মুরাদনগরের স্বাদের শিদলের কদর দেশজুড়ে মূল্য ঠেকেছে নাগালের বাইরে


Janobani

উপজেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৭:৪৪ অপরাহ্ন, ২৪শে নভেম্বর ২০২৩


মুরাদনগরের স্বাদের শিদলের কদর দেশজুড়ে মূল্য ঠেকেছে নাগালের বাইরে
জেলার মুরাদনগর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী রামচন্দ্রপুর বাজার থেকে ছবিটি তোলা ।

বাঙালিয়ানা খাদ্যের তালিকায় রকমারি শুঁটকির স্বাদ বরাবরই মুখরোচক খাবারের শীর্ষে। এলাকাভেদে শুঁটকি রান্না ও প্রক্রিয়াজাত করার ধরণেও লক্ষণীয় ভিন্নতা। এই ভিন্নতা শুঁটকির স্বাদে আনে বৈচিত্র্য। এরকমই এক ভিন্ন স্বাদের শুঁটকি হলো পুঁটি শিদল। পান্তা ভাতের সাথে শিদল শুঁটকির ভর্তার কোন জুড়ি নেই। প্রক্রিয়াজাতকরণের ভিন্নতার কারণে অন্য সাধারণ শুঁটকির চেয়ে স্বাদেও এটি হয়ে ওঠে ভিন্ন।


শিদল তৈরি ও ব্যবসার সঙ্গে দীর্ঘ ৮০ বছর জড়িয়ে আছে কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের মানুষ। স্বাদের শিদল কুমিল্লার নিমসার বাজার হয়ে চট্টগ্রামসহ দেশ-বিদেশে যাচ্ছে বিভিন্ন হাত ঘুরে। পারিবারিক ঐতিহ্য রেখে আজও কিছু মানুষ শিদলকে ঘিরে নিজের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করলেও অধিকাংশই অন্য পেশায় মন দিচ্ছেন। তাদের অভিযোগ আগে যে পরিমান মাছ পাওয়া যেত তাতে শিদল শুঁটকি তৈরিতে খরচ কম হতো। ফলে শুঁটকির দাম ছিল কম। এখন মাছ আনতে হচ্ছে অন্য জেলা থেকে এবং যে প্রক্রিয়ায় শিদল তৈরি করা হয় তার খরচও বেড়েছে কয়েক গুন। ফলে আগে যে শিদল বিক্রি হতো ৭০-৮০ টাকা কেজি, এখন এই শিদল কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪০০-৫০০ টাকা। যার ফলে চড়া মূল্য হওয়ায় স্বাদের শিদল এখন অনেকেরই সাধ্যের বাহিরে।


ব্যবসায়ী বিমল বলেন, এক সময় বর্ষা মৌসুমে এ এলাকায় প্রচুর পুঁটি মাছ পাওয়া যেত। স্থানীয় লোকজনের চাহিদা পূরণ শেষে অতিরিক্ত মাছগুলো পঁচে নষ্ট হতো। এ পঁচে যাওয়া মাছগুলোকেই রোদে শুকিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয় শিদল।


ওই ব্যবসায়ী আরো জানান, তার পরিবারে তার দাদা রমেশ প্রথম এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হন। পঁচে নষ্ট হওয়া পুঁটি মাছ রোদে শুকিয়ে নিতেন তিনি।  সেই সঙ্গে মাটির হাঁড়ির ভেতরটা পুটি মাছের পেটের অংশ থেকে বানানো তেল মাখিয়ে সেখানে শুকনো মাছগুলো রাখতেন। এরপর সেই হাড়িভরা শুকানো মাছ দুই মাসের মতো ঢেকে রেখে দিলে শুকনো পুঁটিগুলো যে অবস্থায় পাওয়া যায়, সেটিই শিদল। দাদা মারা যাওয়ার পর বাবা রঞ্জিত শিদলের ব্যবসা ধরে রাখেন। বিমলের বয়স যখন ১৩ তখন তার বাবা রঞ্জিত মারা যান। সংসারের বড় ছেলে তাই হাল ধরতে বাবার ব্যবসায় হাত লাগায় সে। তবে বিমলের তিন ছেলে মেয়েকেই লেখা-পড়া করছে, তাদেরকে এই ব্যবসায় আনতে চায় না সে। বড় ছেলে মাখন কলেজে পড়ে। পড়া লেখা শেষে বিসিএস দিয়ে সরকারী চাকুরি করবে এই প্রত্যাশা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে সে।


তিনি আরো জানান, আগে প্রতি কেজি শিদল তৈরি করতে খরচ হতো ৫০-৬০টাকা আর বিক্রি হতো ৭০-৮০ টাকা। আর এখন এই শিদলই তৈরিতে খরচ বেড়েছে প্রতি কেজিতে ২০০-৩০০ টাকা। আর বিক্রি হচ্ছে ৪০০-৫০০ টাকা কেজিতে।


রামচন্দ্রপুর গ্রামের বাসিন্দা জজ মিয়া, কবির হোসেন ও জামাল মিয়া বলেন, অন্য শুঁটকির চেয়ে শিদল তৈরির ধরণ ভিন্ন হওয়ায় এর ঘ্রাণও ভিন্ন হয়। শিদল দিয়ে বিভিন্ন রকমের ভর্তা ও তরকারি রান্না করা হয়। এ শুঁটকি রুচি বাড়ায়। এ শুঁটকি খেলে শরীরের বাত-ব্যাথা কমে। আমরা যারা জমিতে কাজ করতাম, অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীরে ব্যাথা বা জ্বর আসলে এই শিদলের ভর্তা গরম ভাত দিয়ে খেলে নাপা বা প্যারাসিটেমল খেতে হতো না। তবে এখন মুরগির মাংসের চেয়ে শিদলের দাম অনেক বেশি। এতো দাম দিয়ে শিদল কিনা আমাদের মতো শ্রমজীবি মানুষের অনেকটা সাধ্যের বাইরে।


শিদল শুধু যে রামচন্দ্রপুর বাজারের ঐতিহ্য তা নয়, দেশের বিভিন্ন জেলা শহরেও যাচ্ছে এই শুটকি। এমনকি বিদেশে থাকা লোকজনও তাদের পরিবারের কাছে আবদার রাখে লোক মারফতে শুটকি পাঠাতে। সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার শিদল কিনার জন্য আশেপাশের কয়েক থানার শুঁটকির পাইকাররা যেমন ভিড় করতেন, তেমনি খুচরা ক্রেতার ভিড়ও কম ছিল না। আগে বর্ষায় খাল,বিল, নদীতে প্রচুর পুঁটি মাছ পাওয়া যেত বলে এই সময়টা শিদল তৈরির ধুম পড়ত। এখন বলতে গেলে মাছের অনেকটা আকাল বলেই এই ব্যবসা থেকে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ফলে দিনের দিন এই স্বাদের শিদল শুঁটকির দাম বেড়েই চলেছে।


মুরাদনগর উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার মো. মানিক বলেন, শিদল শুঁটকিতে প্রচুর পরিমানে প্রোটিন, লবন মিনারেল রয়েছে। শিদল স্বাস্থ্যকর, রুচিবর্ধক একটি খাবার। যারা এর স্বাদ বোঝেন, তাঁদের কাছে এর আলাদা কদর আছে।   



আরএক্স/