'কেন ফেল করেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা'


Janobani

ক্যাম্পাস প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১১:১৯ পূর্বাহ্ন, ৩১শে আগস্ট ২০২৩


'কেন ফেল করেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা'
সরকারি সাত কলেজ। প্রতীকী ছবি

সম্প্রতি, কয়েকদিন ধরে রাজধানীর ঢাবি অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজ নিয়ে চলছে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়।চলতি বছর জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১০বার বিভিন্ন  অভিযোগ নিয়ে নীলক্ষেত মোড়ে দফায়-দফায়  আন্দোলন করছেন,স্লোগান তুলছেন,রাস্তায় নেমেছেন শিক্ষার্থীরা।


 শিক্ষার্থীরা কেন অকৃতকার্য হয়ে বার বার রাস্তায় নামছে,আন্দোলন করছে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজার চেষ্টা করেছে দৈনিক জনবাণী। 


"ক্লাস রুম সংকট,শিক্ষক সংকট,আবাসন সংকট 'ঠিকভাবে ক্লাস না হওয়া,লাইব্রেরি না থাকা,দেরিতে রেজাল্ট, ঢাবির একাডেমিক ক্যালেন্ডার না থাকা, এসব সমস্যাকে ফেইল করার অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করছেন সাত কলেজ শিক্ষার্থীরা।অনেক শিক্ষার্থী  মনে করেন,যদি পর্যাপ্ত আবাসিক হল থাকতো তাহলে শিক্ষার্থীদের বাসা-বাড়ি বা মেসে থাকতে হতো না। বাইরে মেসে থাকার একটা বড় অঙ্কের টাকা গুনতে হয় শিক্ষার্থীদেরকে। আর যারা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসে তাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য হয় যায় । একসময় দেখা যায়,এসব টাকা জোগাড় করার জন্য টিউশনি,পার্ট-টাইম জব করতে হয়। যদি পর্যান্ত আবাসিক ব্যবস্থা থাকতো তাহলে ঐ মানসিক প্যারাটা নিতে হতো না। এসব শিক্ষার্থীরা একসময় ফেল করে।


অন্যদিকে শিক্ষকরা  ফেল করার মূল কারণ " শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাস বা পড়াশোনা না করা "হিসেবে দেখছেন। 


শিক্ষার্থীদের কেন অকৃতকার্য হচ্ছেন? কয়েকজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মতামত নিয়েছে দৈনিক জনবাণীর ঢাকা কলেজ প্রতিনিধি আল জুবায়ের।


শিক্ষার্থীদের মতামত: ঢাকা কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী বাহারুল ইসলাম আজাদ  বলেন, শিক্ষার্থীদের ফেইল করার পিছনে বেশ কিছু কারণ আছে,যেমন-আমাদের পর্যান্ত পরিমাণ ক্লাস না হওয়া, শিক্ষক সংকট,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুযায়ী শিক্ষকদের যথাযথ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষকরা পাঠদানে অদক্ষ।এছাড়াও,সাত কলেজের অনেক কলেজে ইন্টারমিডিয়েট আছে, ফলে স্যাররা ওদের দিকে ফোকাস করতে গিয়ে অনার্সের স্টুডেন্টদের কম গুরুত্ব দেয়;স্যাররাও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ব্যস্তানুপাতিক বলতে গেলেই চলে। অনেক সময়,অনার্স-মাস্টার্স পরীক্ষার দিন ক্লাস বন্ধ থাকে, একসময় দেখা যায় শিক্ষকরা সিলেবাস শেষ করতে পারে না।


সোহরাওয়ার্দী কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ওমাইতুল্লা প্রান্ত বলেন,সবচেয়ে বড় যে সমস্যা, ক্লাস ফ্যাসিলিটি,ক্লাস রুম ফাঁকা পাওয়া যায় না, আবার এক টিচার অনেক ক্লাস নেয়, ফলে ক্লাস কোয়ালিটি ভালো হয় না। যার কারণে স্টুডেন্টদের মাঝে ক্লাস করার আগ্রহ কমে যায়। ক্লাসে প্রোপার উপস্থিতি না থাকা ফেল বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ। তাছাড়া ইনফ্রাস্ট্রাকচার সুবিধা নাই, সব কলেজের বিল্ডিং ক্লাসের অনুপযোগী, লাইব্রেরি, রিডিং রুম, সেমিনার নাম মাত্র, অনেকক্ষেত্রে নাই। মোটকথা সুস্থ পরিবেশে পড়াশোনার পরিবেশ নাই। 


 তিনি আরও বলেন,ঢাবির উদাসিনতার একটা বড় কারণ হলো, পরীক্ষার ৮-৯ মাস পরেও যখন ফল প্রকাশ অনিশ্চিত থাকে;তখন একটা স্টুডেন্টের পক্ষে ভালোভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এছাড়াও অনেক ডিপার্টমেন্টে ঠিকঠাক ইনকোর্স পরীক্ষা, টেস্ট পরীক্ষা এগুলো হয় না। ঢাবি থেকেও প্রোপারলি একাডেমিক ক্যালেন্ডার ফলো করা হয় না, সব মিলিয়ে একটা অস্থিতিশীল ব্যবস্থায় চলছে সাত কলেজের প্রশাসনিক কার্যক্রম।


