চালসহ সব নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, সাধারণ মানুষ কী খাবে?


Janobani

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪:৫২ অপরাহ্ন, ১৩ই জুলাই ২০২৪


চালসহ সব নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, সাধারণ মানুষ কী খাবে?
ছবি: সংগৃহীত

চালসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম আরেক দফা বৃদ্ধি পেয়েছে। এবার রাজধানীসহ সারাদেশে বৃষ্টির অযুহাতে দাম বাড়িয়েছে ব্যবসায়ীরা। এ দফায় চালের দাম কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া সবজি, মাছ- মাংস থেকে শুরু করে মুরগি-ডিমের দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাজার বিশ্লেষকেরা ভাষ্যমতে, এভাবে দফায় দফায় পণ্যমূল্য বাড়লে কী খাবে সাধারণ মানুষ। সীমিত আয়ের মানুষের জীবন এখন ওষ্ঠাগত। 


এবার নতুন করে বৃদ্ধি পেয়েছে প্রধান খাদ্য চালের দাম। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি চালে ৩ থেকে ৪ টাকা বাড়তি দাম গুনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। এতে সবচেয়ে বেশি নাজেহাল নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ।


শুক্রবার (১২ জুলাই) রাজধানীর একটি বাজারে কথা হয় বেসরকারি অফিসে কর্মরত লাল মোহনের সঙ্গে। তিনি বললেন, “অনেকদিন ধরেই সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়তি। এর মধ্যে চালের দাম আরও বাড়ার বিষয়টি ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। মোহন জানান, নিয়মিতই মাঝারি মানের বিআর-২৮ চাল কিনে থাকেন। এতোদিন প্রতি কেজি বিআর-২৮ চাল কিনতেন ৫৬ টাকায়। এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা। কেজিপ্রতি বেড়েছে ৪ টাকা। ওই বাজারে শিমুল রাইস এজেন্সি নামে দোকানের বিক্রেতা সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, “মোকামে প্রতি বস্তা চালে ২০০ টাকা বেড়েছে। আমরা যেভাবে কিনছি, সেভাবেই বিক্রি করছি।”



তিনি জানান, গেল এক সপ্তাহে প্রায় সব ধরনের চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন মিনিকেট ৭২ থেকে ৭৫ টাকা, নাজিরশাইল ৭৫টাকা ৮০ টাকা, পাইজাম ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা আগের চেয়ে কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা বেশি।


এদিকে, গেল  সপ্তাহ থেকে সবজির বাজারে যে অস্থিতিশীলতা, সেটা এখনো কাটেনি বরং সব ধরনের সবজির দাম আরও বেড়েছে। দেশের কয়েকটি এলাকায় বন্যা ও টানা বৃষ্টির কারণে সবজির দাম হু-হু করে বাড়ছে বলে জানান বিক্রেতারা। শুক্রবার সকাল থেকেই ভারি বৃষ্টির কারণে বাজারে সবজির সরবরাহ কম ছিল। সকালে ক্রেতাদের আনাগোনাও ছিল কম। নিচু এলাকার বাজারগুলোয় পানি জমে যায়। অনেকে বাজারে এসে পড়েন ভোগান্তিতে। স্বস্তি ফেরেনি পেঁয়াজ ও আলুর দামেও। বিভিন্ন বাজারে  শুক্রবার পেঁয়াজের কেজি ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা।


অপরদিকে, ব্রয়লার মুরগির দাম সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বাজারে আগের দিন ব্রয়লার বিক্রি হয় ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায়, শুক্রবার বিক্রি হয় ২০০ থেকে ২১০ টাকায়। ফার্মের মুরগির ডিমের দামও কমেনি। প্রতি ডজন বিক্রি হয় বাজারভেদে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়।


ব্রয়লারের দাম বেড়েছে ৩০ টাকা বাজারে গরু- খাসির তুলনায় ব্রয়লার মুরগির চাহিদা বেশি, যে কারণে দামও অনেকটা বাড়তি। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, “টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে মুরগির দামে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। তবে ক্রেতারা বলছেন, অন্যান্য মাংসের তুলনায় মুরগির চাহিদা বেশি থাকায় ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। গতকাল শুক্রবার বিভিন্ন বাজারে গিয়ে এসব চিত্র দেখা গেছে।”


