কালীগঞ্জে দোলনা তৈরি করে স্বচ্ছলতার ছোঁয়া


Janobani

উপজেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৩:৫৮ অপরাহ্ন, ১লা নভেম্বর ২০২৩


কালীগঞ্জে দোলনা তৈরি করে স্বচ্ছলতার ছোঁয়া
কারিগররা তৈরি করছেন দোলনা। ছবি: সংগৃহীত

বহু প্রাচীনকাল থেকেই শিশুদের জন্য দোলনার ব্যবহার। তাই দোলনা বাচ্চাদের খুবই প্রিয়। সুতা, কাঠি ও রং দিয়ে নিপুণ হাতে বানানো হয় দোলনা। দোলনায় থাকে বাহারি রঙের সুতার নিপুন কারুকাজ।


নবজাতক ৩-৬ মাস বয়সী শিশুকে হাসিখুশি রাখতে মা-বাবাকে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হয়। কখনও ঝুনঝুনি বাজিয়ে, লাল-নীল ফুল বা কোন আকর্ষণীয় বস্তু প্রদর্শন করতে হয়। কিংবা কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করে শিশুকে আগলে রাখতে হয়। এতেও যদি ছোট্র শিশুটি আনন্দবোধ না করে তবে তাকে দোলনায় তুলে দোলানো হয়। এ জন্য প্রয়োজন সেই নিপুণ হাতে বানানো দোলনার।


গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের বাগদী, বিরতুল গ্রামে বহুকাল হতে আব্দুর রহিম ও তার স্ত্রী জাহানারা, রাজিয়া, হোসনেয়ারা, আইয়ুব খান ও তার স্ত্রী নিলুফাসহ আরোও অনেক অসচ্ছল পরিবার দোলনা বানানো ও বিক্রির পেশাকে বেছে নিয়েছেন। দোলনা তৈরি করে বিক্রি করাই তাদের বেচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। তারা বলেন দোলনা তৈরির আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে।


বাগদী গ্রামের জাহানারা (৩৫) প্রতিবেদককে জানান,তিনি দোলনা তৈরি করা একমাত্র পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। দোলনা তৈরির কারিগর হোসনেয়ারা বেগম জানালেন, পুরো দোলনাটি তৈরি হয় কয়েকটি ধাপে এবং কয়েকজন কারিগরের মাধ্যমে। যেমন, একজন কেবল বাঁশের চাক বা চাঁকা তৈরি করেন।


প্রতিটি বাঁশের চাকা তৈরির মজুরি ৩ থেকে ৪ টাকা। আবার একজন শুধু সেই বাঁশের চাকায় সুতা প্যাঁচান। প্রতিটি বাঁশের চাকায় সুতা পেঁচানোর মজুরি ৫ থেকে ৬ টাকা। আবার একজন কেবল দোলনা ঝুলিয়ে রাখার দড়ি বা চেইন তৈরি করেন। চেইন তৈরির মজুরি প্রতিটির জন্য ২ থেকে ৩ টাকা। তবে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন যিনি পুরো দোলনাটি বুনেন। তিনি তার নিজ বাড়িতে পারিশ্রমিকের মাধ্যমে নারীদের দিয়ে দোলনা বানিয়ে থাকেন। দোলনা বানানো শেষ হলেই পাইকাররা চলে আসেন বাড়ি বাড়ি। দোলনা তৈরি করার কারিগর রাজিয়া(৪০) ও হোসনেয়ারা(৩০) প্রতিবেদককে জানান, দোলনায় থাকে সুতোর নানা রঙের কারুকাজ। সুতোকে রং দিয়ে করা হয় আকর্ষণীয়। মেয়েদের চুলের বেণীর মতো করে দোলনা তৈরির সুতোগুলোকেও বেনি করা হয়। এরপর বাঁশের চটির সঙ্গে সুতো বেঁধে তৈরি করা হয় দোলনা।


দোলনা তৈরি করার আরেক কারিগর ও পাইকারী ক্রেতা আইয়ুব খান প্রতিবেদককে জানান, আমি আমার পরিবার মিলে বিভিন্ন সাইজের দোলনা তৈরি করে থাকি।তিনি অত্র এলাকা থেকে বাড়ী বাড়ী হেটে ক্রয় করি। পরবর্তীতে দেশের বগুড়া, নওগা, রাজশাহী, পাবনা, নেত্রকোনা, রংপুর ও চট্রগ্রামসহ রাজধানীর পাইকারদের কাছে বিক্রি করে থাকি। তিনি আরোও বলেন, অনেক পাইকার দোলনা তৈরির অর্ডারও দিলে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে সরবরাহ করে থাকি।


সরেজমিনে দোলনার গ্রাম কালীগঞ্জের বিরতুল, বাগদী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়,কেউ বাড়ির বারান্দায়, কেউবা গাছের ছায়ায় বসে দোলনা তৈরির কাজ করছে। এসকল গ্রামে বাঁশের কাইম ও সুতায় তৈরি হচ্ছে এ রফতানীযোগ্য পণ্য।


এসব পণ্য ছাত্রছাত্রী ও গৃহবধুরা উৎপাদন করে বাড়তি উপার্জন করতেছে। কিন্তু একাজ করে তারা কেউ ভাল নেই। বাগদী গ্রামের জাহানারা বলেন, তারা মাঝারী সাইজের দিনে গড়ে ৬টি দোলনা বানাতে পারে। সাইজ বেধে একেকটি দোলনার দাম ১৮০ থেকে ২শ ৮০ টাকা পর্যন্ত। অনেকেই অবসর সময়ে দোলনার তৈরির কাজ করে থাকে। গৃহবধূ হোসনেয়ারা, রাজিয়া, জাহানারারা বসে নেই। কাজের অবসরে তারা দোলনা তৈরি করে বাড়তি আয় করে থাকেন।


তাদের সকলের একটাই কথা এত পরিশ্রম করেও স্বাবলম্বী হতে পারিনি। তবে এ এলাকার অনেকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ পেশার সাথে জরিত। বাঁশ ও সুতার তৈরি রফতানীযোগ্য পণ্য গ্রামের বেকার অসহায় পুরুষ ও মহিলারা মনে আশার সঞ্চার করেছে।


এ কুটির শিল্প ছড়িয়ে পড়েছে বাইরের অন্য গ্রাম গুলিতে। কুটির শিল্প হলো কাইম ও সুতার তৈরি বিভিন্ন ডিজাইনের দোলনা। অল্প সময়ের মধ্যে কয়েক’শ মানুষ এ কুটির শিল্পের দক্ষ শ্রমিকে পরিণত হয়েছে। তারা জানান, কাজ শিখে এখন পুরো গ্রামে ৩শ’ পরিবারের বেশি লোক এ শিল্পের সাথে জড়িত হওয়ার কারণে দিন দিন এ শিল্পের প্রসার ঘটছে। দোলনা তৈরির কাজ করে এমন শ্রমিকরা জানান, দোলনা তেরি করা হয় কয়েকটি মাপে। এগুলো প্রতিটি খুচরা বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। তবে পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হয় প্রতিটি ১৮০ থেকে ২০০ টাকা।


এ সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে চাইলে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোঃ আজিজুর রহমান প্রতিবেদককে জানান, গ্রামীন কুটির শিল্প বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারী ভাবে প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা রয়েছে। তারা আবেদন করলে কম সুদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তিনি আরোও জানান,ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা আবেদন করলে ঋণের জন্য আমি তাদের সাধ্যমত সহযোগীতা করব।


আরএক্স/