বাংলায় ইসলাম প্রচারে সূফীবাদের ভূমিকা


Janobani

জনবাণী ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮:০৮ অপরাহ্ন, ৭ই ডিসেম্বর ২০২৩


বাংলায় ইসলাম প্রচারে সূফীবাদের ভূমিকা
ছবি: প্রতিকী

ইসলাম প্রচারমুখী একটি ধর্ম। সারা পৃথিবীর যে প্রান্তেই এই ধর্মের পদচারণা হয়েছে সেখানেই ইসলাম ধর্মান্তরিতদের ভিতরে দ্রুত সমপ্রসারিত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ঐতিহাসিক অবিভক্ত বাংলায়ও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল।  ১৮৭২ সালে সর্বপ্রথম জনশুমারীতে দেখা যায়, বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যাভিত্তিক অনুপাত মো্ট ৪৮ ভাগ। এই তথ্যটি তখন আচ্শচর্জজনক হলেও তার যুক্তি ও প্রমাণভিত্তিক ব্যাখ্যা ছিল। উপমহাদেশের মধ্যে বাংলায় অধিবাস ছিল সামাজিকভাবে বঞ্চিত ও নিগৃহীত অধিক মানুষের। অনেকেই ইসলামের উদার ও কল্যাণমুখী আবেদনে সাড়া দিয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। কেন এবং কীভাবে এ ব্যাপক ধর্মান্তরণ হয়েছিল তা ইতিহাসের এক চমকপ্রদ আলোচনার বিষয়। যেমন পশ্চিমের অনেক গবেষকের মতে, ইসলাম দ্রুত প্রচার হয়েছে মুসলিম শাসকদের তরবারির জোরে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, দিল্লি ও আগ্রা ছিল দোর্দণ্ড মুসলিম প্রতাপের কেন্দ্রবিন্দু।


ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে ইসলামের অন্তর্লীন মানবতাবাদী আবেদনের বিষয়ে। প্রধানত ইসলাম প্রচারে সূফীদেরই অবদান অস্বীকার্য। সূফীবাদী ইসলামের মৌল বক্তব্য বা ধারণা আছে। একটি, ইন্নামাল আমানু বিন্‌ নিয়্যাত। অর্থাৎ মনোবাঞ্ছার ওপর ধার্মিকতা বা ঈমান নির্ভরশীল। আরো উল্লেখ্য, ইসলামে অন্তরের শুচিতা বড়; এবং তার সঙ্গে সংযোজিত হবে আবশ্যকীয় আচার-আনুষ্ঠানিকতা। অপরটি হলো, মান আরাফা নাফসাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু- নিজকে জানলে রবকে চেনা হয়।


সূক্ষ্ম বিচারে বাংলায় ইসলামের আবির্ভাব, ব্যাপক প্রচার ও প্রসার মুসলিম রাজনৈতিক শক্তি থিতুকরণে পাটাতন হিসেবেই কাজ করেছে। আলাদাভাবে বললে ইসলামের গতিময় ব্যাপ্তি রাজশক্তি বিকাশের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছিল। বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতাই সব নয়, বরং গুঢ় বা গুপ্ত প্রণোদনায় প্রাণিত উদারপন্থী ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল এমন ইসলামী মননসমৃদ্ধ সূফীকুল দ্বারা। তাদের মানবিক অনুপ্রেরণা-আলোকবাহী ইসলামী আবেদন স্থানীয় বিভিন্ন ধর্মানুসারী মানুষের মধ্যে সহজ ও সাবলীলভাবে গ্রহণ যোগত্য পেয়েছিল। অতীতের আচার-অনুষ্ঠান ধর্মে রীতিনীতি স্থানীয় হিন্দু সমাজ, বিশেষ করে ধর্মের কারণে সমাজচ্যুত আমজনতা যেন উদারপন্থী ও মানবিক ইসলামের মধ্যে এক গোঁড়ামিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ভাঙার ইঙ্গিত পেয়েছিল।


ইসলাম প্রচারমুখী ধর্ম হলেও বাংলায় ধর্মটির প্রচারের কৌশল ও পদ্ধতি যে মানবিক অনুভূতি সমৃদ্ধ ছিল তা বিশেষভাবে আলোচনার দাবি রাখে। বাংলায় মুসলমানরা শাষণ ক্ষমতা দখল করেছিল ১৩ শতকের শুরুর দিকে; কিন্তু বাংলাতে সূফীবাদী ইসলামের শুভাগমন ঘটেছিল আট শতকেই। অর্থাৎ মুসলিম রাজনৈতিক রাষ্ট্র বিজয়ের পূর্বসূরি হিসেবে কাজ করেছিল ধর্মবিজয়। এটা বললে বাড়িয়ে বলা হবে না যে, রাজনৈতিক বিজয়পূর্ব ধর্মবিজয় রাজনৈতিক বিজয়ের পথকেই সুগম করেছিল।