বাজারে প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়াও সোনালী মুরগি প্রতি কেজি ৩২০ টাকা, কক প্রতি কেজি ৩৫০ টাকা, লেয়ার প্রতি কেজি ৩৩০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে আগের বাড়তি দামেই প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৮০ টাকায় এবং খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১১০০ টাকা। এর আগে ৫ জুলাই একই বাজারের একই দোকানগুলোতে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছিল প্রতি কেজি ১৮০ টাকায় এবং তারও আগের সপ্তাহে ১৭০ কেজিতে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই সপ্তাহের ব্যবধানেই কেজিপ্রতি ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত।


আল জুবায়ের নামে এক ক্রেতা বলেন, বাসায় এখনও পর্যাপ্ত কোরবানির মাংস রয়ে গেছে। এরপরও মুরগির মাংসটা কিনতে হয়। মুরগির চাহিদা একটু বেশি থাকে। এই সুযোগটাই ব্যবসায়ীরা নিচ্ছেন।


তিনি বলেন, “সপ্তাহখানেক আগেও মুরগি ছিল ১৭০ টাকায়, এখন কী এমন হলো যে কেজিপ্রতি ২০ টাকা দাম বাড়াতে হলো? এসবের কোনো জবাব ব্যবসায়ীদের কাছে নেই। কিছু বললে উল্টো তারা বলে নিলে নেন, না হয় বাদ দেন।”


আবুল কালাম নামের এক ক্রেতা বলেন, আমরা যারা মেসে থেকে পড়াশোনা করি, আমাদের অনেকটাই মুরগির মাংসের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। কিছুদিন আগে দামটা কমেছিল, আমরাও একটু স্বস্তিতে ছিলাম। এখন দেখছি আবার দাম বেড়ে যাচ্ছে।


গরুর মাংস বিক্রেতা শান্ত ইসলাম বলেন, “কোরবানির পর গরুর মাংসের চাহিদা খুবই কম থাকে। যে কারণে দামটাও কম থাকে। বাজারে গরুর মাংস বিক্রি করছি ৭৮০ টাকা, খাসির মাংস ১১০০ টাকা। কলিজা বিক্রি করছি ৭৮০ টাকা করে। এছাড়াও গরুর পায়া ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত জোড়া বিক্রি করছি।”


আরও পড়ুন:  সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিতে ৩০ টাকা



এদিকে মুরগি বিক্রেতারা বলেন, “গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে মুরগির সরবরাহ কিছুটা কম। যে কারণে দামটাও একটু বেশি। তাছাড়া সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মাংসের চাহিদাটা একটু বেড়ে যায়, বাজারে যদি সেই পরিমাণে সরবরাহ না থাকে, তাহলেই দাম বেড়ে যায়, এখানে আমাদের কিছুই করার থাকে না। বরবটি-করলা ১৪০, বেগুনের সেঞ্চুরি: মৌসুম শেষ, বৃষ্টি ও কোটাবিরোধী আন্দোলন এমন বেশকিছু অজুহাতে রাজধানীতে সব ধরনের সবজির দাম বেড়েছে। বাজারে করলা-বরবটি বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়। আর বেগুন, কচুর মুখি ও কাঁকরোলের কেজি সেঞ্চুরিতে গিয়ে ঠেকেছে।”


