কপ-২৮ আসরে বড় প্রত্যাশা
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৬:২৫ অপরাহ্ন, ৩০শে নভেম্বর ২০২৩
বসির হোসেন খান: জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট মোকাবিলা, কার্বন নির্গমন কমানো, তেলের ব্যবহার কমিয়ে নবায়ণযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর বিষয়গুলোকে সামনে রেখে আজ থেকে শুরু হচ্ছে কনফারেন্স অফ দ্য পার্টিজের (কপ) ২৮ তম সম্মেলন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে কয়লা, তেল ও গ্যাসের ব্যবহার বন্ধ করা উচিত, নাকি জলবায়ুর ওপর শিল্পের প্রভাব কমাতে প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গুরুত্ব দেওয়া উচিত; তা নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে বিভাজন রয়েছে। সম্মেলনে সেই বিভাজন এবার আরও স্পষ্ট হতে পারে।
বৃহস্পতিবার (২৯ নভেম্বর) সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে জাতিসংঘ আয়োজিত জলবায়ু সম্মেলন কপ (কনফারেন্স অফ দ্য পার্টিজ) এর ২৮তম আসর শুরু হচ্ছে। এ সম্মেলন চলবে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
৭০ হাজারের বেশি প্রতিনিধি নিয়ে আয়োজিত হচ্ছে এবারের কপ সম্মেলন। এবারের সম্মেলনে আগের যেকোনো সম্মেলনের চেয়ে অনেক বেশি ব্যবসায়ী অংশ নিচ্ছেন। এছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ব্রিটেনের রাজা চার্লসও সম্মেলনে অংশ নেবেন। তবে বৈশ্বিক জলবায়ু রক্ষার বিশাল এই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা চীনের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধান কেউ অংশ নিচ্ছেন না।
এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যস্ততার কারণে এবারের সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যোগ দেবেন কি-না তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিবসহ বাংলাদেশ থেকে শতাধিক পরিবেশ কর্মী জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেবেন। ইতোমধ্যে বরাবরের মতো এবারের সম্মেলনেও বাংলাদেশ থেকে একটি প্রতিনিধিদল অংশ নিয়েছেন। ২২ সদস্যের প্রতিনিধি দলে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন। দুবাইয়ের এক্সপ্রো সিটিতে সম্মেলনস্থলে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ইতিমধ্যে প্রতিনিধি দল ও সাংবাদিকরা উপস্থিত হয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে লড়াই চলছে, তার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে প্রতিবারের মতো এবারের সম্মেলনেও বেশকিছু প্রত্যাশা থাকবে বিশ্ববাসীর। প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় বৈশ্বিক লড়াইয়ের প্রশ্নে কার্যকর উদ্যোগের অবতারণা ঘটবে বলেও প্রত্যাশা থাকবে। জলবায়ু অর্থায়ন (ক্লাইমেট ফান্ডিং) বৃদ্ধির পাশাপাশি জ্বালানি স্থানান্তরের (জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বের হয়ে নবায়নযোগ্য উৎসের সন্ধান) বিষয়ও গুরুত্ব পাবে সম্মেলনে।
বায়ুমণ্ডলে অধিক কার্বন নিঃসরণে প্রভাবশালী এই দেশগুলোকেই বেশি দায়ী করা হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পৃথিবীতে ৫৫ ভাগেরও বেশি ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ করছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও রাশিয়া। কার্বন নির্গমনের জন্য দায়ী জীবাশ্ম জ্বালানির অন্যতম তেল। এর অন্যতম বড় উৎপাদক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। আর সেই দেশেই শুরু হয়েছে কার্বন নির্গমন কমানো নিয়ে আলোচনা।
কপ-২৮ এর সভাপতি করা হয়েছে আমিরাতের জাতীয় তেল কোম্পানি অ্যাডনকের প্রধান নির্বাহী সুলতান আল-জাবেরকে। তাই সম্মেলন সফল করতে তিনি সৎভাবে কাজ করতে পারবেন কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, সম্মেলনের আগে তিনি বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে গ্যাস ও অন্যান্য বাণিজ্যিক চুক্তি নিয়ে আলোচনা করার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে সোমবার বিবিসির এক প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়। ফাঁস হওয়া কিছু নথির ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বিবিসি। তবে ফাঁস হওয়া নথি ‘সঠিক নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন কপ-২৮ এর একজন মুখপাত্র।
