দেশে ৬৫ শতাংশ তরুণী যৌন হয়রানির শিকার, বাসে বেশি অনিরাপদ


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


দেশে ৬৫ শতাংশ তরুণী যৌন হয়রানির শিকার, বাসে বেশি অনিরাপদ

দেশে মোট তরুণীদের মধ্যে ৬৫ দশমিক ৫৮ শতাংশই যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ৪৫ দশমিক ২৭ শতাংশ তরুণী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। গণপরিবহন হিসেবে সর্বাধিক ব্যবহৃত বাস বা বাসস্ট্যান্ডে যৌন হয়রানির মতো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন ৮৪ দশমিক ১০ শতাংশ তরুণী। পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছেন ২২ দশমিক ২৬ শতাংশ তরুণী।

‘তরুণীদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এবং মানসিক স্বাস্থ্যে এর প্রভাব’ শীর্ষক সমীক্ষা নিয়ে শনিবার (৫ মার্চ) বেলা ১১টায় অনুষ্ঠিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান আঁচল ফাউন্ডেশন। আগামী ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে সারা দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগের ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সি এক হাজার ১৪ জন শিক্ষিত তরুণীদের ওপর এই জরিপ করে সংগঠনটি। জরিপে অংশগ্রহণকারী তরুণীদের ভেতর অবিবাহিত ৮৮ দশমিক ১৭ শতাংশ ও বিবাহিতের সংখ্যা ১০ দশমিক ৯৫ শতাংশ এবং বাকিরা আর সংসার করছেন না।
সংগঠনটি জানিয়েছে, জরিপে অংশগ্রহণকারী তরুণীদের থেকে সাম্প্রতিককালে তারা কতটা বৈষম্য, লাঞ্ছনা, যৌন হয়রানি, সমাজ ও পরিবারে প্রতিবন্ধকতা, নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি বিষয়ের শিকার হয়েছেন ও এ সব বিষয় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কেমন প্রভাব ফেলেছে, তা নিয়ে সমন্বয়করা তথ্যের ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যান উঠে এসেছে।

সংগঠনটির দেওয়া তথ্য মতে, জড়িপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৩৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ তরুণী জানিয়েছেন যে তারা বিকৃত যৌন ইচ্ছার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতের মাধ্যমে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। ২৯.৬২ শতাংশ তরুণীকে আপত্তিকর স্পর্শের ভুক্তভোগী হতে হয়েছে। যৌন হয়রানির মধ্যে আপত্তিকর স্পর্শের শিকার হয় ৬৪ দশমিক ৯২ শতাংশ তরুণী। এমনকি ২০ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ তরুণী কুদৃষ্টি এবং অনুসরণের শিকার হয়েছেন।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, তরুণীরা সবচেয়ে বেশি এ ধরনের নিপীড়নের শিকার হন একাকী চলার সময়ে, যা ৭৫ দশমিক ৬০ শতাংশ। তবে ২১ দশমিক ৫৭ শতাংশ মা, বোন, বান্ধবী বা অন্য নারী সঙ্গী থাকা অবস্থায় এবং ২ দশমিক ৮৩ শতাংশ বাবা, স্বামী, ভাই বা অন্য পুরুষ সঙ্গী থাকা অবস্থায় নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এছাড়া ৪৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ তরুণী অনলাইনে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে অবান্তর ও কুরুচিপূর্ণ মেসেজ পাঠিয়ে এবং মন্তব্য করে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা হয়েছে ৬১ দশমিক ১২ শতাংশকে। সামাজিক যোগযোগমাধ্যমের আইডি হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছেন ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল ছবি নিয়ে দুর্ভোগ পোহান বলে জানিয়েছেন। এ ছাড়াও ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ অযাচিত আইডি স্টাকিংয়ের শিকার হন বলে সমীক্ষায় উঠে আসে।

আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে, দেশের শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র ও বিভিন্ন প্রয়োজনে নারীরা গণপরিবহন ব্যবহার করে থাকেন। তবে সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৪৫ দশমিক ২৭ শতাংশ তরুণী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হন। গণপরিবহন হিসেবে সর্বাধিক ব্যবহৃত বাস বা বাসস্ট্যান্ডে যৌন হয়রানির মতো অভিজ্ঞতার সন্মুখীন হন ৮৪ দশমিক ১০ শতাংশ তরুণী। এছাড়াও রেল বা রেল স্টেশনে ৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ তরুণী যৌন হয়রানির শিকার হন।

আঁচল ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্যানুসারে, ৩৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ তরুণী শৈশবে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন। তার মধ্যে আত্মীয়-স্বজনের দ্বারা ৩৫ দশমিক ২৮ শতাংশ যৌন নিগ্রহমূলক আচরণের শিকার হন। শৈশবে অপরিচিত ব্যক্তিবর্গের দ্বারা ভুক্তভুগী হন ২৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। এ ছাড়াও ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রতিবেশীদের কাছ থেকে এহেন হীন আচরণের শিকার হন। শৈশবের এরূপ ঘটনা ২৮ দশমিক ৪৩ শতাংশের মনে সবার প্রতি অবিশ্বাসের জন্ম দেয় এবং ২৮ দশমিক ১৭ শতাংশের ভেতর পুরুষ বিদ্বেষী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া ১৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ একা থাকতে ভয় পান। সমীক্ষা মতে, ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ নারী উল্লেখিত সব ধরনের ট্রমার ভেতর দিয়ে গেছেন বলে জানা যায়।

জরিপে অংশ নেওয়াদের মধ্যে তরুণীরা মতামতের ক্ষেত্রে তার পরিবারে গুরুত্ব পায় কি না, সেই প্রশ্নের নেতিবাচক উত্তর দেন অংশগ্রহণকারীদের ২২ দশমিক ২৯ শতাংশ। শুধু নারী হওয়ার দরুণ মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হতে হয় ৪৬ দশমিক ২৫ শতাংশকে।

সমীক্ষার ফলাফলে জানা যায়, পারিবারিক টানাপোড়েন তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সর্বাধিক প্রভাব ফেলে, যা ৩১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। আর্থিক অস্বচ্ছলতা অংশগ্রহণকারীদের ২৪ দশমিক ৪৬ শতাংশের মনে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। বেকারত্বের কারণে ১৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ মানসিকভাবে বিপর্যস্ততার শিকার হন। ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্নতার মাধ্যমে ও ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ তরুণী যৌন নিপীড়নের কারণে মানসিকভাবে প্রভাবিত হন। পারিবারিক টানাপোড়েনের পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, পারিবারিক অস্বচ্ছলতা ৩০ দশমিক ৭২ শতাংশ তরুণীদের মনে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। পারিবারিক কলহ ২৭ দশমিক ৩২ শতাংশের মনে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। সেই সাথে পরিবার থেকে অযাচিত চাপের কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ততার শিকার হয়েছেন ২৩ দশমিক ৯২ শতাংশ নারী।

আঁচল ফাউন্ডেশন আরও জানায়, ৬৯ দশমিক ৯২ শতাংশ তরুণী শারীরিক অবয়ব নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৭ দশমিক ২৪ শতাংশ তরুণী জানিয়েছেন, তাদের শরীরের আকৃতি ,গঠন এবং অবয়ব নিয়ে নিজেদের আত্মীয়রাই কথায় ও ইঙ্গিতে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। বন্ধুবান্ধবের কাছে বডি শেমিংয়ের শিকার হয়েছেন ২২ শতাংশ। এমনকি পরিবার থেকে এ ধরনের মন্তব্য শুনেছেন বলে জানিয়েছেন ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। পথচারীর মাধ্যমে শারীরিক অবয়ব নিয়ে নেতিবাচক কথা শুনতে হয়েছে ১১ দশমিক ৮৫ শতাংশ তরুণীর।