সবমিলিয়ে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বৃষ্টির কারণে আবহাওয়া ঠান্ডা থাকলেও সবজির বাজার আজ বেশ গরম। শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। এদিন বাজারে প্রতি কেজি টমেটো বিক্রি হয় ২০০ টাকায়। এছাড়া পেঁপে প্রতি কেজি ৬০ টাকা, বেগুন প্রতি কেজি ১০০ টাকা, ঝিতে প্রতি কেজি ৬০ টাকা, কচুর লতি প্রতি কেজি ১০০ টাকা, ধুন্দল প্রতি কেজি ৭০ টাকা, বরবটি প্রতি কেজি ১৪০ টাকা, কাকরোল ১০০ টাকা, পটোল প্রতি কেজি ৬০ টাকা, করলা প্রতি কেজি ১৪০ টাকা, শসা প্রতি কেজি ৮০ টাকা, ঢেড়শ প্রতি কেজি ৭০ টাকা, কচুর মুখি প্রতি কেজি ১০০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া প্রতি কেজি ৪০ টাকা ও কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতারা বলেন, মাছ মাংসের কথা তো বাদই দিলাম, এত দাম দিয়ে সবজি কেনাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। করলা-বরবটির দাম ১৪০ টাকা, গাজর ২০০ টাকা, বেগুন-কাকরোল ১০০ টাকা।


আরও পড়ুন: গ্যাস সমস্যার সমাধান হবে কবে, জানালেন প্রতিমন্ত্রী


এই যদি হয় সবজির দাম, তাহলে কি সাধারণ ক্রেতা সবজি কিনে খেতে পারে? বাজারের আরেক ক্রেতা লাবলু মিয়া বলেন, “যেখানে এক কেজি সবজি কিনতাম, বাজারে বাড়তি দামের কারণে আধা কেজি করে সবজি কিনলাম। সব ধরনের সবজির দাম অতিরিক্ত বেশি। এত দাম দিয়ে সাধারণ মানুষের সবজি কিনে খাওয়া সম্ভব নয়। প্রতিদিনই সবজির দাম বাড়ছে, কিন্তু এর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কেউ কি বাজার মনিটরিং করে না? হুটহাট এভাবে দাম বেড়ে যায়, যা কমার কোনও নামই থাকে না। বাজার নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং করা যাদের কাজ, তারা আসলে কী করে। ”


সবজি বিক্রেতা রমজান আলী বলেন, কারওয়ান বাজার থেকে বেশি দাম দিয়ে সব সবজি কিনতে হয়েছে। কয়েক দিন ধরে পাইকারি বাজারে সবজির দাম বাড়তি যাচ্ছে। এরপর পরিবহন খরচ, রাস্তা খরচ ও দোকান খরচ সবমিলিয়ে আমাদের খরচটা আরও বেশি পড়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব খুচরা বাজারে এসে পড়ছে। গতকাল বাজারে সবচেয়ে বেশি দাম ছিল টমেটোর। এরপর বরবটি, করলা, বেগুন, কচুর লতি ও গাজরের দাম বেশি যাচ্ছে।


সবজির বাড়তি দামের বিষয়ে কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা ফরিদুল ইসলাম বলেন, এখন বেশিরভাগ সবজির মৌসুম শেষ হয়ে গেছে। যে কারণে বাজারে সরবরাহ কম। নতুন সবজি ওঠার আগ পর্যন্ত এসবের দাম বাড়তি থাকবে। এছাড়া টানা বৃষ্টিতে সবজির গাছের ক্ষতি হয়েছে, ফলে বাজারে সরবরাহ কমেছে। আরেকটি দিক হলো কয়েকদিন ধরে টানা ছাত্র আন্দোলনের কারণে যানচলাচল বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সবজি পরিবহনে এর প্রভাব পড়েছে। সবমিলিয়ে বর্তমানে সবজির দাম বাড়তি যাচ্ছে।


এছাড়া মাছের দামও চড়া সবজির পাশাপাশি বাজারের সব ধরনের মাছের দাম চড়া। বাজারে প্রতি কেজি পাঙাশ মাছ ২০০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তেলাপিয়া প্রতি কেজি ২২০ থেকে ২৫০ টাকা, রুই প্রতি কেজি ৩৫০ টাকা, কাতল প্রতি কেজি ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা ও শিং প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।


এছাড়া টেংরা প্রতি কেজি ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা, পাবদা প্রতি কেজি ৪৮০ থেকে ৫০০ টাকা, চিংড়ি প্রতি কেজি ৭০০ টাকা, কই প্রতি কেজি ২৪০ থেকে ২৬০ টাকা ও বোয়াল প্রতি কেজি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।


জেবি/এসবি