ধর্মে সূফীবাদের গুরুত্ব কী?


Janobani

জনবাণী ডেস্ক

প্রকাশ: ১০:০৪ অপরাহ্ন, ৩০শে নভেম্বর ২০২৩


ধর্মে সূফীবাদের গুরুত্ব কী?
ছবি: প্রতিকী

সূফীবাদ হল ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন। আত্মা-সম্পর্কিত আলোচনাই এর মূল বিষয়বস্তু। নিজ নিজ আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হলো এই দর্শনের মর্মকথা। ‘সুফ’ অর্থ পশম আর তাসাউফের অর্থ পশমি বস্ত্রে পরিধানের অভ্যাস (লাবসুস-সুফ)। মরমিতত্ত্বের সাধনায় কারও জীবনকে নিয়োজিত করার কাজকে বলা হয় তাসাউফ। যিঁনি নিজেকে এরূপ সাধনায় সমর্পিত করেন, তাঁকেই সূফী বলে। 


তাসাউফ বা সূফীবাদ বলতে অবিনশ্বর আত্মার পরিশুদ্ধির সাধনাকে বোঝায়। আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহর (আল্লাহর সঙ্গে অবস্থান করা) মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে স্থায়ীভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া) লাভ করা যায়। যেহেতু আল্লাহতায়ালা নিরাকার, তাই তাঁর মধ্যে ফানা হওয়ার জন্য নিরাকার শক্তির প্রতি প্রেমই একমাত্র পন্থা হতে পারে। তাসাউফ দর্শন অনুযায়ী এই সাধনাকে ‘তরিকত’ বা খোদা-প্রাপ্তির পথ বলা হয়। আর তরিকত সাধনায় মুর্শিদের প্রয়োজন আব্যশক। সেই পথ হলো ফানা ফিশ শায়েখ , ফানা ফিররাসুল ও ফানাফিল্লাহ। ফানাফিল্লাহ হাছিলের পর বাকাবিল্লাহ হাছিল হয়। 



বাকাবিল্লাহ অর্জিত হলে সূফী আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ শক্তিতে শক্তিমান হন। তখন সূফীর অন্তরে সর্ব অবস্থায় শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করে।


হযরত মোহাম্মদ (সা.) ফরমান, ‘মানবদেহে একটি বিশেষ অঙ্গ আছে, যা সুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ পরিশুদ্ধ থাকে, আর অসুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ অপরিশুদ্ধ হয়ে যায়। জেনে রাখো, এটি হলো কলব বা হৃদয়। আল্লাহর জিকর বা স্মরণে কলব কলুষমুক্ত হয়।’ সার্বক্ষণিক আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে কলবকে কলুষমুক্ত করে আল্লাহর প্রেমার্জন সূফীবাদের উদ্দেশ্য।


সূফীবাদ উৎকর্ষ লাভ করে পারস্যের নগরে। সেখানকার প্রখ্যাত সূফী-দরবেশ, কবি-সাহিত্যিক এবং দার্শনিকেরা নানা শাস্ত্র, কাব্য ও ব্যাখ্যা-পুস্তক রচনা করে এই দর্শনকে সাধারণের কাছে জনপ্রিয় করে তোলেন। কালক্রমে বিখ্যাত অলিদের কেন্দ্র করে বিভিন্ন তরিকা গড়ে ওঠে।


তার মধ্যে চারটি প্রধান তরিকা সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে: ১. বড় পীর হযরত আবদুল কাদির জিলানি (র.) ছাহেব প্রতিষ্ঠিত কাদেরিয়া তরিকা, ২. সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা মু’ঈনুদ্দীন চিশতি (র.) ছাহেব প্রতিষ্ঠিত চিশতিয়া তরিকা, ৩. হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দী (র.) ছাহেব প্রতিষ্ঠিত নকশবন্দিয়া তরিকা এবং ৪. হযরত শেখ আহমদ মুজাদ্দিদ-ই-আলফে ছানী সেরহিন্দী (র.) ছাহেব প্রতিষ্ঠিত মুজাদ্দেদীয়া তরিকা। এ ছাড়া সোহরাওয়ার্দি, মাদারিয়া, আহমদিয়া ও কলন্দরিয়া নামে আরও কয়েকটি তরিকার প্রসার ঘটে।


আরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, খোরাসান, মধ্য এশিয়া ও উত্তর ভারত থেকে সূফীরা বাংলাদেশে সূফীবাদ প্রচার করেন। খ্রিষ্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে যেসব সূফী-সাধক এ দেশে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: শাহ সুলতান রুমি (র.) ছাহেব, বাবা আদম শহিদ (র.) ছাহেব, শাহ সুলতান বলখি (র.) ছাহেব, শাহ নিয়ামতুল্লাহ বুতশেকন (র.) ছাহেব, শাহ মখদুম রুপোশ (র.) ছাহেব, শেখ ফরিদউদ্দিন শক্করগঞ্জ (র.) ছাহেব, মখদুম শাহ দৌলা শহিদ (র.) ছাহেব প্রমুখ। এঁরা গভীর পাণ্ডিত্য ও বিভিন্ন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন বলেও প্রচলিত আছে। বেশ কয়েকজন সূফী-দরবেশ ইসলাম ও সূফীবাদ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের মধ্যে শেখ জালালুদ্দিন তাব্রিজি (র.) ছাহেব, শাহ জালাল (র.) ছাহেব ,শাহ পরাণ (র.) ছাহেব ,শাহ আলী বাগদাদী (র.) ছাহেব, খান জাহান আলী (র.) ছাহেব, শাহ ফরিদউদ্দিন (র.) ছাহেব,শাহ সূফী খাজা ইউনুস আলী এনায়েতপুরী (র.) ছাহেব, শাহ সূফী বিশ্বওলী খাজাবাবা ফরিদপুরী (কু.ছে.আ.) ছাহেব প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।


হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের গুরুসাধকেরা আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে যেভাবে দীক্ষা দান করতেন, সেভাবে মানবপ্রেম তথা সৃষ্টির প্রতি প্রেমের মাধ্যমে স্রষ্টার প্রেমার্জন সূফীবাদের মূল আদর্শ। সূফীরা নিজেদের আদর্শ জীবন এবং সূফীবাদের প্রেম-ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের মধুর বাণী প্রচার করে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এ দেশের সাধারণ মানুষের মন মনন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনেও সূফীদের প্রভাব লক্ষ করা যায়। যেমন পানি পথে যাতায়াতের সময় মাঝিরা ‘বিভিন্ন পীরের’ নাম স্মরণ করে। শুধু তা-ই নয়, নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে শহরের যানবাহনে পর্যন্ত বিভিন্ন পীর-আউলিয়ার নাম লেখা থাকে। লৌকিক ধারার মুর্শিদি-মারফতি গান, গাজীর গান, গাজীকালু-চম্পাবতী কাব্য ও অন্যান্য মরমি সাহিত্য, মাদার পীর ও সোনা পীরের মাগনের গান ইত্যাদি বিভিন্ন পীর-দরবেশকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে।