শ্রীপুরে দুটি গ্রামে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পর্যটনের সম্ভাবনা
উপজেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০২:২৮ অপরাহ্ন, ২০শে ফেব্রুয়ারি ২০২৪

বানার নদীর প্রাণ ঘেঁষে দুটি গ্রাম কর্ণপুর ও দড়ি খুঁজে খানি। গ্রাম দুটোতে রয়েছে হাজার বছরের পুরাকীর্তির ভগ্নাংশ । কোথাও আবার হাজার বছরের পুরোনো অমূল্য ইট। কারও বাড়ির সিঁড়িতে পাওয়া গেল নকশা করা মহামূল্যবান পাথর। এখানকার স্থায়ী বাসিন্দারা মাটি খনন করতে গিয়ে পেয়েছেন দীর্ঘ প্রাচীন দেয়াল।
গাজীপুরের শ্রীপুরে গোসিংগা ইউনিয়নে গ্রাম দুটির অবস্থান। সম্প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া জেলার কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া দুর্গের পশ্চিম পাশে গ্রাম দুটির অবস্থান। মাঝে বয়ে গেছে বানার নদী। ইতিহাসবিদদের বইয়েও গ্রাম দুটির রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাসের কথা ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের ধারণা, দরদরিয়া দুর্গের সোজা বিপরীত পাশে নদের ওপারে দড়ি খুঁজেখানি গ্রামে প্রাচীন স্থাপনার অবস্থান হওয়ায় সেখানে তুঘলক সাম্রাজ্যের স্মৃতিচিহ্ন থাকতে পারে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ওই স্থাপনাকে মধ্যযুগীয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে বিস্তারিত ইতিহাস জানা যাবে বলে মত দেন এই প্রত্নতত্ত্ববিদ।
প্রত্নতত্ত্ববিদ সুফি মোস্তাফিজুর রহমান শুক্রবার গ্রাম দুটি পরিদর্শন করে প্রাচীন স্থাপনা সংরক্ষণে উদ্যোগ না থাকায় আক্ষেপ করেন। অধ্যাপকের সঙ্গে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায় , দড়ি খুঁজেখানি গ্রামে বিশাল বট ও তেঁতুলগাছ। নিচে মাজার। তিন দিকে তিনটি প্রাচীন দেয়াল। মাজারে গাছের শিকড়ের ভেতরে চতুর্ভুজ আকৃতির শত শত টালি ইট। রয়েছে দুটি বেলে পাথর। পাথরের গায়ে লোহার ছোট দণ্ড সাঁটানোর গর্ত। স্থাপনার উত্তর দিকে বেশ কয়েকটি ঢিবি ও বাড়িঘরের আশপাশ ঘুরে প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে কথিত আছে, দড়ি খুঁজেখানি গ্রামে প্রাচীন একটি মসজিদ ছিল। মসজিদের উপরিভাগ কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। মাটির ভেতরে লুকিয়ে আছে মসজিদের দেয়ালগুলো। অনেকে আবার মনে করেন, সেখানে মসজিদ নয়; মন্দির ছিল। দেয়ালের ইটের গাঁথুনিতে ব্যবহৃত হয়েছে লাল মাটি। মাজার থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে নদের দিকে যেতে যেতে অসংখ্য পুরাকীর্তির ধ্বংসাবশেষ দেখা গেল।
দড়ি খুঁজেখানি থেকে পশ্চিমে শ্রীপুর সড়ক ধরে দেড় কিলোমিটার এগোলেই কর্ণপুর গ্রাম। মূল সড়ক থেকে দক্ষিণে ৫০০ মিটার গেলে দেখা যাবে বিশাল একটি পুকুর। স্থানীয়ভাবে এটি ‘কনক রাজার পুকুর’ বা ‘বড় পুকুর’ নামে পরিচিত। পুকুরের পশ্চিমে বেশ কয়েকটি বাড়ির উঠানে বিপুল পরিমাণ চতুর্ভুজ আকৃতির টালি ইটের দেখা মিলল। বাড়ির আঙিনায় কলাবাগান, চাষের জমি কিংবা পুকুরঘাট সর্বত্র ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে ইট। বাড়িঘরের আশপাশে বেশ কয়েকটি নকশাখচিত বেলে ও গ্রানাইট পাথর পড়ে থাকতে দেখা গেল।
ব্যক্তিগত কাজে বাড়ির পশ্চিম পাশে একটি স্থানে পাঁচ ফুট গভীর করে খনন করেছিলেন মো. আলম নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি। খননের সময় বিপুল পরিমাণ চতুর্ভুজ আকৃতির ইট পাওয়া গেছে। পাশের জমিতে সেগুলো স্তূপ করে রেখেছেন তিনি। খনন করা অংশে গিয়ে দেখা গেল, খননের ফলে প্রাচীন স্থাপনার দেয়ালের অংশবিশেষ উন্মুক্ত হয়ে গেছে। খনন করা অংশের কিছুটা দক্ষিণে আরও একটি প্রাচীরের দেখা পাওয়া গেল। সামান্য দক্ষিণে চতুর্ভুজ আকৃতির ইট দিয়ে বাঁধাই করা কূপের অংশবিশেষ দৃশ্যমান। এ স্থাপনার ৩০০ মিটারের মধ্যে অন্য একটি বাড়ির প্রবেশদ্বারে অষ্টভুজ আকৃতির একটি গ্রানাইট পাথর ছিল।
কথিত আছে, ১০৪৫ সালের দিকে চন্দ্র বংশের শেষ রাজা গোবিন্দ চন্দ্র ও কলচুরির রাজা লক্ষ্মী কর্ণের মধ্যে যুদ্ধ বাধে। যুদ্ধে লক্ষ্মী কর্ণের কাছে গোবিন্দ চন্দ্র পরাজিত হন। বিজয়ের স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখতে যুদ্ধক্ষেত্রের অদূরে কর্ণপুরে তিনি তখন একটি দিঘি ও রাজবাড়ী নির্মাণ করেন।
কর্ণপুরের হাজার বছরের ইতিহাসের ধারণা পাওয়া যায় যতীন্দ্রমোহন রায়ের ‘ঢাকার ইতিহাস’ বইয়ের প্রথম খণ্ডে। তিনি লিখেছেন, বানার নদের তীরে সমৃদ্ধ নগরীর চিহ্ন বিদ্যমান। শফিকুল আসগর ও আবদুর রশীদের লেখা ‘গাজীপুর জেলার ইতিহাস’ বইয়েও লক্ষ্মী কর্ণ ও গোবিন্দ চন্দ্রের যুদ্ধ ও যুদ্ধ–পরবর্তী বিজয়ের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রাজবাড়ি নির্মাণের তথ্য পাওয়া যায়। মুনশী রহমান আলী তায়েশের ‘তাওয়ারিখে ঢাকা’ বইয়েও দুটি গ্রামের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ববিদ সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, স্থানটি পরিদর্শন করে তিনি যেমন অভিভূত হয়েছেন, তেমন দুঃখও পেয়েছেন। এত বড় একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এটা কীভাবে সম্ভব? এখান থেকে ইট ও দেয়াল তুলে নেওয়া হচ্ছে। এত বড় পুকুর তিনি কমই দেখেছেন। এগুলো উদ্ধার হওয়া দরকার। এতে পর্যটনের নতুন দ্বার উন্মুক্ত হবে। পর্যটনের মাধ্যমে শুধু সরকার নয়, দেশের প্রত্যেক নাগরিক, গ্রামের মানুষ, সবাই উপকৃত হবেন।
জেবি/এসবি