ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শিক্ষার্থীদের ভাবনা, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
ক্যাম্পাস প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৭:০১ অপরাহ্ন, ২০শে নভেম্বর ২০২৩
আল জুবায়ের: ৫২ ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সব নৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া জাতির আলোকবর্তিকা, জাতির পিতার "বঙ্গবন্ধু" নামটি যেখান থেকে সর্বপ্রথম দেওয়া হয় সেই ঢাকা কলেজের ১৮২ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সোমবার (২০ নভেম্বর)।
বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ের সঙ্গে এই ক্যাম্পাস জড়িত। আজকের যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তা ঢাকা কলেজের ত্যাগের ফসল।
তবে অর্জনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আক্ষেপও কম নেই এই কলেজের প্রতি। প্রতিষ্ঠার ১৮২ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো পূর্ণাঙ্গ আবাসিক সুবিধা তো দূরের কথা তেমন কোনো আবাসিক সুবিধা পায় নি শিক্ষার্থীরা, শিক্ষা ও গবেষণার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে সবসময়।এরপরও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে কি ভাবছেন বর্তমান শিক্ষার্থীরা জানার চেষ্টা করেছে জনবাণীর ঢাকা কলেজ প্রতিনিধি আল জুবায়ের।
ভাষা আন্দোলন, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ সহ বিভিন্ন সময়ে জাতির ক্রান্তিকালে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যখন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে তখন ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী প্রথম দলের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী ছিলেন ঢাকা কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থী ইকবাল আনসারী খান। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন।মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাত বরণ করা ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্যতম হলেন নজিম উদ্দিন খান খুররম। পরবর্তীতে এই সূর্য-সন্তানের নামে ঢাকা কলেজ অডিটোরিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে 'বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবু নঈম মুহাম্মদ নজিম উদ্দিন খান খুররম অডিটোরিয়াম'।
বিভিন্ন অঙ্গনে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের অবদান অনস্বীকার্য। বুদ্ধদেব বসু, হুমায়ুন আজাদ, আবদুর রাজ্জাক (অধ্যাপক), আবদুল গাফফার চৌধুরী, হুমায়ূন আহমেদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেন, শেখ কামাল, শেখ জামাল, আব্দুর রউফ (কমান্ডার), আব্দুর রাজ্জাক (রাজনীতিবিদ), আব্দুল করিম (মৃত্তিকা বিজ্ঞানী), আব্দুল মতিন চৌধুরী (পদার্থবিদ), মোহাম্মদ ইব্রাহিম (বিচারপতি), জাফরুল্লাহ চৌধুরী, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, নওয়াব আলী, মহাদেব সাহা, আসলাম তালুকদার মান্না (অভিনেতা) সহ অসংখ্য বরেণ্য ব্যক্তিদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজ যাদের সকলের নাম লিখতে গেলে লেখার কলেবর অনেক বেশি হয়ে যাবে।
বর্তমানে ঢাকা কলেজে প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছেন। বিশেষ করে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার ঢাকা কলেজ। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কলেজ গুলোর মধ্যেও অন্যতম এই প্রতিষ্ঠান। প্রতিনিয়ত ঢাকা কলেজের গ্রন্থাগার এবং বিভিন্ন পাঠ কক্ষে জ্ঞানপিপাসু শিক্ষার্থীদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ১৮২ বছর যাবৎ এই অঞ্চলের শিক্ষাক্ষেত্রে তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে ঢাকা কলেজ। তবে এখনো বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় এবং উদ্বেগজনক। পরীক্ষা চলাকালীন পর্যাপ্ত একাডেমিক ভবনের সংকট থাকায় কলেজের নিজস্ব একাডেমিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। গবেষণা কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণাগার এবং বিভিন্ন উপকরণের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। গ্রন্থাগার এবং পাঠকক্ষ সমূহে শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ আসনের ব্যবস্থা নেই। এছাড়া ছাত্রাবাস গুলোতেও বিভিন্ন সংকট বিদ্যমান। