মতিউরের আলাদীনের চেরাগ
বশির হোসেন খান
প্রকাশ: ০৮:৫৮ অপরাহ্ন, ২৩শে জুন ২০২৪
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমানের স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকীর নামে টিলা আর কিছু জলাশয় ও ঝোপঝাড় নিয়ে নরসিংদীর রায়পুরায় গড়ে তোলেন ওয়ান্ডার পার্ক অ্যান্ড ইকো রিসোর্ট। এক অভিজাত ও দৃষ্টিনন্দন পর্যটনকেন্দ্র, যেখানে এক রাত থাকতে গেলে গুণতে হয় অন্তত ৬ হাজার টাকা। রিসোর্টের ভেতরে ঘুরে দেখা গেছে একই সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর হাতে গড়া আভিজাত্যের অপরূপ মিশেল। চারপাশে গার্ড ওয়াল, দৃষ্টিনন্দন ঘাট, পানির কৃত্রিম ঝর্ণা ও আলোর ঝলকানি। পার ঘেঁষে রয়েছে বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স কটেজ। বিদেশি শিল্পীদের নিপুণ হাতে তৈরি হয় এসব স্থাপত্য নকশা। কটেজের ভেতর থেকে সুইমিং পর্যন্ত এমন পথ নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে মাটিতে পা ফেলার প্রয়োজন নেই; সরাসরি কটেজ থেকে কাচে ঘেরা আবরণ পেরিয়ে পৌঁছানো যায় সুইমিংয়ে। এটি বিনোদন কেন্দ্র হলেও এর অন্তরালে চলে সব অসামাজিক কর্মকাণ্ড। পার্কের ভেতরে দর্শনার্থীদের বসার স্থানগুলো যেন একটি খুপরি ঘর। সে ঘরেই চলে নানা অসামাজিক কার্যকলাপ। পার্কের ভেতরে রাত্রিযাপনের জন্য রয়েছে বিলাসবহুল একাধিক কটেজ। এ ওয়ান্ডার পার্কটি ঘুরে এসে অনেকেই পার্ক সম্পর্কে নানা মন্তব্য প্রকাশ করেন।
শুধু এই এক ওয়ান্ডার পার্কই নয়, রাজস্ব বোর্ডে এই প্রভাবশালী কর্মকর্তা তার স্ত্রী ও সন্তানের নামে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাদের নামে বেশ কয়েকটি কোম্পানির খোঁজ পাওয়া গেছে অনুসন্ধানে। ঢাকা, গাজীপুর রয়েছে জমি, ফ্ল্যাট ও প্লট। ব্যাংকে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নামে এফডিআর ও কালো টাকা সাদা করতে শেয়ারবাজারে নিজ নামে শত কোটি টাকা বিনিয়োগ। তার বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার বেশি বলে ধারণা পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, বেনামে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মতিউর রহমানের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। তিনি চট্রগ্রামে কাস্টমের দায়িত্বে থাকা অবস্থা দুর্নীতির সাম্রজ্য গড়ে তোলেন। তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই চাকুরি হারানোর ভয় থাকতো। তাই কেউ কথা বলতেন না।
জানা গেছে, বসুন্ধরার ডি ব্লকের ৭ এ রোডের ৩৮৪ নম্বর ভবনের মালিক তিনি। সাত তলা ভবনের প্রথম দ্বিতীয় তলায় প্রথম স্ত্রী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চেয়ারম্যান লায়লা কানিজকে নিয়ে সপরিবারে বাস করেন। গুলশানের সাহাবুদ্দিন পার্কের পাশে ৮৩ নম্বর রোডের ১১ নম্বর প্লটে আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের বেগ পার্ক ভিউতে রয়েছে ৪টি ফ্ল্যাট। দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার থাকেন লালমাটিয়ার ৮নং রোডের ৪১/২ ইম্পেরিয়াল ভবনে। কাকরাইলেও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে ছোট স্ত্রীর নামে। এছাড়া ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে একাধিক ফ্ল্যাটের হদিস পাওয়া গেছে। বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ডেভেলপার কোম্পানি শান্তা ডেভেলপারের করা বিভিন্ন ভবনে তার ৮টি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানা গেছে। এসব ফ্ল্যাট প্রথম স্ত্রীর সন্তান ফারজানা রহমান ইপ্সিতা ও ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের নামে রয়েছে বলে সূত্র জানান। রাজস্ব এই কর্মকর্তার বেতন-ভাতা লাখ টাকার মধ্যে। কিন্তু চলা ফেরায় মনে হয় তিনি রাজ পরিবারের সন্তান।
সম্পদশালী মতিউর: গাজীপুরের পূবাইলে রিসোর্ট, শুটিং স্পট, বাংলো, জমিসহ নামে-বেনামে রয়েছে অনেক জমি ও স্থাপনা। ঢাকায় মতিউর রহমানের স্ত্রী-সন্তান ও ঘনিষ্ঠদের নামে একাধিক বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানা যায়। টঙ্গীতে ৪০ হাজার বর্গফুটের এসকে ট্রিমস নামে ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং ও অ্যাকসেসরিজ কারখানা আছে তার। যদিও কাগজ-কলমে কারখানার মালিক তার ভাই এমএ কাইয়ুম হাওলাদার। টঙ্গী পশ্চিম থানাধীন সাতাইশ তিলারগাতি এলাকায় এসকে ট্রিমস কারখানাটিতে স্কুল ব্যাগ তৈরি করা হয়। ময়মনসিংহের ভালুকার হবিরবাড়ি ইউনিয়নের ঝালপাজা মৌজায় একটি শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে তার আছে গ্লোবাল শুজ লিমিটেড নামে জুতার ফ্যাক্টরি। এখানে প্রায় ৩০০ বিঘা জমিজুড়ে রয়েছে গ্লোবাল শুজ লিমিটেড কারখানা, বাগানবাড়ি, দেশি-বিদেশি ফলের বাগান ও ফসলি জমি। জুতার ফ্যাক্টরিতে প্রায় ৪০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ ফ্যাক্টরির উৎপাদিত জুতা রপ্তানি হয় বিভিন্ন দেশে। কারখানার দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তা কর্মী মনির হোসেন জানান, ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে আসেন মতিউর রহমান স্যার। সকালে এসে বিকেলে চলে যান। ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ি ইউনিয়নের ঝালপাজা চেঁচ্চার মোড় থেকে বাম দিকে কিছুটা গেলেই দেখা মেলে মতিউর রহমানের বিশাল জুতার কারখানা। ভালুকা উপজেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মোর্শেদ আলম ওই জুতার কারখানা ও জমি দেখাশোনা করেন। স্থানীয় বাজারদরে ওই ৩০০ বিঘা জমির দাম প্রায় ১০০ কোটি টাকা। শুধু ভালুকা নয়, গাজীপুরের পূবাইলেও রয়েছে মতিউর রহমানের বিশাল সাম্রাজ্য। পূবাইলের খিলগাঁওয়ের টঙ্গী-ঘোড়াশাল সড়কের দক্ষিণ পাশে বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে তুলেছেন ‘আপন ভুবন’ পিকনিক অ্যান্ড শুটিং স্পট। এই স্পটের তত্ত্বাবধায়ক মো. মাসুদ জানান, জমি লিজ ও বার্ষিক ভাড়ায় নিয়ে ২০১৮ সালের দিকে স্পটটি চালু করা হয়। রিসোর্টটি প্রায় ২৫ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
পার্কের ম্যানেজার সৈয়দ ইমরান হোসেন সজিব বলেন, সব পেশার মানুষের বিনোদনের জন্য এই রিসোর্টটি মতিউর স্যার তৈরি করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী আমরা রুম ভাড়া দিচ্ছি। এখানে কোনো প্রকার অনৈতিক কাজ হয় না।
মতিউরের নিজ এলাকা মুলাদী উপজেলায় বাড়িঘর ছাড়াও নরসিংদীর মরজালে তার স্ত্রী উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ লাকির নামে ১০০ বিঘা জমির ওপর রয়েছে ওয়ান্ডার পার্ক অ্যান্ড ইকো রিসোর্ট। তার মেয়ে ফারজানা ইপ্সিতার নামে মরজাল বাসস্ট্যান্ড ও আশপাশ এলাকায় ১০ বিঘা জমি রয়েছে। এ ছাড়া ছেলে তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও মেয়ে ইপ্সিতার নামে ৫০ বিঘা জমি রয়েছে। নাটোরের সিংড়ায় ২০ বিঘা জমি