কেএনএফের শীর্ষ নেতা ‌‘নাথান বম’কে ধরতে রেড নোটিশের প্রস্তুতি


Janobani

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২:৫৮ অপরাহ্ন, ৭ই এপ্রিল ২০২৪


কেএনএফের শীর্ষ নেতা ‌‘নাথান বম’কে ধরতে রেড নোটিশের প্রস্তুতি
ছবি: সংগৃহীত

কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সশস্ত্র গ্রুপের শীর্ষ নেতা নাথান বম বছর দুয়েক ধরে নিজেকে আড়ালে রেখেছেন। বর্তমানে তিনি ভারতের মিজোরামে অবস্থান করছেন বলে জানা যাচ্ছে। বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে ব্যাংক ডাকাতি ও থানায় হামলার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে স্নাতক করা নাথান আবার আলোচনায়। এই হামলার নেপথ্যে তিনি রয়েছেন বলে ধারণা অনেকের। হঠাৎ করেই শান্ত পাগাড় অশান্ত হয়ে পড়েছে। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সশস্ত্র গ্রুপটি ব্যাংক ও অস্ত্র লুট, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর চেকপোস্টে হামলা করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই হামলার নেপথ্যে রয়েছে কেএনএফের শীর্ষ নেতা নাথান বম। যদিও দুই বছর ধরে তিনি পলাতক রয়েছেন। জানা গেছে, বর্তমানে তিনি ভারতের মিজোরামে অবস্থান করছেন। নাথানকে গ্রেফতার করতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বাংলাদেশ। তার বিরুদ্ধে থাকা মামলা ও অপকর্মের তথ্য যুক্ত করে শিগগির ইন্টারপোলকে চিঠি দেয়া হবে। এরপর রেড নোটিশ জারির প্রক্রিয়া শুরু হবে। নাথান যাতে বিশ্বের অন্য কোনো দেশে নির্বিঘ্নে পালিয়ে থাকতে না পারেন, এটা নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।


এর আগে শনিবার (৬ এপ্রিল) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বান্দরবান পরিদর্শনে যান। সেখানে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মন্ত্রী। ওই বৈঠকে নাথানের কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে নাথানের ব্যাপারে ইন্টারপোলের সহায়তা নেয়ার বিষয়টি উঠে আসে। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।


আরও পড়ুন: ‘কেএনএফের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চলছে’


প্রসঙ্গত, পাহাড়ে গোপন আস্তানায় নিয়ে জামায়াতুল আনসার আল ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার নামে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ঘটনায় নাথানের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে। চুক্তি করে টাকার বিনিময়ে ওই প্রশিক্ষণের আয়োজন করছিলেন চারুকলার প্রাক্তন ছাত্র নাথান।


নাথান বম পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যার দিকে থেকে পঞ্চম স্থানে বম জনগোষ্ঠীর সদস্য। এই জাতিগোষ্ঠীর প্রায় সবাই খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী। বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার এডেনপাড়া সড়কে নাথানের পৈতৃক নিবাস।


জনশ্রুতি রয়েছে, ২০১৭ সালের দিকে বম সম্প্রদায়ের ৪০ সদস্যকে মিয়ানমারের কোচিন রাজ্যে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠান নাথান। তারা ফেরত আসার পর পরই নাথান গোপন তৎপরতা শুরু করেন। তিনি ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র জমাও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই মনোনয়নপত্র বৈধ হয়নি। নাথানের আর নির্বাচনও করা হয়নি। ২০২২ সালের দিকে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে একটি আলাদা রাজ্য গঠনের ঘোষণা দেন তিনি। এর পর কেএনএফের কর্মকাণ্ডের নানা ছবিও পোস্ট করতে থাকেন।


২০১৮ সালে শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে বান্দরবানের একটি গির্জায় বড় ধরনের অনুষ্ঠান করা হয়। সেখানে নাথান বম উপস্থিত ছিলেন। সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথাবার্তা বলেছিলেন। তখনও কেউ ধারণা করতে পারেনি ধীরে ধীরে একটি সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের শীর্ষ নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে কিছুদিন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরির চেষ্টা করেন নাথান। এর পর একটি এনজিও চালান।


পাহাড়ের আরও একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পার্বত্য এলাকায় বম সম্প্রদায়ের প্রায় ১৫ হাজার বাসিন্দা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মিজোরামের দিকে চলে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার পরপরই বম সম্প্রদায়ের মধ্যে নাথান বমের পরিচিতি বাড়ে। পাঁচ ভাই ও এক বোন তার। ভাইবোনের মধ্যে নাথান সবার ছোট। তার স্ত্রী লেলসমকিন বম বান্দরবানের রুমা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নার্স হিসেবে কর্মরত। তবে নাথানের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে– এমন আলোচনা এলাকায় রয়েছে।


