মিয়ানমারের সংঘাত: থমথমে ঘুমধুম সীমান্ত
জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৬:৩০ অপরাহ্ন, ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ২০২৪
- টানা বিস্ফোরণের শব্দে কাঁপছে সীমান্ত
- পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে মিয়ানমার বিজিপির কমপক্ষে ৫০ সদস্য
- গুলিবিদ্ধ এক বাংলাদেশী, গুলি ও মর্টার শেলে এসে পড়েছে বসত ঘর, আগুনে পুড়েছে ঘরও
- আবারও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা
- মিয়ানমার সংঘাতে আরকার আর্মির সাথে যুক্ত হয়েছে আরএসও যোদ্ধা
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘাতের জের ধরে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্ত পরিস্থিতি থমথমে বিরাজ করছে। সীমান্তের কাছা-কাছি এলাকায় টানা বিস্ফোরণের শব্দে কাঁপছে সীমান্ত এলাকা। অভ্যন্তরে চলমান সংঘাতে নিক্ষেপ করা গুলি, মর্টার শেল, বারুদ এসে পড়েছে সীমান্তের এপারেও। এতে এক বাংলাদেশী নাগরিক গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন। বারুদে পুঁড়ে গেছে স্থানীয়দের একটি বসত ঘর। এছাড়া অনেক বসত ঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। চরম আতংকিত হয়ে পড়েছে সীমান্তে বসবাসকারিরা। এ পরিস্থিতিতে আবারও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ৫ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসা।
শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) বিকাল থেকে শুরু হওয়া বিস্ফোরণের শব্দ রবিবার দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আজিজ।
তিনি জানান, দুপুরে যে সংঘর্ষের শব্দ ও পরিস্থিতি বুঝা যাচ্ছে, তাতে তুমব্রæ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) এর এক ফাঁড়ি ঘীরে। যেখানে ওই ফাঁড়ি ঘীরে মিয়ানমারের বাহিনীর সাথে বিদ্রোহী গোষ্ঠির তুমুল সংঘর্ষ, গোলা-গুলি, মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। যা মাঝে-মধ্যে সীমান্ত অতিক্রম করে চলে আসছে এপারেও।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, সীমান্তের গোলাগুলির ঘটনায় ঘুমধুম সীমান্তে আতংক বিরাজ করছে। তবে পরিস্থিতি অনুকূলে আছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সংযুক্ত মহাসড়ক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সীমান্তের লোকজনকে সতর্ক ও নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার জন্য বলা হয়েছে। সীমান্তে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিজিবি, পুলিশসহ নিরাপত্তা বাহিনী সবাই সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
তিনি বলেন, মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কিছু সদস্য পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার ব্যাপারে শোনা যাচ্ছে। তবে বিষয়টি নিশ্চিত করে এখনো বলা যাচ্ছে না।
পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে মিয়ানমার বিজিপির কমপক্ষে ৫০ সদস্য:
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘাতের জের ধরে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্ত পরিস্থিতি থমথমে বিরাজ করছে।
শনিবার বিকাল থেকে শুরু হওয়া বিস্ফোরণের শব্দ রবিবার বিকাল সাড়ে ৪ পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আজিজ।
এপরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) কমপক্ষে ৫০ সদস্য পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্যে অনেকেই গুলিবিদ্ধ সহ আহত রয়েছেন।
বিজিবির কক্সবাজারস্থ ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্ণেল আব্দুল্লাহ আল আশরোকি মিয়ানমারের বিজিপির কত সদস্য পালিয়ে এসেছেন তা নিশ্চিত করেননি।
তিনি বলেন, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির সাথে রাত থেকে তুমুল যুদ্ধের মধ্যে কয়েকজন বিজিপি সদস্য প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশ সীমান্তে অনুপ্রবেশ করেছে। এদের বিজিবির ঘুমধুম সীমান্ত বিওপিতে রাখা হয়েছে। বিজিপি সদস্যদের অস্ত্র ও গুলি বিজিবির কাছে জমা রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে ঘুমধুম সীমান্তে বিজিবির পক্ষে প্রেস বিফ্রিং করার কথা থাকলেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (সাড়ে ৪ টা) প্রেস বিফ্রিং করা সম্ভব হয়নি।
বিজিবি সূত্র জানিয়েছে এ মূহুর্তে সীমান্তের কাছা-কাছি তুমুল লড়াই চলছে। ওখানে বিস্ফোরিত গোলা-বারুদের শব্দের কারণে কাঁপছে সীমান্ত এলাকা। ফলে প্রেস বিফ্রিং বিলম্ব হচ্ছে।
বিজিবির পক্ষে কত সদস্য পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তা এ পর্যন্ত নিশ্চিত করা হয়নি। তবে সূত্র জানিয়েছে, এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৫০ জন আশ্রয় নিয়েছে। এতে গুলিবিদ্ধ সহ আহতদের চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কিছু সদস্য পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার ব্যাপারে শোনা যাচ্ছে। তবে বিষয়টি বিজিবি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
