প্রবীণ কল্যাণ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা


Janobani

জেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৩:৪০ অপরাহ্ন, ৩০শে সেপ্টেম্বর ২০২৩


প্রবীণ কল্যাণ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা
সাইফুল ইসলাম চৌধুরী

মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন , চিকিৎসা পদ্ধতির আধুনিকায়ন এবং গড়-আয়ু বৃদ্ধির ফলে দেশে দেশে বাড়ছে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। বাংলাদেশেও প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ - এর প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার। যা মোট জনসংখ্যার ৯.২৮ শতাংশ।


ইউনিসেফ এর তথ্যমতে আগামী ২০-২৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে অন্যান্য বয়সী জনগোষ্ঠীর তুলনায় প্রবীণ ব্যক্তির সংখ্যাই হবে সবচেয়ে বেশি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রবীণদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এমন দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ২য় অবস্থানে রয়েছে। ২০৫০ সালে বাংলাদেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৪ কোটি। হেল্পএজ ইন্টারন্যাশনাল এর মতে বিশ্বে বর্তমানে প্রতি ১০ জনে  ০১ জন ৬০ উর্দ্ধ প্রবীণ ব্যক্তি রয়েছেন। ২০৫০ সালে বেড়ে প্রতি ০৫ জনে ০১ জন হবে।


বিশ্বে ৮০ উর্দ্ধ বয়স্ক ব্যক্তির বৃদ্ধির হার  ৪ শতাংশ। মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ০১ শতাংশ। ২০৫০ সালে বিশ্বে ১০০ উর্দ্ধ বয়স্ক ব্যক্তির সংখ্যা দাঁড়াবে ৩.৫ মিলিয়ন। এদের ৫০ শতাংশের বাস হবে এশিয়ায় এবং বিশ্বে সকল প্রবীণদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা হবে বেশি। প্রবীণদের মধ্যে ১৮০ মিলিয়নের অধিক সংখ্যক প্রবীণ দারিদ্রসীমার মধ্যে বাস করেন।  ২০৪৫ সালে ৬০ উর্দ্ধ বয়সী ব্যক্তির সংখ্যা ০-১৪ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যাকে অতিক্রম করবে। ইতোমধ্যে ০-১৪ বছর বয়স শ্রেণির প্রবৃদ্ধি  চরমে পৌঁছে নিম্নমুখি হয়েছে এশিয়ায়, ল্যাটিন আমেরিকায় ও ক্যারিবিয় অঞ্চলে , ইউরোপ, আমেরিকায় । নিম্ন-আয়ের দেশসমূহে ৫০ শতাংশেরও বেশি ৬০ উর্দ্ধ পুরুষ-মহিলা কর্মে নিয়োজিত থাকেন। আফ্রিকা মহাদেশের অধিকাংশ দেশে মোট এইচ আইভি আক্রান্তদের ৪০ শতাংশের বেশি প্রবীণ ব্যক্তি।


জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন অভিষ্টে সববয়সী সবমানুষের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার কথা রয়েছে। জীবনব্যাপী শিক্ষা, দীর্ঘমেয়াদে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি, আন্তঃপ্রজন্ম সহযোগিতা, মর্যাদা ও শ্রদ্ধাবোধ জরুরি। প্রবীণ জনগোষ্ঠী জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভান্ডার। তাঁরা সমাজের বোঝা না হয়ে হতে পারেন সম্পদ। এই সচেতনতাবোধ আজকের তরুণদের মনে জাগ্রত করা গেলে বিশেষ ক্ষেত্র ব্যতিত বৃদ্ধ-নিবাস বা প্রবীণ-নিবাস এর মত জায়গায় প্রবীণগণ আত্মীয়-পরিজনহীন, নিঃসঙ্গ অবস্থায় দুর্বিসহ জীবন যাপন না করে নিজ পরিবারেই সম্মানের সাথে অবস্থান করতে পারবেন।


