ড্যান্ডির নেশায় বুঁদ, নির্যাতন-নিপীড়ন নিত্য সঙ্গি
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১০:২০ পূর্বাহ্ন, ৩০শে আগস্ট ২০২৩
লাল লাল চোখ, বাদামি বাঁকানো ময়লা চুল। ছেড়া গেঞ্জি ও ময়লাযুক্ত প্যান্ট পরে বসে আছে পথে। কখনো দলবদ্ধ হয়ে আবার কখনো একাকি। রাজধানীর বিভিন্ন পথেই তাদের আবাস। পথেই তাদের খাওয়া, ঘুম, বসত। ঘুমে জড়িয়ে আসে তাদের চোখ। কিন্তু ঘর না-থাকায় অনিরাপদ রাস্তা, ফুটপাত, পরিত্যক্ত নোংরা কোনো ঘর হয়ে ওঠে ওদের বিশ্রামের জায়গা। পথের সেই ‘ঘুমঘরের’ জন্যও করতে হয় লড়াই। সে ঘুম ভাঙে ভোরের রোদের তীব্র ছটা কিংবা প্রহরীর ছুড়ে মারা পানিতে। চোখ মেললেই পেটের চিন্তা। জীবিকার সন্ধানে বস্তা হাতে নিয়ে কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে ভাঙারি। ভাঙ্গারি টোকানো বা কাগজ কুড়ানোর মধ্যেও পলিথিনের প্যাকেটে মুখ ঢুকিয়ে সেবন করছে ড্যান্ডি। কখনো সেই পথেই সম্ভ্রমহানি করে পথের মানুষ। তবু সেই পথই তাদের সব পথই তাদের ‘মা-বাবা’। কারণ তারা তো পথশিশু।
কে তাদের মা-বাবা? কোথায় জন্ম, কেন তারা পথে বসবাস করে? কোথায় তাদের বাড়ী-ঘর? এসব অনেক প্রশ্নেরই উত্তর জানে না পথশিশুরা। তবু কেটে যাচ্ছে তাদের জীবন। যে বয়সে বই খাতা নিয়ে স্কুলে যাবে সে বয়সে কেউ হাঁটছে চুরি-ছিনতাই-মাদক বেচাকেনাসহ নানা অপরাধের পথে, কেউ বা মাদকের নেশায় দিচ্ছে ডুব। মাদক বেচাকেনা কিংবা বোমা-ককটেল ফোটানোর মতো অনৈতিক কাজে এসব শিশুকে ব্যবহার করে সমাজের কিছু দুষ্ট প্রকৃতির মানুষ। সেটাও অবুঝ এসব শিশুর কাছে হয়ে যায় জীবিকার তাগিদ। চরম দারিদ্র্য, অপুষ্টি, রোগ, নিরক্ষরতা ও সহিংসতাসহ নানা বঞ্চনার শিকার এসব শিশু।
ওদের ঘুমের সঙ্গী রাস্তার কুকুর-বিড়াল
রাস্তার কুকুর-বিড়াল পথশিশুদের ঘুমের সঙ্গী। চৈত্রের তাপদাহ, আষাঢ়ের বৃষ্টি বা মাঘের শীত সবকিছু সঙ্গী করে পথেই ঘুমায় তারা। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ঘুমাচ্ছিল পথশিশু আফসানা (ছদ্মনাম)। তার সঙ্গে মাথার নিচে বস্তা দিয়ে ঘুমাচ্ছিল আরও সাত-আটজন। তাদের পাশেই ঘুমাচ্ছে দুইটি কুকুর আর চারপাশে মাছি ভন ভন করছে। এর মধ্যে লাঠি হাতে চৌকিদার এসে তাদের ওঠার জন্য বলেন। বারবার বলার পরও তারা ঘুম থেকে না উঠলে পানি ঢেলে দেন শরীরে। চোখ ঘষতে ঘষতে তাড়াহুড়ো করে উঠে বসে পড়ে তারা। মুখ গুলো দেখলে যে কারোই মনে মায়া লেগে যাওয়ার কথা কিন্তু চৌকিদারের মনে হলো কোন কিছুই কাজ করলো না। রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন, সদরঘাট, হাইকোর্ট মাজার, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, বিমানবন্দর রেলস্টেশন, টঙ্গী রেলস্টেশন, পলাশী মোড়, দোয়েল চত্বর, চানখাঁরপুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শহীদ মিনার, ঢাকা মেডিকেল, গাবতলীসহ বিভিন্ন ফুটপাত বা ফুট ওভারব্রিজ এলাকা তাদের ঘুমের জায়গা। বাস, ট্রেনসহ আশপাশের অসহনীয় কোনো শব্দও তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় না। ব্যাঘাত ঘটান কিছু মানুষ।
গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা পথশিশু রোকেয়া সােথে কথা বলে জনবাণী, তার গ্রামের বাড়ী বগুড়া। আট বছর ধরে ঢাকার রাস্তায় থাকে রোকেয়া। সৎ মায়ের অত্যাচারে গ্রামের বাড়ি বগুড়া থেকে ঢাকায় চলে আসে সে। রোকেয়া বলে ‘মা অন্য লোকের সঙ্গে চলে যাওয়ার পর বাবা আরেকটা বিয়ে করেন। সৎমা খেতে দিতো না। সব সময় মারতো। বাঁচার জন্য গ্রামের বাড়ি বগুড়া থেকে ঢাকায় চলে আসি। আসার বছরখানেক পর একবার বাড়িতে গেছিলাম। তখন বাবা ও সৎমা মিলে মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। নিজের মায়ের কাছে গেলে সৎবাবাও মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আবার ঢাকায় চলে আসি। এখানেই এখন বাড়ি-ঘর।’ খারাপ কোন কিছুর শিকার হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই রোকেয়া বলে ওঠে ‘রাত হলেই আতঙ্ক লাগে। অনেকে খারাপ প্রস্তাব দেয়। আবার অনেকে জোর করে খারাপ কাজ করে। কোথাও কোনো ঠিকানা না থাকায় এভাবেই দিন-রাত পার করছি। আমারও ভালোভাবে বাঁচতে মন চায়।’
ঘুম চোখে শিমুল বস্তার নিচ থেকে ড্যান্ডির পলিথিন বের করে টানতে থাকে, খালি পেটে কেন ড্যান্ডি খাচ্ছ জানতে চাইলে বলে সে বলে, ‘আরও একটু ঘুমাতে পারলে ভালো হতো। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা। পকেটে টাকা নেই। চোখে এখনো প্রচণ্ড ঘুম। ড্যান্ডি খেলে ঘুম কেটে যাবে আর ক্ষুধাও থাকবে না।’
ফার্মগেট ওভারব্রিজে কথা হয় ১০ বছরের এক পথশিশু আসিফের (ছদ্মনাম) সাথে। এই ছোট হৃদয়ে বলে উঠলো কষ্টের কথা। হাতে আছে পলিথিনে মোড়ানো ড্যান্ডি কিছুসময় পরপর টানছে সেটি। এই বয়সে নেশা করার কারণ জানতে চাইলে সে জানায়, ‘এ আঠা টানলে মাথা ঝিম ঝিম করে, ঘুম আহে। বাবা-মা হারানোর কষ্ট ভুইল্যা যাই। ময়লা আবর্জনার ডাস্টবিনে ভাঙারি কুড়ানোর সময় দুর্গন্ধ থেকে বাঁচতে আর ময়লা তুলতে হাত পা কেটে যাওয়ার ব্যথা অনুভব থেকে রক্ষা পেতেও আঠার নেশা করার কথা জানায় সে।’
ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পথশিশুদের নিয়ে ‘সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেন ২০২২’ শীর্ষক একটি জরিপ করে। ২০২৩ সালের ১০ এপ্রিল প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে তথ্য অনুযায়ী দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে পথশিশুর সংখ্যা। পথশিশুদের ওপর সহিংসতার চিত্র ভয়াবহ। মানসিক, শারীরিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয় ৭৯ শতাংশ পথশিশু। ৭৬ শতাংশ পিতৃপরিচয় না থাকায় পথশিশুকে মানসিক নিপীড়ন, হেনস্তা, অশ্লীল ভাষায় গালাগাল শোনাসহ বিভিন্ন ধরনের কটূক্তির শিকার হতে হয়। তাছাড়া শুধু শারীরিক নির্যাতনের শিকার ৬২ শতাংশ পথশিশু। দৈনিক গড়ে ১০ ঘণ্টা ভিক্ষা করে একটি পথশিশু। ৩৫ শতাংশ শিশু ভিক্ষা করার কথা স্বীকার করেছে। ৪২ শতাংশ শিশু রাস্তায় বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করে। ৯৫ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক কোনো ধরনের পড়াশোনা করছে না। ঢাকা ও দেশের আটটি বিভাগের হটস্পটে (যেসব স্থানে পথশিশুর আনাগোনা বেশি) পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী সাত হাজার দুইশ শিশুর কাছে সরাসরি গিয়ে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে জরিপ প্রতিবেদনটি তৈরি। জরিপে রাস্তা-ঘাটে বসবাসকারী শিশুদের মোট সংখ্যা না থাকলেও ইউনিসেফ বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এ সংখ্যা ১০ লক্ষাধিক হতে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত পথশিশু জরিপ ২০২২-এর ফলাফল অনুযায়ী, পথশিশুদের সর্ব্বোচ্চ ২০ দশমিক ৪ শতাংশ চট্টগ্রাম বিভাগ এবং সর্বনিম্ন ৪ দশমিক ৯ শতাংশ সিলেট বিভাগের জেলাগুলো থেকে এসেছে। এক্ষেত্রে পথশিশুর নিজ জেলা ময়মনসিংহ সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৯ শতাংশ এবং বরিশাল ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, ভোলা ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, কুমিল্লা ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, কিশোরগঞ্জ ৪ দশমিক ১ শতাংশ এবং কক্সবাজার ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।
