আধ্যাত্মিক সাধনায় সূফীজম ও কাশফের প্রয়োজনীয়তা


Janobani

জনবাণী ডেস্ক

প্রকাশ: ০৯:১১ অপরাহ্ন, ১লা ডিসেম্বর ২০২৩


আধ্যাত্মিক সাধনায় সূফীজম ও কাশফের প্রয়োজনীয়তা
ছবি: সংগৃহীত

সূফী তথা সুফিজমের উৎপত্তি নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন মত। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে ‘সুফ’ তথা ছাগল বা ভেড়ার লোম থেকে সূফী নামটির উৎপত্তি । কেউ কেউ বলেন ‘সাফি’ অর্থাৎ ময়লা পরিষ্কারক থেকে সূফী কথাটি এসেছে। তবে আরবি ‘সাফা’ (পবিত্র) শব্দ থেকে সূফী শব্দটির উৎপত্তি বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। বস্তুত: অন্তরের ময়লাকে পরিষ্কার করার লক্ষ্যেই সূফূীরা নিজেদের নিয়োজিত রাখেন।


পরম সত্তা মহান আল্লাহ কে জানার আকাঙ্খা মানুষের চিরন্তন। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক আধ্যাত্মিক ধ্যান ও জ্ঞানের মাধ্যামে জানার প্রচেষ্টাকে সূফী দর্শন বা সূফীবাদ বলা হয়। হযরত ইমাম গাজ্জালী (রঃ) ছাহেবের মতে, " মন্দ সবকিছু থেকে আত্মাকে প্রবিত্র করে সর্বদা আল্লাহর আরাধনায় নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহতে নিমগ্ন হওয়ার নামই সূফী বাদ। আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে অবস্থান করা) এবং ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে স্থায়িভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া) লাভ করা যায়। যেহেতু আল্লাহ নিরাকার, তাই তাঁর মধ্যে ফানা হওয়ার জন্য নিরাকার শক্তির প্রতি প্রেমই একমাত্র মাধ্যম। মহব্বতের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিয়ে আল্লাহর অস্তিত্বে লীন হয়ে যাওয়া। যাকে মনছুর হাল্লাজ (র.) ছাহেব পরিণত করেছিলেন ‘ফানা ফিল্লা’তে।


যে মতবাদ ধর্মের গতানুগতি কতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে হৃদয়ের উপলব্ধি দিয়ে বিচার করে, সেটাই সূফীবাদ। হজরত জুনাইদ বোগদাদি (র.) ছাহেব সূফীবাদকে অভিহিত করেছেন ‘নিজের অজ্ঞতার উপলব্ধি’ বলে। অজ্ঞতা বলতে বলা হচ্ছে "বিশালত্ব" তথা আল্লাহকে জানার ও তাঁকে চেনার ব্যাপারে অজ্ঞতা। আল্লাহকে জানার ও চেনার উপায় হোল ভক্তি ও প্রেম । এই প্রেমের অন্য নামই সূফীবাদ। আর এই প্রেমের সাধকরাই সূফী সাধক জগতে পরিচিত।


অনেকে নবী পাক (সা.)’র মাধ্যমে সূফীজমের প্রারম্ভ বলতে চেয়েছেন। এর পক্ষে যৌক্তিকতা হল নবী পাক (স.) নবুওয়্যাত প্রাপ্তির আগে পবিত্র কাবার প্রায় ৫ কি.মি. দূরত্বে হেরা গোহায় মহান আল্লাহ পাকের ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। আর এখানেই পবিত্র কুরআনের প্রথম শব্দ "ইকরা" নাযিল হয়। এক মতে হযরত হাসান আল বসরী (রহ.) ছাহেব সর্বপ্রথম সূফী বলে গণ্য হয়ে থাকেন ।


প্রিয় নবী (সাঃ) সাহাবাদেরকে ৪টি বিদ্যা শিক্ষা দিতেন---শরিয়ত, তরিকত, হাকিকত ও মারেফত। মোরাকাবা করলে হৃদয়ের কালিমা দূর হয়, হৃদয় আলোকিত হয়। মোরাকাবার নিয়ম হল প্রতি ওয়াক্ত নামাজ শেষে ও রাত্রির তৃতীয় অংশে (রহমতের সময়) জেগে বা অন্য যে কোন সময় আল্লার ধ্যনে মগ্ন থাকা নিজের জীবনের ভুল, বেয়াদবীর জন্য মহান আল্লাহর কাছে কাকুতি মিনতি করে ক্ষমা প্রার্থনা করা । এভাবেই অধিককাল মোরাকাবা করলে দিলের চোখ খুলে যায়। আর ঐ চোখেই কেবল মো'মেন বান্দার নামাজ মেরাজ সম হয়ে থাকে।