তিতুমীর কলেজের গনিত বিভাগের রায়হান নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ক্লাস নেন একজন শিক্ষক, প্রশ্নপত্র সেট করেন আরেকজন শিক্ষক আবার খাতা মূল্যায়ন করেন অন্যজন।


সত্যি বলতে গেলে, প্রশ্নের মানদন্ড নির্ধারণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চযউ ধারী শিক্ষকগণ। আর ক্লাস নেন শিক্ষা ক্যাডারগণ। 


অভিজ্ঞতার এই যে গ্যাপ টা, আমার মতে এটার একটা সমাধান প্রয়োজন। সেই সাথে প্রশ্নপত্র তৈরির ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাত কলেজের শিক্ষকদের সমন্বয় অতীব জরুরি।এছাড়াও, শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্য সেমিস্টার প্রেজেন্টেশন করা উচিত কিন্তু ঢাবিতে সেটি থাকলেও সাত কলেজে নাই, আধুনিক ল্যাব ক্লাস কোনো কিছুর ব্যবস্থা নাই। পরিশেষে, দেখা যায় শিক্ষার্থীরা কিছু শিখতে পারে না, রেজাল্ট খারাপ করে।


সরকারি বাঙলা কলেজের আরেকজন  শিক্ষার্থী আশিক রহমান বলেন,ক্লাস ও প্র্যাকটিক্যাল নিজেদের কলেজের পক্ষ থেকে হলেও ভাইবা ও প্র্যাকটিক্যাল এর সময় এক্সটার্নাল এসে শিক্ষার্থীদের অবহেলা করা।সিজিপিএ শর্ত থাকায় একজন সব বিষয়ে পাস করলেও দেখা যায় সে ফেল করছে। 


শিক্ষকদের মতামত: শিক্ষার্থীরা কেন ফেইল করছে এমন প্রশ্ন করলে! প্রশ্নের জবাবে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক  মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন,ফেইল করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুব কম ;পাসের হারই বেশি। আর যারা ফেইল করছে তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করতে হবে কেন তারা ফেইল করছে! 


ঢাকা কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জিল্লুর রহমান বলেন,"ক্লাসে অনুপস্থিত" ঠিক ভাবে ক্লাস না করা ফেল করার বড় কারণ হিসেবে মনে করি আমি। তিনি বলেন,একজন শিক্ষার্থী যদি ঠিকভাবে ক্লাস না করে,ইনকোর্স পরীক্ষা ভালভাবে না দেয়, টেস্টে খারাপ করে তাহলে সে অবশ্যই ফাইনাল পরীক্ষায় খারাপ করবে।


তিনি আরও বলেন, যারা ফেল করছে এদের সংখ্যা কিন্তু খুব কম।ক্লাসে অনুপস্থিত,টিউশনি,পার্ট -টাইম জব এসব কারণে পড়াশোনা ঠিকভাবে হয়তো করে না। ফলে,দেখা যায় ফাইনাল পরীক্ষায় গিয়ে ফেল করে।আমি মনে করি,একজন শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাস বা পড়াশোনা  করলে, ইনকোর্স ভাল দিলে ফাইনাল পরীক্ষায়ও ভাল করবে। 


 ঢাকা কলেজের প্রানীবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জাহিদ হাসান "শিক্ষার্থীরা খাতায় সঠিকভাবে সঠিক উত্তর লেখে না "বলেই মূলত ফেল করে বলে মনে করেন তিনি। তিনি আরও বলেন,সাত কলেজ শিক্ষক বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক যেই  খাতা দেখুক না কেন সঠিক মূল্যায়ন করা হয়। অনেক সময় দেখা যায়,শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন না বুঝতে পেরে ভুল উত্তর দেয়। এসব কারণেই শিক্ষার্থীরা অকৃতকার্য হচ্ছে বলে মনে করছেন তিনি।


এই সম্পর্কে জানতে সাত কলেজ সম্বন্বয়ক ও ইডেন কলেজ অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য কে  মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি কল ধরেন নি। 


 প্রসঙ্গত, উচ্চশিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৭ সালে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সরকারি সাতটি কলেজ হল- ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।


তৎকালিন ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ অনুযায়ী তার লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাব। এখন থেকে এই অধিভুক্ত কলেজগুলোর ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি প্রক্রিয়া, পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচালিত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুযায়ী বিদ্যায়তনিক কার্যক্রমও পরিচালনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যেই লক্ষ্যে রাজধানীর সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার কথা বলেছিলেন সেই লক্ষ্য পুরোপুরি ব্যাহত হচ্ছে।


সাত কলেজকে যখন ঢাবির অধিভুক্ত করা হয় তখন শিক্ষার্থীরা উচ্ছ্বসিত ছিলেন। একদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটের অভিশাপ থেকে মুক্তি অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক-স্নাতকোত্তর সনদ ঝুঁলিতে যুক্ত হওয়া। কিন্তু সেই স্বপ্ন যেন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।


আরএক্স/