদেশের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও পণ্ডিত ড. কাজী মোতাহার হোসেনের ১২৬ তম জন্মদিন।
প্রাথমিক জীবন:
বহুমুখী প্রতিভার এই মানুষ মামার বাড়িতে ১৮৯৭ সালের ৩০ জুলাই কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার অন্তর্গত লক্ষ্মীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার গোয়ালন্দ মহকুমাধিন পাংশা থানার বাগমারা গ্রামে। ১৯২১ সালে এম.এ পড়া কালীন সময়ে কলকাতার তালতলা নিবাসী মোহাম্মদ ফয়জুর রহমানের কন্যা সাজেদা খাতুনকে বিয়ে করেন। তাদের চার পুত্র ও সাত কন্যার সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। মেয়েদের মধ্যে সনজীদা খাতুন বাংলাদেশের একজন খ্যাত নামা শিক্ষাবিদ ও সঙ্গীতজ্ঞ। রবীন্দ্র সংগীতের শিল্পী হিসেবে দেশ জুড়ে তার পরিচিতি। বড় ছেলে কাজী আনোয়ার হোসেন লেখক, অনুবাদক, প্রকাশক এবং জনপ্রিয় মাসুদ রানা সিরিজের স্রষ্টা। এছাড়াও তিনি সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার। যা গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে সাহিত্যচর্চা হিসেবে বিদেশি সাহিত্যকে জনপ্রিয় করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।
মোতাহার হোসেনের শিক্ষাজীবন শুরু কুষ্টিয়াতে। মেধাবি ছাত্র হিসাবে বৃত্তি নিয়ে ১৯০৭ সালে নিম্ন প্রাইমারি ও ১৯০৯ সালে উচ্চ প্রাইমারি পাশ করেন। ১৯১৫ সালে কুষ্টিয়া মুসলিম হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা পাস করে ভর্তি হন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। এখানে তিনি শিক্ষক হিসেবে পান প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে। ১৯১৭ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯১৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বিএ পরীক্ষায় বাংলা ও আসাম জোনে প্রথমস্থান অর্জন করে মাসিক ৩০ টাকা বৃত্তিলাভ করেন। ঢাকা কলেজে তার শিক্ষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ওয়াল্টার অ্যালেন জেনকিন্স, পদ্মভূষণ ভূপতি মোহন সেন।
১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম স্থান নিয়ে এমএ পাশ করেন। উল্লেখ্য, সেবছর কেউ প্রথম শ্রেণি পান নি। ১৯৩৮ সালে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে পরিসংখ্যান বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন। যুগপৎভাবে, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে পি.এইচ.ডি করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল 'Design of Experiments'। তার ডক্টরাল থিসিসে তিনি 'Hussain's Chain Rule' নামক একটি নতুন তত্ত্বের অবতারণা করেন। বস্তুত, তৎকালীন পূর্ববঙ্গে (বর্তমান বাংলাদেশ) তিনিই প্রথম স্বীকৃত পরিসংখ্যানবিদ।
কর্মজীবন:
১৯২১ সালে ঢাকা কলেজে ছাত্র থাকাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ডেমনেস্ট্রেটর হিসেবে চাকরি শুরু করেন এবং একই বিভাগে ১৯২৩ সালে একজন সহকারী প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। কাজী মোতাহার হোসেনের নিজ উদ্যোগে ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানে এম. এ. কোর্স চালু হয় এবং তিনি এই নতুন বিভাগে যোগ দেন। তিনি গণিত বিভাগেও শিক্ষকতা করেন ( ১৯৪৯-১৯৫৯ সাল পর্যন্ত) । ১৯৫১ সালে তিনি পরিসংখ্যানে একজন রিডার ও ১৯৫৪ সালে অধ্যাপক হন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি পরিসংখ্যান বিভাগে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৪ সালে স্থাপিত পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউটের তিনি প্রথম পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে এমিরেটাস অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়।
কর্মজীবনে বিভিন্ন অর্জন:
১৯২৬ সালে কাজী আব্দুল ওদুদ, সৈয়দ আবুল হোসেন ও আবুল ফজলের সাথে তিনি মুসলিম সাহিত্য সমাজ গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে তিনি কিছুকাল `শিখা` নামক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি বাংলা একাডেমির একজন প্রতিষ্ঠাতা। কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতির উপর অনেক বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে সঞ্চয়ন, নজরুল কাব্য পরিচিতি, সেই পথ লক্ষ্য করে, সিম্পোজিয়াম, গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস, আলোক বিজ্ঞান, নির্বাচিত প্রবন্ধ অন্যতম।
১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনকে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৬৬ সালে প্রবন্ধসাহিত্যের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং বিজ্ঞান চর্চায় অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৭৯ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার হিসাবে পরিচিত স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয় তাকে। ১৯৭৪ সালে বিজ্ঞান ও কলা বিষয়ে অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ডিএসসি ডিগ্রি দ্বারা সম্মানিত করে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে সম্মানিত করে। ১৯৮১ সালের ৯ অক্টোম্বর তিনি ঢাকাই মৃত্যুবরন করেন।
জেবি/এসবি