মোরাকাবা হল নফল ইবাদতের অর্ন্তভূূক্ত। নফল ইবাদত হল মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের উত্তম পন্থা। তাই মোরাকাবা সাধকের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সাহাবায়ে কেরামগণ প্রথমে মোরাকাবা করেছেন। পরে আল্লাহর পক্ষ থেকে পর্যায়ক্রমে নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ইবাদত নির্দেশিত হয়েছে।


অবশ্য আরেক মত হচ্ছে পবিত্র আসহাব-ই-সুফফা অর্থাৎ বান্দার এ সাহাবাগণের আদর্শই সূফীরা গ্রহণ করেছিলেন এবং সূফফা থেকে সূফী শব্দটি নেয়া হয়েছে। রাসুল (সাঃ) মদিনায় হিজরতের পরে মসজিদে নববীর বারান্দায় একটা ছাউনির নিচে থাকতেন। রাসুল (সাঃ) সাহাবাদের জন্য ধ্যান বা মোরাকাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। এখানে বসে হজ্ব ও ওমরায় আসা নবীর আশেকরা কুরআন তেলাওয়াত, নফল নামাজ, ধ্যান বা মোরাকাবা, দরুদ ও মিলাদ শরীফ পড়ে থাকেন। ছাউনি শব্দটা থেকেই এসেছে সূফী শব্দটা। তাঁরা সেখানে থাকতেন সংসার তথা দুনিয়াবী সব কিছু ত্যাগ করে। তাঁরা লোমের কম্বল এবং পোশাক ব্যবহার করতেন । ওই সাহাবিগণ ব্যবসা-বাণিজ্য-চাষাবাদ কিছুই করতেন না, এমনকি থাকতেন না পরিবারের সাথেও। মক্কা - মদিনা অথবা যেখানেরই অধিবাসী হোন না কেন- যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রেমে নিবেদিত ও সমর্পিত হয়েছিলেন তাঁরাই এসে থাকতেন ওই তিনদিক খোলা ছাউনির তলায়। পুরো দলের মধ্যে হয়ত দু-চারজন কাঠ কাটতে গেলেন, বিক্রি করে সবার জন্য দু-চার টুকরা করে রুটির জোগান দেবেন- বাকিরা ওই ছাউনিতেই। নবী পাক (সাঃ)  গোলামিতে। তিঁনার পবিত্র কদমের তলায়। দিন নেই, রাত নেই, গ্রীষ্ম-শীত-ধূলিঝড় নেই সব সময়। তাঁদের না আছে এক টুকরা বাড়তি কাপড়, না একটা বাক্স-পেঁটরা। দাঁড়াতে পারেন না, অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান- এই এঁরাই আবার কী করে যেন রাতের পর রাত পার করে দেন সালাতে। দয়ার সাগর রাসূল (সাঃ) তাঁদের ছাড়া খাবেন না। বসবেন না। উঠবেন না। এই আসহাবে সুফফারা দিনের পর দিন রোজা রেখে রাতের পর রাত কুরআন তিলাওয়াত ও আধ্যাত্মিক সাধনায় এমন মগ্ন ছিলেন, যে ইসলামের ব্যবহারিক প্রকৃত রূপ হিসাবে তাঁদের দেখেই মানুষ দলে দলে শান্তির ধর্মে শামিল হত। এসে পড়ত তাদের পান্ডিত্য দেখে, মোহ- বরজনের আজব মোহ দেখে। এভাবে যারা করেছেন, তারাই শুধু সূফী নন। ইসলামের পূরো রীতিটা যেই অনুসরণ করেন, শেষ মেশ তিনিই সূফী।


কাশফ কি ;-- কাশফ মানে হল অজানা কোন বিষয় নিজের কাছে প্রকাশিত হওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ কর্তৃক তার কোন বান্দার নিকট এমন কিছুর জ্ঞান প্রকাশ করা যা অন্যের নিকট অপ্রকাশিত। আর এটি কেবলমাত্র নবী-রাসূলগণের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তিঁনি অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী। তিঁনি তাঁর অদৃশ্যের জ্ঞান কাহারো নিকট প্রকাশ করেন না’। ‘তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতীত। তিঁনি তার (অহীর) সম্মুখে ও পশ্চাতে প্রহরী নিযুক্ত করেন’ (জিন ৭২/২৬-২৭)। এখানে ‘ওহী’ ও ‘রাসূল’ বলতে জিবরীল ও নবী-রাসূলগণকে বুঝানো হয়েছে। তবে কখনও কখনও অন্য কারু নিকট থেকে অলৈাকিক কিছু ঘটতে পারে বা প্রকাশিত হতে পারে। যেমন ছাহাবী ও তাবেঈগণ থেকে হয়েছে। অতএব এরূপ যদি কোন মুমিন থেকে হয়, তবে সেটা হবে ‘কারামত’। অর্থাৎ মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে এর দ্বারা সম্মানিত করেন।