তবে আল-জাবের মনে করেন, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ধীরে ধীরে সরে আসার বিষয়টি ‘অবশ্যম্ভাবী’। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তেল শিল্পকেও জড়াতে হবে বলেও মনে করেন তিনি। তাই তেল ও গ্যাস উত্তোলনের সময় কার্বন নির্গমন কমাতে কোম্পানিগুলোর সহায়তা চান আল-জাবের। সে কারণে এবারের সম্মেলনে আগের যে-কোনো সম্মেলনের চেয়ে অনেক বেশি ব্যবসায়ী অংশ নিচ্ছেন।
২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ব্যাপকভাবে বাড়াতে চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। সে জন্য এই সম্মেলনে একটি চুক্তি করতে চায় তারা। ইতোমধ্যে শতাধিক দেশ এ পরিকল্পনার পক্ষে রয়েছে বলেও বিভিন্ন দেশের কর্মকর্তারা রয়টার্সকে জানিয়েছেন। তবে চীন-ভারত এ পরিকল্পনায় এখনো পুরোপুরি সমর্থন দেয়নি।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের যেসব দেশে খরা, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে তাদের সেই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে তহবিল গঠন চূড়ান্ত করার চেষ্টা করা হবে এই সম্মেলনে। ইতোমধ্যে এর খসড়াও তৈরি হয়েছে।
১৭৬০ সালের পর ইউরোপে যখন শিল্পবিপ্লবের সূচনা তখন থেকেই প্রকৃতির বিপদের শুরু। তখন থেকেই পৃথিবীতে কার্বন নিঃসরণ শুরু হয়। এর ফলে দিন দিন বাতাসের উষ্ণতা বেড়েছে; হয়েছে বায়ুদূষণ।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অন্তত ১ দশমিক ৬২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে একবিংশ শতাব্দী শেষে পৃথিবীর বুক থেকে প্রায় অর্ধশত দেশ সমুদ্রপৃষ্ঠে তলিয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, বন্যা, খরা, দাবানল বেশি হচ্ছে।
কপ-২৮ সম্মেলনে জলবায়ু তহবিল ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব দেশ বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকারে পরিণত হচ্ছে, সেই সব দেশের জন্য এটা খুশির সংবাদ স্বাভাবিকভাবেই। এই সম্মেলনে মোটাদাগে চারটি বিষয় বিশেষভাবে গুরুত্ব পেতে পারে। এক, জ্বালানি ব্যবহার স্থানান্তর। দুই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃৃত্বে ৬০টিরও বেশি দেশের সমন্বয়ে একটি জোট গঠন করে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত রুখতে কাজ করা। তিন, জলবায়ু অর্থায়ন (তহবিল) বাড়ানো। চার, জলবায়ু অভিযোজন ও স্থিতিস্থাপকতা এবং টেকসই উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
এদিকে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদী ভাঙন, বন্যা, খরা, দাবানল বেশি হচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে; ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অন্তত ১ দশমিক ৬২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। তা হলে একবিংশ শতাব্দী শেষ দিকে পৃথিবীর বুক থেকে প্রায় অর্ধশত দেশ সমুদ্রপৃষ্ঠে হারিয়ে যাবে।
জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে বিপাকে বিশ্ব অর্থনীতি। হ্রাস পেয়েছে বিশ্বের জিডিপি। ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী জিডিপির লোকসান ছিল ১ দশমিক ৮ শতাংশ বা প্রায় ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছে। এসব অঞ্চলের দেশগুলো তাদের জিডিপির যথাক্রমে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ এবং ১১ দশমিক ২ শতাংশ হারিয়েছে। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়্যার বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গত বছরের (২০২২) বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উৎপাদন (জিডিপি) ৬ দশমিক ৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো গত ৩০ বছরে মোট ২১ ট্রিলিয়ন ডলারের মূলধন এবং জিডিপির সম্মিলিত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, যা উন্নয়নশীল বিশ্বের মোট ২০২৩ জিডিপির প্রায় অর্ধেক।
এসব পরিসংখ্যান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফলাফলকে প্রতিফলিত করে। যেমন- কৃষি ও উৎপাদনে ব্যাঘাত এবং উচ্চ তাপের কারণে উৎপাদনশীলতা হ্রাস, সেই সাথে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ওপর ছড়িয়ে পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব ট্রিলিয়ন ডলারের দরিদ্রতর হয়েছে এবং চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বহু দেশ। অন্যদিকে কিছু উন্নত দেশ লাভবান হয়েছে।
আরএক্স/