রয়েছে। স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকির নামে নরসিংদীর রায়পুরার মরজালে ৪ বিঘা জমির ওপর রয়েছে অট্টালিকা। এ ছাড়া গাজীপুর সদর, খিলগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় ৬০ শতাংশ জমি আছে। সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় ১২ দশমিক ৫৮ শতক জমি রয়েছে। লায়লা কানিজের নামে সাভার থানার বিলামালিয়ায় ১৪ দশমিক ০৩ শতাংশ জমি রয়েছে। এনবিআর কর্মকর্তা মতিউরের ছেলে ইফাত পার্ল কালারের প্রাডো মডেলের যে গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৫-৯৩২৭) ব্যবহার করেন, তার মালিকানা এসকে ট্রিম অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে। এটি গার্মেন্ট সরঞ্জাম তৈরি ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। টঙ্গীতে এ প্রতিষ্ঠানের কাগজে-কলমে মালিকানায় মতিউর রহমানের ছোট ভাই এমএ কাইয়ুম হাওলাদার। প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ১৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ শেয়ারের মালিক তিনি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকও তিনি। আবার প্রাডো গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নথিতে এসকে ট্রিম ইন্ডাস্ট্রিজের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে নিকেতনের ই-ব্লক, ৮ নম্বর রোডের ৩৪ ও ৩৬ নম্বর প্লটে অবস্থিত মুন আইল্যান্ড নামক ভবনের স্যুট নম্বর ৮। ইফাত ও তার মা শাম্মী আখতার প্রিমিও মডেলের (ঢাকা মেট্রো-গ ৩২-৬২৩৯) যে গাড়ি ব্যবহার করেন, সেটির মালিকানা গ্লোবাল ম্যাক্স প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে। নিকেতনের একই ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। মতিউরের মেয়ে ফারজানা রহমান ইপ্সিতার বিলাসী জীবনের খোঁজ মিলেছে কানাডায়। শেয়ারবাজারে ‘জুয়ারী’ হিসাবে পরিচিত মতিউরের রয়েছে বিপুল বিনিয়োগ। এই কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশন চার দফা টিম গঠন করলেও রহস্যজনক কারণে প্রতিবারই অভিযোগ পরিসমাপ্তির নামে তাকে ‘ক্লিনচিট’ দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, ধানমন্ডির ৮ নম্বর রোডের ৪১/২ নম্বরে অবস্থিত ইম্পেরিয়াল সুলতানা ভবনের পাঁচতলায় পুরো ফ্লোর স্ত্রী শাম্মী আখতারের নামে কিনে সাজানো হয় নজরকাড়া ইন্টেরিয়রে। প্রায় দুই কোটি টাকার সাজসজ্জার কাজের মধ্যে ৪০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয় শুধু রান্নাঘরের সৌন্দর্যবর্ধনে।
এ ব্যপারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমান বলেন, আমি সব সম্পদ করেছি বৈধভাবে আমি শেয়ারবাজের বিনোয়োগ করেছি। সেই আয় দিয়ে আমার এই সম্পদ। আমার আয় একদম বৈধ। তিনি আরো বলেন, গত মাসে আমি আয় করেছি ৩ কোটি টাকার বেশি। আর এ সব আয় ট্যাক্স ফাইলে দেওয়া আছে। আমার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ সব মিথ্যা। বৈধ পথে আয় করে সম্পদ করেছি।
এ ব্যাপারে মতিউরের ভাই কাইয়ুম হাওলাদার বলেন, আমি এ বিষয় কোনো কথা বলতে পারবো না। আমি ব্যস্ত আছি। এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পরিসমাপ্তি হলে যে নতুন করে অনুসন্ধান করা যাবে না তার বিধান নেই। কাজেই এখন নতুন করে যেহেতু বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে সেহেতু আমরা আশা করব দুদক বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবে।
জেবি/এসবি