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত শিক্ষার্থীদের ছাত্রাবাসগুলোতে পর্যাপ্ত সিট না থাকার কারণে ক্যাম্পাসের বাইরে অধিক অর্থ ব্যয় করে অবস্থান করতে হয়।
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের স্থায়ী অফিস কক্ষের ব্যবস্থা হয়নি এখনো। কিছু কিছু সংগঠনের অফিস কক্ষ থাকলেও সেখানে ব্যাপক সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়।বাংলাদেশের গৌরব ও ঐতিহ্যের প্রতীক ঢাকা কলেজের এ সকল সমস্যা সমাধানে যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
পরিশেষে, ঢাকা কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ২০ নভেম্বরকে বাংলাদেশের জন্য জাতীয়ভাবে 'উচ্চ শিক্ষা দিবস' হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানাচ্ছি।
মো. শাহাদাত হোসাইন
সাধারণ সম্পাদক
ঢাকা কলেজ ডিবেটিং সোসাইটি।
উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তির কথা চিন্তা করলে অধিকাংশ অভিভাবকবৃন্দই মনে করেন , ঢাকা কলেজ রাজনৈতিকভাবে একটি অস্থিতিশীল জায়গা । সেখানে পড়ালেখা হয়না । সিনিয়ররা সেখানে মিছিল করতে বাধ্য করেন , মিটিং করতে বাধ্য করেন , ছাত্রাবাসে থাকতে হলে রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করা হয় । বাস্তবিক অর্থে এই সবগুলো ধারনাই ভুল । ঢাকা কলেজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান । সেখানে সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক কার্যক্রম চলে , মিছিল হয় , মিটিং হয় ; তবে কোনো শিক্ষার্থীকেই সেই কার্যক্রমে অংশগ্রহণে বাধ্য করা হয়না । আমি শহীদ শেখ কামাল ছাত্রাবাসে থাকাকালীন সময়ে দেখেছি , কোনো উত্তপ্তময় পরিস্থিতি তৈরি হলেও শিক্ষকদের পাশাপাশি সিনিয়ররাও সর্বপ্রথম উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন । আমার দেখা সবচেয়ে সেরা মানের শিক্ষকেরা ঢাকা কলেজে ক্লাস নেন । একজন মানুষ তখনই প্রকৃত শিক্ষক হয়ে ওঠেন , যখন তারা পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি বাস্তবিক শিক্ষাও দিয়ে থাকেন । আজ চার বছর হয়ে গেছে আমি উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেছি । অথচ অসংখ্য শিক্ষক আছেন , যাদের সাথে আমার এখনো যোগাযোগ হয় । কথা হয় । এই চার বছরেও শিক্ষকদের সেই ভালোবাসা বিন্দু পরিমাণ কমেনি , বরং বেড়েছে । আমি দেখেছি , আমার অনেক বন্ধুর বই কেনা থেকে শুরু করে ফর্ম ফিলাপ , এমনকি মাসিক খরচও অনেক শিক্ষক বহন করেছেন । বাবা-মায়ের মতো আগলে রেখেছেন তারা । কৃতজ্ঞতা জানাই তাদের প্রতি ।
উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের একজন শিক্ষার্থীকে বাস্তবিক এবং পরিণত পৃথিবীর সাথে পরিচিত হতে হয় । বহুমত সম্পর্কে জানা , ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা , বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়া ইত্যাদি । ঢাকা কলেজের একজন শিক্ষার্থী খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এমন বাস্তবিক পরিবেশের সাথে পরিচিত ও পরিণত হয়ে ওঠার সুযোগ পায় । প্রতিটি অঞ্চলের একেকজন মেধাবী তরুণ এসে ঢাকা কলেজকে এক টুকরো বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করে থাকে । এই কলেজ থেকে শুরু হওয়া বন্ধুগুলো একেকজন গৌরব !
আমি মাঝে মাঝেই ছুটি হলে কলেজের সামনে দাঁড়াতাম । অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতাম , এরাই বাংলাদেশের আগামী প্রজন্ম ! দেশকে নেতৃত্ব দেবে এমন অসংখ্য ছেলেরা এই পথ দিয়েই হেঁটে বের হয় !