কেউ কেউ আবার বলছেন, সরকারি চাকরি থেকে যাতে ইস্তফা দিতে না হয়, এ কারণে নাথানের সঙ্গে বিয়েবিচ্ছেদের কথা প্রচার করে আসছেন তার স্ত্রী। এ ছাড়া নাথানের আরেক ভাই বান্দরবানের সোনালী ব্যাংকে চাকরি করতেন। মাস পাঁচেক আগে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, এখনও কারাগারে আছেন। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সন্দেহজনক লেনদেনের কারণে দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় তাকে।


আরেকটি সূত্র জানায়, বান্দরবানের রুমা সুসাং ও সিমপ্ল্যাকিংপাড়া থেকে কয়েক মাস আগে বম সম্প্রদায়ের ১২-১৫ জন তরুণী ঘর ছাড়ে। স্থানীয়দের ধারণা, কেএনএফের সশস্ত্র গ্রুপ কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিতে তারা ঘর ছেড়েছে। সম্প্রতি বান্দরবানে দুর্ধর্ষ ডাকাতি ও থানায় হামলায় কেএনএফের নারী সদস্যদের অংশ নিতে দেখা গেছে।


সাধারণ বম সম্প্রদায়ের মধ্যে অর্থনৈতিক ও শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া পরিবারের সদস্যদের টার্গেট করে থাকে কেএনএফ। বমপাড়ার কোনো বাসিন্দাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যদাতা বলে সন্দেহ হলে কেএনএফ তাদের ঘরবাড়িতে হামলা চালায়। ধান-চাল ও গৃহস্থালির জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। আবার অনেকের বাসায় গিয়ে খাবার ও পানি দেওয়ার জন্য চাপ দেয় তারা।


বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি জারলম বলেন, পাঁচ মাস আগে নাথানের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছিল। তখন তিনি মিজোরামে অবস্থান করছেন বলে দাবি করেন। তিনি অনেক দিন ধরেই পলাতক। তবে তার গ্রুপের লোকজন পাহাড়ে আছে। কেএনএফকে শান্তি আলোচনায় আনতে প্রথম দফা যে বৈঠক হয়েছিল, তার আগেই নাথানের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। বৈঠকে কেএনএফের পক্ষ থেকে কারা থাকবে, সেটা ঠিক করে দিয়েছিল নাথান। এর পর দীর্ঘদিন থেকে তিনি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।


বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক লালথেন বম বলেন, আমার সঙ্গে নাথান বমের এক মাস আগে কথা হয়। কেএনএফ যে ছয় দফা দাবি জানিয়ে আসছে, বাস্তবে তা পূরণ করা অসম্ভব বলে নাথানকে জানিয়েছি।


বম সম্প্রদায়ের আরেক বাসিন্দা লালভেন বম বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে সাধারণ বমরা ভীতিকর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। কেএনএফের ভয়ে কেউ কেউ মুখ খুলতে চায় না। কথা বললে তাদের বাড়িঘরে হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।


এদিকে একাধিক সূত্র জানায়, গতকাল বান্দরবানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কেএনএফের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা আলোচনা হয়। সেখানে দ্রুত করনীয় বিষয়ে আলাপ আলোচনা করা হয়। সেখানে কেএনএফকে ধ্বংস করতে অভিযান চালানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছে সূত্রটি। এছাড়া নাথান বমকে ধরতেও নানা বিষশয়ে আলোচনা হয়েছে।


আরও পড়ুন: কেএনএফের বিরুদ্ধে ইউপি চেয়ারম্যানকে অপহরণের অভিযোগ


র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) কর্নেল মাহাবুব আলম সমকালকে বলেন, ডাকাতি ও থানায় হামলায় জড়িত সবাইকে শনাক্ত করা হবে। প্রযুক্তিগত তথ্য বিশ্লেষণ ও গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তাদের আইনের আওতায় আনব। বান্দরবানের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। র‌্যাবের ফোর্স এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা সেখানে বাড়ানো হয়েছে।


রুমা থানার ওসি শাহ জাহান বলেন, লুট হওয়া ১৪টি অস্ত্র দ্রুত উদ্ধারে জোর দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য যৌথ অভিযানও চলছে।


জেবি/এজে