মানুষকে কেন পশুর মতো খাঁচায় ভরে রাখবে: ড. ইউনূস


Janobani

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩:২৯ অপরাহ্ন, ১৫ই জুলাই ২০২৪


মানুষকে কেন পশুর মতো খাঁচায় ভরে রাখবে: ড. ইউনূস
ছবি: সংগৃহীত

গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এটা মানবতার প্রতি অপমান। মানুষকে কেন পশুর মতো খাঁচায় ভরে রাখবে? এটা বিচারের বিষয় না, কিচ্ছু না। এটা নেহাত একটা অপমান করার বিষয়। সারা জাতিকে অপমান করার বিষয়। কাজেই জাতি অপমান থেকে মুক্ত হতে চায়।


সোমবার (১৫ জুলাই) গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক কর্মচারীদের সংরক্ষিত ফান্ডের লভ্যাংশের ২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে করা মামলায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এ হাজিরা শেষে আদালত চত্বরে তিনি এসব কথা বলেন।


আরও পড়ুন: ড. ইউনূসের জামিনের মেয়াদ বাড়লো


তিনি বলেন, এ খাঁচাটাই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া উচিত। কারো জন্যই এটা প্রয়োজন পড়ে না। এটা আদালতে রাখা মানেই হলো তোমাকে অপমান করার জন্য এখানে রেখেছি। এখানে তো বিচারের জন্য এসেছি, অপমান হওয়ার জন্য তো আসিনি।


আপনি কি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. ইউনূস বলেন, কিছু একটার শিকার তো হচ্ছি, এটা তো পরিষ্কার। সেটা হিংসা বলেন প্রতিহিংসা বলেন বিদ্বেষ বলেন সবকিছু মিলিয়েই হচ্ছি। এসময় তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ভিত্তি নাই বলেও দাবি করেন ড. ইউনূস।


এদিন সাক্ষ্যগ্রহণ পিছিয়ে পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের মাঝে পাল্টাপাল্টি শুনানি ও বাকবিতণ্ডা হয়।


শুনানি শেষে ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, মামলাটি উচ্চ আদালতে শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ আছে। আগামী ২১ জুলাই এ বিষয়ে আদেশের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। আমরা আজ আদালতকে বলি, আগামী ১৪ আগস্ট ফ্রান্সে অলিম্পিকের উদ্বোধনের জন্য প্রধান অতিথি হিসেবে ড. ইউনূস যাবেন। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা। এজন্য এরপরে একটা তারিখ দেন। কিন্তু তিনি সময় দিলেন পাঁচদিন। আমি বললাম, আপনার সামনে যে কেইস ডায়েরিটা আছে তাতে অন্য মামলার ডেট দেওয়া হচ্ছে একমাস, দুইমাস, আড়াই মাস পর। সেখানে ড. ইউনূসের মামলায় এমন কী ব্যাপার যে, পাঁচদিন সাতদিন পর ডেট দিতে হবে? যদি আপনি মনে করেন ড. ইউনূস একজন দাগী আসামি তাহলে এ মামলাটা আপনি দ্রুত বিচার আদালতে দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।


দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, আজ আসামিপক্ষ বলেছে তারা এ মামলাটাকে কোয়াশমেন্টের জন্য উচ্চ আদালতে গিয়েছে। কোনো স্টে অর্ডার নেই, আদেশ নেই। তবে ২১ তারিখ নাকি এটার একটা আদেশ হবে। এজন্য তারা বলছেন যে, মামলার কার্যক্রম বন্ধ রাখেন। নয়তো সাক্ষ্য নিয়ে নিলে তাদের কোয়াশমেন্টের ম্যাটারটা কার্যকরী থাকবেনা৷ আজকের দিনটা ছিল সাক্ষ্যের জন্য। সাক্ষীকে আমরা অত্র আদালতে হাজির করেছি। সাক্ষীর বর্তমান পোস্টিং ময়মনসিংহে। গতকাল তিনি ঢাকায় এসেছেন। তারা সাক্ষ্য পরিবর্তন করার জন্য আবেদন করেছেন। তাদের আসামি বিদেশে যাবেন নাকি অলিম্পিকে যাবেন।


তিনি আরও বলেন, তিনি না থাকলেও তো মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। কিন্তু তাদের কথা হলো আমরা থাকবো, লম্বা সময় নেবো এবং মামলার কার্যক্রম বিঘ্নিত করবো। তো মাননীয় আদালত তাদের কথা শুনেছেন।


আরও পড়ুন: ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে রংপুরের মামলা হাইকোর্টে স্থগিত


প্রসিকিউশন পক্ষ আদালতকে প্রভাবিত করছে আসামিপক্ষের এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আদালতকে আমরা কীভাবে প্রভাবিত করবো তাতো আমরা জানি না৷ সাক্ষীর তারিখ ছিল। সাক্ষী নিয়ে আসছি। ওনাদের মুখে ও শরীরে অনেক শক্তি। কাজেই ওনারা যা মনে চায় তাই বলছেন। আমাদের তো কিছু বলার নেই।


