ঐতিহ্যের হারিকেন বিলুপ্তির পথে
উপজেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৫:০০ অপরাহ্ন, ২রা আগস্ট ২০২৩
আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের জীবনধারায় এসেছে বিপুল পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনের ধারায় নতুন অনেক কিছু যেমন যুক্ত হয়েছে মানুষের জীবনে, তেমনি অনেক কিছু হারিয়েও গেছে। একটা সময় পর্যন্ত রাতের অন্ধকার দূর করতে মানুষের অন্যতম অবলম্বন হারিকেনের স্থানও সেই হারিয়ে যাওয়ার দলে। যে হারিকেন একসময় গ্রামীণ জনপদে ছিল আলোর একমাত্র উৎস, সেই হারিকেনকেই যে আজ ‘হারিকেন জ্বালিয়ে খোঁজা’র পরিণতি বরণ করতে হয়েছে।
অন্ধকার ঘরকে আলোকিত করা, রাতের বাজারে দোকানদারি করা, এমনকি রাতে চলাফেরা করার জন্যও হারিকেন ছিল গ্রামের মানুষের একমাত্র অবলম্বন। সন্ধ্যা হলেই হারিকেন নিয়ে পড়তে বসত শিক্ষার্থীরা। বিদ্যুৎসংযোগের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যুতিক বাতিসহ বিভিন্ন পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি পেলেই প্রয়োজন ফুরিয়েছে সেই হারিকেনের। তা এখন পরিণত হয়েছে স্মৃতিতে। এ যুগের শিশু-কিশোরদের কাছে হারিকেন কেবলই হারিয়ে যাওয়া অতীতের কোনো স্মৃতিচিহ্ন।
হারিকেন জ্বালানোর স্মৃতি বর্ণনা করে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার উত্তর আলেপুর গ্রামের বয়োবৃদ্ধ মন্নান মিয়া বলেন, ‘ছোটবেলায় সন্ধ্যার আগে আগে হারিকেনের কাচের চিমনি খুলে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতাম। তারপর কেরোসিন তেল ঢেলে দিয়াশলাই দিয়ে আগুন জ্বালাতাম। হারিকেনের কেরোসিন তেল রাখার জন্য গ্রামের সব বাড়িতেই কাচের বোতলের গলায় রশি লাগিয়ে বাঁশের খুঁটিতে ঝুলিয়ে রাখা হতো।
পৌর এলাকার পানিশালা গ্রামের সাবেক শিক্ষক ঝুলন চক্রবর্তী বলেন, ‘ছোটবেলায় আমরা ল্যাম্প কিংবা হারিকেনের মৃদু আলো জ্বালিয়ে ছাত্রদের লেখাপড়া করিয়েছি। বাতাসের ঝাপটায় কখনো কখনো আলো নিভে যেত। আবার দিয়াশলাই বা চুলা থেকে পাটকাঠি দিয়ে আগুন নিয়ে হারিকেন জ্বালাতে হতো।’
একই এলাকার রিকশাচালক চনু মিয়া বলেন, ‘আগেও রিকশা চালাতাম। তখন রাস্তাঘাটে এখনকার মতো ল্যাম্পপোস্ট ছিল না। তাই রাতে রিকশার নিচে লেমটন (হারিকেন) লাগিয়ে রাখতাম পথ দেখার জন্য। এক পোয়া (২৫০ গ্রাম) কেরোসিন ভরলে সারারাত চলে যেত। এখন তো ব্যাটারি রিকশা চালাই। রিকশার সামনে লাইট থাকে, তার আলোতে পথ চলি। লেমটন (হারিকেন) এখন হারিয়ে গেছে।
কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছ বাজারের স্থানীয় দোকানদার হারুন মিয়া বলেন, ‘১৫-২০ বছর আগে সন্ধ্যায় হারিকেন জ্বালানোর জন্য কেরোসিন তেল নিতে মানুষের সিরিয়াল লেগে যেত। এখন হারিকেন তো বটেই, বাজার ঘুরে কেরোসিন তেল খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। কোনো কোনো বাড়িতে জঞ্জালের ভিড়ে হয়তো মরিচা পড়া জীর্ণ চেহারার হারিকেনের দেখা মিলতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হারিকেন হারিয়েই গেছে। নতুন প্রজন্মের কেউই হয়তো হারিকেন চোখেই দেখেনি। একসময় হয়তো জাদুঘরে শুধু দেখা মিলবে, হয়তো বইয়ের পাতায় উল্লেখ থাকবে হারিকেনের।
আরএক্স/