প্রধানত ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ পথশিশু দারিদ্র্য, ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ বাবা-মা শহরে আসার কারণে এবং ১২ দশমিক ১ শতাংশ কাজের সন্ধানে বাড়ি ছেড়ে শহরে এসেছে। প্রতি পথশিশুর পাঁচজনের দুজনই একা একা শহরে এসেছে। ১০ জন পথশিশুর তিনজন কখনই স্কুলে ভর্তি হয়নি। সব পথশিশুর কেবল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ পঞ্চম শ্রেণি পাস করেছে। খুব নগণ্য সংখ্যক পথশিশু নিম্ন ও উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনা করেছে। প্রায় চার ভাগের একভাগ পথশিশু ধূমপান করে এবং ১২ শতাংশ মাদকের নেশায় আসক্ত। আর ৬৪ শতাংশ পথশিশু তাদের পরিবারে ফিরে যেতে চায় না।
জরিপ আরও বলছে, ঢাকা বিভাগে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু অবস্থান করছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ২২ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১৮ দশমিক ৩ শতাংশের বসবাস। এসব পথশিশুর মধ্যে ৮২ শতাংশ ছেলে এবং ১৮ শতাংশ মেয়ে। ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী পথশিশু ৫৪ শতাংশ। এছাড়া পথশিশুদের ১২ শতাংশই মাদকাসক্ত।
ফুটপাত বা ফুট ওভারব্রিজ রাজপথই ওদের ঠিকানা
‘কমলাপুর রেল স্টেশনের মধ্যে ঘুমালে এক-দুই ঘণ্টার বেশি ঘুমানো যায় না। স্টেশনের বাইরে ওভারব্রিজের ওপর ঘুমালে একটু বেশি ঘুমানো যায়। তবে ওভারব্রিজে অনেকেই ঘুমায়, এখানে জায়গা পাওয়া কঠিন। রাতে ঘুমানোর জন্য কোনো ঘর থাকলে এখানে থাকতাম না। শান্তিমতো একটু ঘুমাতাম। ক্ষুধা ও ঘুমচোখে আমাদের কাজে বের হতে হয়। ক্ষুধা ও ঘুমের জ্বালা মেটাতেই আমরা মাদক সেবন করি।’ এভাবেই বলছিলো রত্না (ছদ্মনাম)।
রত্নারা একটু শান্তিতে ঘুমাতে চাই। মাদক থেকেও দূরে থাকতে চাই। ‘কিন্তু সমাজের কিছু মানুষ আমাদের হাতে মাদক তুলে দিচ্ছে। যারা আমাদের হাতে মাদক তুলে দিচ্ছে তাদের কোনো বিচার হচ্ছে না। সব দোষই আমাদের দেওয়া হয়। আমাদের যারা নষ্ট করছেন তাদের কেন বিচার হচ্ছে না।’ তার বাবা-মা কে, কীভাবে এ জীবনে পা বাড়ালো সেটাও জানে সে। রত্মা বলে, বুঝ হওয়ার পর থেকে বাবা ও মাকে পাইনি। আমার বাবা-মা কে আমি জানি না।
শিক্ষা, বস্ত্র, বাসস্থান আর ক্ষুধার যন্ত্রণায় তাদের আর্তনাদ
রাজধানীর ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় থাকে পথশিশু মাসুদ (ছদ্মনাম) আলাপকালে জনবাণীকে বলে, ‘আমারও অন্যদের মতো বাঁচতে মন চায়। আমি আগে নেশা করতাম। এখন করি না। আমারও স্কুলে যেতে মন চায়। কিন্তু পেটের দায়ে স্কুলে যেতে পারি না। কাজ না করলে খাবো কী। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে চাই কিন্তু সারাদিন বাইরে থাকার কারণে নামাজ পড়তে পারি না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তাম আর শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম যদি একটা থাকার ঘর থাকতো।’