কারণ খুঁজতে গিয়ে আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণায় এসেছে, ওজনের কারণে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হতে হয় বলে ৩৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ তরুণী মনে করেন। গায়ের রঙের কারণেও ৩৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ তরুণী এ ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান। এছাড়াও উচ্চতা, মুখাবয়বের গঠন ও দাগ, কণ্ঠস্বর প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তরুণীরা বিরূপ মন্তব্য শুনে থাকেন বলে জানিয়েছেন।

আঁচল ফাউন্ডেশন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক, ড. কাবেরী গায়েন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহীন মোল্লা, সিটি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের সহকারী পুলিশ কমিশনার সুরঞ্জনা সাহা, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, মিডিয়া কম্যুনিকেশনের সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর শাহানা হুদা রঞ্জনা এবং আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ।

নারী ক্ষমতায়নের যুগে নারীদের এহেন আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপট নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কাজী সাইফুদ্দিন এর মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘সমাজের একটি অংশ হিসেবে নারীদের যতটুকু সন্মান বা মর্যাদা পাওয়া উচিত সেটা আধুনিক সময়ে এসেও আমাদের সমাজে এখনো নেই। ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন ছাড়া এ অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়। এজন্য প্রতিটি স্তরের নারীদের এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে এখন যারা বড় বড় অবস্থানে আছেন তাদের উচিত এ বিষয়ে অনুজদের যথাযথ জ্ঞান দেওয়া। সমাজের প্রতিটি শিক্ষিত মানুষকে বুঝতে হবে যে সমাজকে ছেলে মেয়ে সবার জন্য সমানভাবে নিরাপদ জায়গা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে যেনো মেয়েরা একা বের হতে ভয় না পায়।’

নারীদের এই আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিষয়ে সিটি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের সহকারী পুলিশ কমিশনার সুরঞ্জনা সাহা বলেন, ‘বাংলাদেশে ইন্টারনেট তথা ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি আস্থার প্রতীক হলেও সামাজিক অশুভ প্রয়োগ ও ব্যক্তিগত দায়িত্বহীনতার দরুণ অনেক নারীর কাছে তা এক আতংকের নাম। আমাদের সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে সাইবার জগতকে নারীদের জন্য নিরাপদ রাখা জরুরি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার বিধি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান, ব্যক্তিগত সচেতনতা ও পারিবারিক শিক্ষাই পারে সাইবার দুনিয়াকে সুরক্ষিত রাখতে।’

নারীদের নিয়ে করা এই বিশেষ জরিপ থেকে প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে বলতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন উল্লেখ করেন, ‘নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে, সচেতনতার পাশাপাশি তাদের পর্যাপ্ত মানসিক সমর্থন করতে হবে এবং বুঝাতে হবে যে জীবন এতো মূল্যহীন নয়। আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এর পাশাপাশি পারিবারিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। সেই সাথে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও সকলকে সচেতন করতে হবে। সর্বোপরি নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে নিয় বরং মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।’

নারীদের নিয়ে করা এ বিশেষ সমীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রজেক্ট লিড মোঃ রিফাত হাসান তরফদার বলেন, ‘নারীর অধিকার নিয়ে আমরা আজ কথা বলতে শুরু করেছি কিন্তু এই নারীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত করতে পারছি আমরা? রাস্তায়, গণপরিবহনে, এমনকি উন্মুক্ত স্থানেও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে অহরহ। পরিবারের মাঝেও নিরাপদ নয় নারী। নারীদের বিচরণের প্রতিটি মাধ্যম হতে হবে স্বচ্ছ ও নিরাপদ। তবেই আমরা নারী জাগরণ, নারী মুক্তি নিয়ে কথা বলতে পারবো। তা নাহলে এই ব্যর্থতা,আমাদের পরিবারের, আমাদের সমাজের, আমাদের সকলের।’

ওআ/