এদিন আদালতে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য ছিল। ড.ইউনূসসহ ১৪ জন আদালতে হাজিরা প্রদান করেন। মামলার বাদী সাক্ষ্য দিতে আদালতে উপস্থিত হন। এরপর অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে মামলাটি উচ্চ আদালতে শুনানির অপেক্ষায় থাকায় সাক্ষ্য গ্রহণ পেছানোর জন্য আসামি পক্ষের আইনজীবীরা আবেদন করেন। অপর দিকে দুদকের প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল মামলাটির সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আদালতে শুনানি করেন। তিনি বলেন,মামলাটি উচ্চ আদালতে শুনানির অপেক্ষা থাকলেও সাক্ষ্য দেওয়া যায়। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক আগামী ৫ আগস্ট পরবর্তী দিন ধার্য করেন।


২০২৩ সালের ৩০ মে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। সংস্থাটির উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বাদী হয়ে মামলাটি করেন।


২০২৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার। দুদকের মামলায় আসামি ছিলেন ১৩ জন। চার্জশিটে নতুন একজন আসামির নাম যুক্ত হয়েছে।


আসামিদের বিরুদ্ধে ৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। গত ২ এপ্রিল ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আস সামছ জগলুল হোসেনের আদালত এ চার্জশিট গ্রহণ করে মামলার বিচারের জন্য ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এ বদলির আদেশ দেন।গত ১২ জুন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক সৈয়দ আরাফাত হোসেন আসামিদের অব্যাহতির আবেদন খারিজ করে তাদের অভিযোগ গঠন করেন।


মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আসামিরা ২৫ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন। সদস্যদের উপস্থিতিতে ২০২২ সালের ৯ মে অনুষ্ঠিত ১০৮তম বোর্ডের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখায় হিসাব খোলা হয়। গ্রামীণ টেলিকমের কর্মচারীদের পাওনা লভ্যাংশ বিতরণের জন্য গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন এবং গ্রামীণ টেলিকমের সঙ্গে সেটেলমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট চুক্তি হয় ওই বছরের ২৭ এপ্রিল।


গ্রামীণ টেলিকমের বোর্ড সভার হিসাব খোলার সিদ্ধান্ত ৯ মে হলেও হিসাব খোলা হয় একদিন আগে ৮ মে। সেটেলমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্টেও ৮ মে ব্যাংক হিসাব দেখানো আছে, যা বাস্তবে অসম্ভব। এরকম ভুয়া সেটেলমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্টের শর্ত অনুযায়ী ও ১০৮তম বোর্ডের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০২২ সালের ১০ মে গ্রামীণ টেলিকমের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের মিরপুর শাখা থেকে ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখায় ৪৩৭ কোটি ১ লাখ ১২ হাজার ৬২১ টাকা স্থানান্তর করা হয়।


পরবর্তী সময়ে ২২ জুন অনুষ্ঠিত গ্রামীণ টেলিকমের ১০৯তম বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অ্যাডভোকেট ফি হিসেবে অতিরিক্ত ১ কোটি ৬৩ লাখ ৯১ হাজার ৩৮৯ টাকা প্রদানের বিষয়টি অনুমোদন দেওয়া হয়। অন্যদিকে ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখার হিসাব থেকে গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন নামীয় ডাচ-বাংলা ব্যাংকের লোকাল অফিসের হিসাব থেকে তিন দফায় মোট ২৬ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা স্থানান্তর করা হয়।


কিন্তু কর্মচারীদের লভ্যাংশ বিতরণের আগেই তাদের প্রাপ্য অর্থ তাদের না জানিয়ে অসৎ উদ্দেশে ২০২২ সালের মে ও জুন মাসের বিভিন্ন সময়ে সিবিএ নেতা মো. কামরুজ্জামানের ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মিরপুর শাখার হিসাবে মোট ৩ কোটি টাকা, সিবিএ নেতা মাইনুল ইসলামের হিসাবে ৩ কোটি ও সিবিএ নেতা ফিরোজ মাহমুদ হাসানের ডাচ-বাংলা ব্যাংক মিরপুর শাখার হিসাবে ৩ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়।


আরও পড়ুন:  ড. ইউনূসের দণ্ড স্থগিতের আদেশ হাইকোর্টে বাতিল


একই ভাবে অ্যাডভোকেট মো. ইউসুফ আলীর কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনের ধানমন্ডি শাখার হিসাবে ৪ কোটি টাকা ও দ্য সিটি ব্যাংকের গুলশান শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ সংবলিত একটি প্রতিবেদন দুদকে পাঠানো হয়। ওই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ২০২২ সালের ২৮ জুলাই অনুসন্ধান শুরু হয়।


আসামিরা হলেন, গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাজমুল ইসলাম, পরিচালক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান, পরিচালক পারভীন মাহমুদ, নাজনীন সুলতানা, মো. শাহজাহান, নূরজাহান বেগম ও পরিচালক এস. এম হাজ্জাতুল ইসলাম লতিফী।


এছাড়া অ্যাডভোকেট মো. ইউসুফ আলী, অ্যাডভোকেট জাফরুল হাসান শরীফ, গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো. কামরুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসান ও প্রতিনিধি মো. মাইনুল ইসলাম, দপ্তর সম্পাদক কামরুল ইসলামকে আসামি করা হয়েছে।


জেবি/এজে