দেশের সংবিধান অনুযায়ী সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্র নাগরিকদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, আমাদের পথশিশুরা সেই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। ক্ষুধার যন্ত্রণায় এদের আর্তনাদ আমাদের স্পর্শ করে না। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে যেসব শিশু রাস্তায় দিনাতিপাত করে, রাস্তায় কাজ করে, রাস্তায় ঘুমায়, নির্দিষ্ট কোনো আবাসস্থল নেই, উল্লেখ করার মতো নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই, খোলা আকাশের নিচে পার্ক, বাসস্টেশন, ফেরিঘাট, রেলস্টেশন শহরের অলিতে-গলিই তাদের ঠিকানা। এদের না আছে মাথা গোঁজার ঠাঁই, না আছে শিক্ষা গ্রহণের তদারকি, না আছে চিকিৎসা পাওয়ার সুব্যবস্থা।
মহানগর নাট্যমঞ্চের সামনের সড়কে গিয়ে দেখা মেলে খাদিজার (ছদ্মনাম) সাথে। পথের জীবনে সে কীভাবে এলো জানতে চাইলে বলে, ‘বগুড়া থেকে মা আমাকে বনানীর একটি বাসায় কাজ করার জন্য রেখে যায়। সেই বাড়ীর কাজে একটু ভুল হলেই খুব মারতো। ঠিকমতো খাবারও দিতো না। তাই একদিন বাসা থেকে পালিয়ে বের হয়ে যায়। নিজের বাড়ির ঠিকানাও জানা ছিলো না। তাই কোন উপায় না পেয়ে পথেই থাকি পথেই খাই কেউ দিলে খাই না দিলে না খেয়েই থাকি।’
একটি গবেষণায় দেখা যায়, ছয় মাস অন্তর ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ পথশিশু তাদের নির্দিষ্ট স্থান পরিবর্তন করে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কারণে ২৯ শতাংশ শিশু স্থান পরিবর্তন করে আর ৩৩ শতাংশ নির্দিষ্ট স্থান পরিবর্তন করে পাহারাদারের কারণে।
পথশিশুরা নেশায় আসক্ত নেই খেলাধুলার অধিকার
খেলাধুলার সুযোগ না থাকায় পথশিশুরা নেশায় আসক্ত হচ্ছে। খেলাধুলা শিশুদের অধিকার। অথচ পথশিশুরা এ অধিকার থেকে চরমভাবে বঞ্চিত। বিমানবন্দর রেলস্টেশনে কথা হয় পথশিশু আরিফের (ছদ্মনাম) সাথে। চোখে পানি নিয়ে আরিফ বলে, ‘পথে ঘোরার সময় দেখি আমার বয়সী অনেক শিশু খেলাধুলা করে। আমি পাশ থেকে দাঁড়িয়ে দেখি। তাদের খেলা দেখে আমারও খেলতে মন চায়। কিন্তু তারা আমাকে খেলায় নেয় না। খেলাধুলা করতে পারলে মনটা অনেক ভালো লাগতো।’
ওরা রাস্তায় ঘুমায়। পথে পথে ঘোরে। ক্ষুধার দায়ে রাস্তায়ই বেছে নেয় জীবিকার পথ। পথশিশুরা আর সব সাধারণ শিশুর মতো নয়। এ বয়সে ওদের কেউ মায়ের কোলে, কেউ স্কুলে থাকতে পারতো। থাকতে পারতো পরিবারের অটুট বন্ধনে। কিন্তু নিয়তির ফেরে এসব কিছুই পাওয়া হয় না ওদের। সরকারঘোষিত ভিশন ২০৪১ অর্জন করতে হলে এখনই এসব শিশুর কল্যাণে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা তৈরি প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ওদের কল্যাণে নেই কোনো নীতিমালা।
পথশিশুদের কল্যাণে যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
পথশিশুদের ভেতর থেকে ফিল করেন উল্লেখ করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ডা. কামাল উদ্দিন আহমেদ জনবাণীকে বলেন, আমি তাদের অধিকার চাই। তাদের অধিকার ফিরে পাওয়া উচিত। শিশুরা এ অবস্থায় থাকা জাতির জন্য রীতিমতো ভয়ঙ্কর একটা বিষয়। রাস্তায় দেখা যায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েগুলো থাকছে, এদের কী ভবিষ্যৎ আছে? এরকম দুঃসহ জীবনতো আমরা চিন্তা করতে পারি না। তাদের প্রতি সমাজের মানুষের দায়িত্ব আছে কিন্তু তাদের দায়িত্বহীনতা জন্য কিছু করা যাচ্ছে না। এদের কোনো আইডি কার্ড নেই। এদের একটা আইডি কার্ড করার জন্য আমরা চিন্তা-ভাবনা করেছিলাম।