পারসিক সূফীদের ইসলাম প্রচারের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল সংযোজনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি। ইসলাম গ্রহণের সময় স্থানীয় ধর্মান্তরিত মানুষের ঐতিহ্যবিচ্যুত হতে হয়নি কখনোই। কারণ ধর্মপ্রচারক সূফীরা তা করতে বলেননি। ফলে বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ইসলাম হয়েছে সংশ্লেষণবাদী। এজন্যই স্থানীয়দের পক্ষে ইসলামে ধর্মান্তরণ সহজ হয়ে উঠেছিল। উল্লেখ্য থাকে যে, খোদ আরবেই ইসলাম স্থানীয় অনেক ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করেই বিকশিত হয়েছিল। বিশ্বের যে প্রান্তেই ইসলাম ধর্ম সমপ্রসারিত হয়েছে সেখানেই একই ঘটনা ঘটেছে। ধর্ম প্রচার ও প্রসারের এহেন পদ্ধতি নিঃসন্দেহে শুধু বিচক্ষণতাই নয়, মনস্তাত্ত্বিকভাবে মানবিকও বটে।


আবার সূফী-সাধকদের পরিচালিত তিনটি প্রতিষ্ঠান বাংলায় ইসলাম প্রচারেও পরিপূরক ভূমিকা পালন করেছিল। প্রথম প্রতিষ্ঠানটি হলো লঙ্গরখানা। লঙ্গরখানায় ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সব অন্নহীন বা সমাজচ্যুত মানুষকে সমাদরে এবং বিনামূল্যে আপ্যায়ন করা হতো। আর এই অর্থের জোগান আসতো তৎকালীন মুসলিম শাসকদের রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকেই। এ ব্যবস্থার ফলে সবথেকে’ বেশি উপকৃত হয়েছিল কট্টর হিন্দুত্ববাদী সেন শাসনে (১১৬১-১২০৪) সনে নিগৃহীত ও র্নিজাতিত জাতিভেদ প্রথার শিকার হয়ে সমাজচ্যুত হিন্দুরা। জাত-পাতের পার্থক্যহীন সব মানুষের এমন সম্মিলন ছিল বাংলায় নজির বিহীন দৃষ্টান্ত। বলা যায় সেসময়, এক ধরনের সামাজিক বিপ্লবই ঘটে গিয়েছিল বাংলায়। আর এই বিপ্লব যারা প্রতক্ষ্য করেছিল সেই স্থানীয়দের এমন এক উপলব্ধি হয়েছিল যে, নতুন ধর্ম ইসলাম সামাজিকভাবে সমতাবাদী ধর্ম , যা বৌদ্ধ ধর্মে থাকলেও কট্টরবাদী হিন্দুত্বে ছিল না। কাজেই নিম্ন শ্রেণীর অক্ষম, দুঃখী হিন্দুদের কাছেই ইসলামের আকর্ষণ ছিল বেশি; এবং তারাই সময়ের পরিক্রমাই মুসলমান সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হয়ে উঠেছিল। অবশ্য কিছু সংখ্যক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ও পরিস্থিতির কারণে মুসলমান হয়েছিল।


ইসলাম ধর্ম প্রচার-সহায়ক দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠানটি ছিল খানকাহ। আর লঙ্গরখানা ছিল সামাজিক ইসলামের বাস্তব দৃষ্টান্ত; আর খানকাহ ছিল তাত্ত্বিক ইসলামের প্রশিক্ষণকেন্দ্র। এখানে সূফীরাই ছিলেন প্রশিক্ষক। লঙ্গরখানায় হৃদয়-সম্বন্ধীয়,তৃপ্ত উন্নতজীবন প্রত্যাশী শোষিত-বঞ্চিত মানুষগুলো খানকাহ-এ গিয়ে যে বিশেষ আগ্রহী ও ঐকান্তিক প্রশিক্ষণার্থী হবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক বিষয়। এ দুটো প্রতিষ্ঠানই তাদের ইসলামে দীক্ষা গ্রহণের জন্য মানসিকভাবেও দৃঢ় করেছিল। 


বাংলায় ইসলাম সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করা তৃতীয় প্রতিষ্ঠানটি হলো দরগাহ। দরগাহে সমাবেশ হতো সব ধর্মের মানুষদের নিয়ে, যে রীতি আজও চালু আছে সেখানে। তবে দেখা যায় যে, ক্রমাগতভাবে দরগাহ খানকাহ-র জায়গা দখল করে নিয়েছে। দরগাহ-র এমন প্রাধান্যের সূচনা হয় বাংলায় হুসেইন শাহী শাসনামলে (১৪৯৩-১৫৩৮) সনে।  কিন্তু দরগাহ-এ কিছু ইসলামি চেতনা পরিপন্থী আনুষ্ঠানিকতাও দৃশ্যমান হয়েছিল, যার রেশ আজও দৃশ্যমান।


অর্থাৎ বাংলার ছোট-বড় সব শহর এমন কী গ্রামের মাঠে প্রান্তরেও তারা পদার্পণ করেছিলেন, এবং অনেক জায়গায় স্থায়ীভাবেই থেকে গিয়েছিলেন। কাজেই বলা যায় বাংলার সমগ্র ভূমি জুড়েই তারা ইসলামের মর্মকথা প্রচার ও প্রসার করেছিলেন। মুসলমান রাষ্ট্রশক্তি ইসলাম প্রচারে সূফীদের সহায়ক হয়েছিল, কিন্তু এমন শক্তির প্রভাবে ইসলাম সম্প্রসারিত হয় নাই। বাংলায় ইসলামের মহানুভবতা বা আলোরশ্মি বিকশীত করেছিলেন বিভিন্ন সূফী সাধকেরাই।


এমএল/