ঢাকা কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আমার কাছে বরাবরই আবেগের ! আমি যখন স্কুলে পড়তাম , তখন থেকেই এই ঐতিহ্যবাহী কলেজের সমৃদ্ধশালী ইতিহাসের একটা ছোট্ট অংশ হতে পারার স্বপ্ন দেখতাম । আমি মনে করি , এই এক জীবনে ঢাকা কলেজের ইতিহাসের অংশ হতে পারাটা একটা সৌন্দর্য !
মো. খশরু আহসান
উচ্চমাধ্যমিক ব্যাচ'২০ , ঢাকা কলেজ এবং ঢাকা কলেজ ডিবেটিং সোসাইটির সাবেক যুগ্ম - সাধারণ সম্পাদক ।
২০ নভেম্বর উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ ঢাকা কলেজের জন্মদিন। এ দিবস উপলক্ষ্যে ঢাকা কলেজ প্রশাসনের আবেগ কতটুকু এখনো জানিনা কিন্তু নতুন শিক্ষার্থীদের আবেগ বেশ কিছুদিন আগে থেকেই শুরু হয়েছে। কয়েকজন ব্যক্তিগত কর্মস্থলের পত্রিকা এবং পোর্টালের জন্য লেখা চেয়েছে। পরিক্ষার চলমান থাকায় সেভাবে লেখা হয়ে ওঠেনি দীর্ঘ কয়েক বছর কমবেশি ঢাকা কলেজ নিয়ে লিখছি। কয়েক বছর আগের ক্যাম্পাস যেমন ছিলো সামান্য পরিবর্তন ছাড়া এখনো ঠিক তেমনই আছে। ক্লাসরুম এবং সহ শিক্ষা কার্যক্রমের বিভিন্ন উপকরণের তীব্র সংকট থাকার পরেও হরহামেশাই দেশের অন্যতম আধুনিক বিদ্যাপীঠ হিসেবে বেশ ঢোল পেটানো হয়েছে। কিন্তু সংকটের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় কেমন যেনো আবেগ শুকিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের অনেক বড় বড় কর্মকর্তা ঢাকা কলেজের স্মৃতি নিয়ে মাঝেমধ্যেই আবেগঘন লেখা লিখে। আগে এসব দেখে অনেক ভালো লাগতো। কিন্তু এখন কেমন যেনো ইতস্তত বোধ করি। অনেক শুক্রবারেই ঢাকা কলেজের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দেশের বড় বড় সরকারি আমলা এবং ব্যবসায়ীদের অডিটোরিয়ামে নাচগান করতে দেখি। ফেসবুক স্ক্রোল করলে মাঝেমধ্যেই দেখি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ঢাকা কলেজের বিশাল আয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ঢাকা কলেজ নিয়ে আয়োজন! কানাডার টরেন্টো তে ঢাকা কলেজ কেন্দ্র করে আয়োজন। গতবছর দেখলাম, নরসিংদীর কোনো এক রিসোর্টে অস্থায়ীভাবে প্রায় আস্ত একটি ঢাকা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু ঐ মানুষ গুলো ঢাকা কলেজের সংকটের কোনো তথ্য সেভাবে রাখে না। অধিকাংশই শুধু ফল ভোগের সময় এসে হাজির হয়। ভোগ করে চলে যায়।
যতটুকু বুঝি, যে বা যারাই নিজেদের কিছুটা মেলে ধরেছে বা ধরার চেষ্টা করেছে। তাদের প্রত্যেকের জীবনেই অ্যাকাডেমিক শিক্ষার চেয়েও সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলোর অবদান অনেক বেশি। কিন্তু পজিশন পেয়ে গেলে কেউ সেভাবে এসব প্রকাশ বা স্বীকার করে না। প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর বিকাশে যে পরিমাণ সুযোগ সুবিধা প্রয়োজন, বর্তমান ঢাকা কলেজে তা নেই। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ঐতিহ্য বজায় রেখে এগিয়ে যাক ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীণ বিদ্যাপীঠ।
আব্দুর রহমান
সভাপতি,ঢাকা কলেজ ডিবেটিং সোসাইটি।