জনবাণীর সাথে কথা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান ডা. ইফফাত আরা শামসাদের তিনি বলেন, ‘সব মাদকই ক্ষতিকর। মাদকে আসক্ত হলে শারীরিক, ব্রেন ও হার্টের ওপর প্রভাব পড়ে। তাছাড়া পথশিশুদের পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ায় শারীরিক ও মানসিক কাঠামো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীর ভারসাম্য হারায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান জনবাণীকে বলেন, ‘ঢাকার এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে শিশুরা খেলা করবে। যথাযথ পার্ক নেই যেখানে শিশুরা যাবে। পরিবার না থাকায় তারা যথাযথ প্রাথমিক শিক্ষাও পায় না। যখন এগুলো শিশুরা পায় না তখন তারা নানা অপরাধে জড়িত হয়। শিশুরা অপরাধ করলে তাদের প্রতি কেমন আচরণ করতে হবে তার জন্য পুলিশের যথাযথ প্রশিক্ষণ বা নির্দেশনাও দেওয়া হয় না।’
ভালো কাজের হোটেলের প্রধান উদ্যোক্তা ও পরিচালক আরিফুর রহমান জনবাণীকে বলেন, ‘বাসস্থান, শিক্ষা, ভালো খাবার পাওয়া, চিকিৎসার অধিকার আছে। শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা পায় পরিবার থেকে। এগুলো থেকে তারা বঞ্চিত। কিন্তু পথশিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা তো দূরের কথা, নৈতিক শিক্ষাও পায় না। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, চিন্তা করা উচিত। পথশিশুরা অকালেই ঝরে যাচ্ছে। মাদকে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে কোনটা ন্যায় বা অন্যায় তা তারা বুঝতে পারে না। তাই পথশিশুদের হাতে ১০ টাকা ২০ টাকা দিয়ে নানান খারাপ কাজ করানো হয়। সামান্য কিছু টাকা দিয়ে মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, ককটেল মারা, বোমা মারার মতো কাজ করিয়ে নেয় কেউ কেউ। তাদের নিয়ে আমাদের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, চিন্তা করা উচিত। আমরা চাইলে তাদের সম্পদে পরিণত করতে পারি। ’
মৌলিক চাহিদা থেকে পথশিশুরা বঞ্চিত উল্লেখ করে পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জুম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী প্রধান মো. শাহীন প্রধান জনবাণীকে বলেন, ‘দুপুরে খাবার খেলেও রাতের খাবারের নিশ্চয়তা এই শিশুদের নেই। ঝড়-বৃষ্টিতে এই শিশুদের নিরাপদ কোনো আশ্রয় নেই। বছরের পর বছর ছেঁড়া, নোংরা জামা পরতে দেখা যায় তাদের। অসুখ হলে নিশ্চিত হয় না সঠিক ও পরিপূর্ণ চিকিৎসা। মানুষের যে মৌলিক চাহিদাগুলি রয়েছে সে অধিকার থেকে পথশিশুরা বঞ্চিত। ফলে চুরি, ছিনতাই, নেশাদ্রব্য গ্রহণের মতো নানারকম অনৈতিক এবং অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব। পথশিশুদের একটি সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন দেওয়ার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও নীতিমালা।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খালিদ হোসেন জনবাণীকে বলেন, ‘পথশিশুদের জন্য সরকারের বরাদ্দ থাকলেও প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন ও দেখভালের অভাবে এসব শিশুরা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধ ও শিশুশ্রমে; যা সমাজের জন্য অশনিসংকেত। মাদকাসক্ত পথশিশুরা তাদের মাদক কেনার টাকা জোগাড় করার জন্য হরহামেশাই চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়াচ্ছে। মাদক বিস্তারের ক্ষেত্রেও তারা মাদক কারবারিদের ভরসাস্থল হয়ে ওঠে। এসব শিশুকে মূলধারায় আনতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের আওতায় এনে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা উচিত। তাদের নিয়ে আমাদের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’
জেবি/এসবি