গুলিবিদ্ধ এক বাংলাদেশী, গুলি ও মর্টার শেলে এসে পড়েছে বসত ঘর, আগুনে পুড়েছে ঘরও :
মিয়ানমারে সংঘাতে ছোড়া গুলিতে সীমান্তে এক বাংলাদেশি আহত হয়েছেন। তার ডান হাতে গুলি লেগেছে। রবিবার সকাল ১০টার দিকে বান্দরবানের ঘুমধুমের তুমব্রæ সীমান্তে এ ঘটনা ঘটে।
গুলিবিদ্ধ প্রবীর চন্দ্র ধর ঘুমধুম ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের তুমব্রæ হিন্দু পাড়ার বাসিন্দা। তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
বান্দরবান পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন জানিয়েছেন, ‘একজন আহত হয়েছে বলে শুনেছি। বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না।
ঘুমধুম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, শনিবার রাত থেকে তুমুল সংঘর্ষের মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঘুমধুম সীমান্তে একাধিক গুলি, মর্টার শেল এসে পড়েছে। এতে কমপক্ষে ৩ টি বসত ঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। রাতে এই তুমুল সংঘর্ষের মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাইশফাঁড়ি এলাকার প্রবাসি নুরুল কবীরের বাড়িতে বারুদ এসে পড়ে। এসে ওই ঘরটি আগুন পুঁড়ে গেছে। এর আগে শনিবার বিকালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একটি গুলি অটোরিকশায় এসে লাগে। এতে বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হলেও অটোরিকশার সামনের গ্যাস ভেঙে গেছে।
তিনি বলেন, ‘এতে আতঙ্কে বিরাজ করছে থমথমে পরিবেশ। লোকজনের চলাচল সীমিত হয়েছে।’
ঘুমধুম পুলিশ ফাঁড়ি তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক (আইসি) মাহাফুজ ইমতিয়াজ ভুঁইয়া বলেন, ‘রাতভর গোলাগুলি চলেছে ওপারে। গোলাগুলির শব্দে মানুষের মনে ভয়-আতঙ্ক তো হবেই। তবে যেকোনো পরিস্থিতিতে স্থানীয়দের নিরাপত্তা দিতে আমরা প্রস্তুত আছি।’
আবারও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা
তুমুল সংঘাতের জের ধরে সীমান্ত ঘেঁষা এলাকার পাঁচটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসা আবারও বন্ধ ঘোষণা করেছে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ ও মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ত্রিরতন চাকমা জানান, শনিবার রাত থেকে এ পর্যন্ত মিয়ানমারের ভিতরে গোলাগুলির কারণে ঘুমধুম সীমান্ত এলাকার বাইশপাড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাজাবনিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রু সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম কুল তুমব্রু সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দক্ষিণ ঘুমধুম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় রবিবার একদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে পরবর্তি সীমান্ত গ্রহণ করা হবে।
বান্দরবান জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. ফরিদুল আলম হোসাইনি জানান, সীমান্তের একশ গজ দুরত্বে থাকা মিসকাতুন নবী দাখিল মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরবর্তী সিদ্ধান্দ নেওয়া হবে।
এর আগে ২৯ জানুয়ারিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একদিনের জন্য বন্ধ ছিল।
মিয়ানমার সংঘাতে আরকার আর্মির সাথে যুক্ত হয়েছে আরএসও যোদ্ধা:
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘাতে আরকান আর্মির সাথে যুক্ত হয়েছে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশন (আরএসও) যোদ্ধারাও। ফলে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সাথে লড়াই তীব্রতর ও ত্রিমূখি হয়ে উঠেছে।
শনিবার বিকাল থেকে রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সীমান্ত ফাঁড়িকে ঘীরে ত্রিমুখি লড়াই দেখা যাচ্ছে। বিজিপির এসব ফাঁড়ি চারপাশ থেকে ঘীরে হামলা অব্যাহত রয়েছে। ফলে সীমান্তে জুড়ে পছন্দ বিস্ফোরণের শব্দ শুনা যাচ্ছে।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আজিজ জানিয়েছেন, পরিস্থিতি বুঝা যাচ্ছে লড়াই তীব্র হচ্ছে। যেখানে ত্রিমুখি লড়াই হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সীমান্ত এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, মিয়ানমারের সংঘাত এখন সীমান্তের একেবারে কাছা-কাছি এলাকায়। খালি চোখে সীমান্তের ওপারের অনেক কিছুই দেখা যাচ্ছে। যেখানে এতদিন আরকান আর্মির পোষাক পরিহিতদের লড়াই করতে দেখা গেছে। শনিবার রাতে থেকে রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত লড়াই অব্যাহত রয়েছে। যেখানে আরএসও’র পোষাক পরিহিতদেরও দেখা যাচ্ছে।
সীমান্ত এলাকার মানুষের দাবি আরকান আর্মির সাথে আরএসও সদস্যরাও মিয়ানমারের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে। অস্ত্র হাতে যাদের দেখা যাচ্ছে তাতে তা অনেকটা পরিষ্কার।
মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মির সংঘর্ষ শুরু হয় দেড় বছর আগে। ২০২২ সালে জুলাই থেকে শুরু হয়ে টানা ছয়মাস যুদ্ধ চলে সরকারী বাহিনী ও বিদ্রোহী বাহিনীর মধ্যে। এরপর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে আবারো সংঘর্ষ শুরু হয়েছে।
আরএক্স/