প্রবীণদের একটি অংশ পরিবারহীন থাকা অসম্ভব নয়। নানা কারণে যেমন: প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আত্মীয়-বিয়োগ, সন্তান-সন্ততি না থাকা, ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোন প্রবীণ একাকী, আত্মীয় স্বজনহীন অবস্থায় থাকলে তার দায়িত্ব রাস্ট্র, সমাজ বা বিত্তবান ব্যক্তিগণ সমন্বিতভাবে নিলে প্রবীণদের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।


প্রবীণ ব্যক্তিদের মাধ্যমেই আমরা পেয়েছি উন্নত, সমৃদ্ধ বর্তমান। বর্তমানে যারা তরুণ,যুবক আগামীতে তারা হবেন প্রবীণ। আজ যদি প্রবীণগণ তরুণদের শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালোবাসায় সিক্ত হন তাহলে আগামী দিনের প্রবীণরাও উপযুক্ত সম্মানের ভাগীদার হতে পারবেন।


বর্তমান সময়ে মানুষের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিজিটাল প্লাটফর্ম- সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন সংবাদপত্র, ইউটিউব ইত্যাদি। ইন্টারনেটের মাধ্যমে এসকল আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের এক উল্লেখযোগ্য সময় দখল করে আছে। এক্ষেত্রে প্রবীণ জনগোষ্ঠী আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। তবে তাঁদেরকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও সুযোগ দেয়া হলে তাঁরা এর সুফল ভোগ করতে পারেন। আজকাল অনেক প্রবীণ ব্যক্তি বিদেশে থাকা তাঁদের আত্মীয়-সন্তানদের সাথে ইন্টারনেটে ভিডিও কলের মাধ্যমে কথা বলেন, ভাব-বিনিময় করে থাকেন। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পেলে প্রবীণদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষমতা অর্জন করতে পারেন।


প্রবীণদের প্রতি মনোযোগ দিতে এবং তাঁদের পুনর্বাসনের বিষয়টি তুলে ধরতে জাতিসংঘ  ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হিসাবে ঘোষণা করেছেন। প্রতি বছর সারা বিশ্বে এই দিনটি আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। এ বছর ১ অক্টোবর ৩৩ তম আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হিসাবে পালিত  হচ্ছে।


প্রবীণদের কল্যাণে বাংলাদেশ সরকারের রয়েছে অনেক উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি। এর মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সারাদেশে ৫৮ লাখ প্রবীণ ব্যক্তিকে মাসিক ৬০০ টাকা হারে বয়স্ক ভাতা দেয়া হচ্ছে। যার সুফল প্রান্তিক পর্যায়ের দরিদ্র প্রবীণ ব্যক্তিগণ পাচ্ছেন। ২৫ লাখ ৭৫ হাজার জন বিধবা মহিলাকে মাসিক ৫৫০ টাকা হারে দেয়া হচ্ছে বিধবা ভাতা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ রয়েছেন প্রবীণ। তাছাড়া সাশ্রয়ী মূল্যে চাউল সরবরাহ, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য রয়েছে বিশেষ বয়স্ক ভাতা। প্রতিটি সরকারি শিশু পরিবারে প্রবীণ ব্যক্তিদের জন্য রয়েছে ১০টি করে আসন। প্রবীণদের জন্য নির্মিত হচ্ছে শান্তিনিবাস। অধুনা দেশে সরকারি-অসরকারি পর্যায়ে গড়ে উঠছে প্রবীণ নিবাস । এতসব সত্বেও বর্তমান ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যার প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক, সামাজিক, স্বাস্থ্যগত, মনোসামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে একটি অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে শুধু সরকারি সহায়তা পর্যাপ্ত হবেনা; তার জন্য দরকার সমন্বিত ও উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে বেসরকারি উদ্যোগকে সম্পৃক্ত করে সেই অনুসারে কাযক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।