যার কাছে থাকে কাবা শরীফের চাবি
ইসলাম ডেস্ক
প্রকাশ: ০৩:৫১ অপরাহ্ন, ২৪শে জুলাই ২০২৪
পবিত্র কাবা শরিফ অবস্থিত সৌদি আরবের পবিত্র নগরী মক্কায়। শতাব্দীর পর শতাব্দী বিভিন্ন ধরনের বিশেষ তালা ও চাবির ব্যবহার হয়ে আসছে কাবা শরিফে। আর প্রাক ইসলামি যুগ থেকে এখন পর্যন্ত পবিত্র কাবা শরিফের চাবির দায়িত্ব একটি পরিবারের কাছেই রয়েছে, যা এখনো বর্তমান।
এই সম্মানিত পরিবারটি হলো মক্কার বনু তালহা গোত্র। এই গোত্রের সদস্যরা এ পবিত্র দায়িত্ব পালন করে আসছেন প্রায় ১৫০০ বছর ধরে। বনু তালহা গোত্রের সবচেয়ে মুরব্বি তথা বয়স্ক সদস্যরাই উত্তরাধিকার সূত্রে এ দায়িত্ব প্রাপ্ত হন এবং সম্মানের সঙ্গে আমৃত্যু এ দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
সম্প্রতি গত ২২ জুন পবিত্র কাবা ঘরের চাবি রক্ষক ডক্টর শায়খ সালেহ বিন জাইন আল আবিদিন আশ শায়বা ইন্তেকাল করেন। কাবা শরিফের চাবির ১০৯তম সংরক্ষক ছিলেন তিনি। এরপর কাবা ঘরের নতুন চাবি রক্ষকের দায়িত্ব পেয়েছেন তার ভাই শায়খ আবদুল ওয়াহাব বিন জাইন আল আবিদিন আশ শায়বা।
সালেহ বিন জাইনের মৃত্যুর পর তাদের বংশের প্রবীণতম সদস্য হিসেবে শায়খ আবদুল ওয়াহাব আশ শায়বা এ দায়িত্ব পেলেন। তার নিয়োগ চূড়ান্ত করেছে সৌদি রাজকীয় আদালত। বহু শতাব্দী যাবৎ তার পরিবার এই চাবি রক্ষার দায়িত্ব পালন করে আসছে।
বিশ্বাস করা হয়, ইসলামের নবী মোহাম্মদের সময়ে এই চাবি পেয়েছিল তার পরিবার। সেই সময় থেকে তাদের কাছে রয়েছে কাবা শরীফের দরজার চাবি।
আরও পড়ুন: ইসলামে জালেম ও জুলুমের ভয়াবহ পরিণতি
কাবা শরীফের চাবির দায়িত্ব
কাবা শরীফে প্রবেশ করার জন্য একটি মাত্র দরজা রয়েছে, যাকে বলা হয় বাব-ই-কাবা। মেঝে থেকে দুই দশমিক ১৩ মিটার উচ্চতায় থাকা এই দরজা কাবার উত্তর-পূর্ব দেয়ালের কাছে এবং হাজরে আসওয়াদ নামের কালো পাথরের খুব কাছাকাছি অবস্থিত যেখান থেকে তাওয়াফ শুরু হয়। ওমরাহের সময় হজ তীর্থযাত্রীরা চুম্বন করেন এই কালো পাথরে এবং তারপরে কাবা প্রদক্ষিণ করেন, যাকে তাওয়াফ বলা হয়।
কাবার চাবির রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে ইসলামি ইতিহাসবিদরা জানান, মহানবীর জন্মের পর কুরাইশ গোত্রকে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। যে পরিবারে নবী জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই বনি হাশিম পরিবার জমজমের কূপের মালিক ছিল এবং এর চাবিও ছিল তাদের কাছেই। আর কাবার চাবি ছিল উসমান বিন তালহার কাছে।
ইসলামের ইতিহাস অনুযায়ী, মক্কা বিজয়ের পর চাবিটি কিছু সময়ের জন্য উসমান বিন তালহার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হয়েছিল কিন্তু পরে আল্লাহর নির্দেশে তাকেই আবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ইতিহাসবিদরা বলছেন, এই চাবি উসমান বিন তালহাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মহানবী (সাঃ) নিজেই।
সে সময় থেকেই উসমান বিন তালহার পরিবারে রয়েছে কাবার দরজার চাবি । প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই চাবিকে সুরক্ষিত রেখেছেন তারা। উল্লেখ করা হয়, ইসলামের নবী এই চাবি ওসমান বিন তালহাকে দিয়ে বলেছিলেন, "কাবার এই চাবি সর্বদা আপনার কাছে থাকবে এবং অন্যায়কারী ছাড়া কেউ আপনার কাছ থেকে এই চাবি নিতে পারবে না।"
কাবার দরজা
কাবা শরীফের দরজা নিয়ে ১৯৪২ সালের আগের কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ১৯৪২ সালে ইব্রাহিম বদর একটি রূপার দরজা তৈরি করেন বলে জানা যায়। এরপর ১৯৭৯ সালে ইব্রাহিম বদরের ছেলে আহমেদ বিন ইব্রাহিম বদর কাবার জন্য একটি সোনার দরজা নির্মাণ করেন।
তিনশো কেজি সোনা দিয়ে তৈরি এই দরজা
কাবার সাবেক পৃষ্ঠপোষক শেখ আবদুল কাদিরের শাসনকালে শাহ আবদুল্লাহর নির্দেশে কাবার তালা বদলানো হয়। শাহ আবদুল্লাহর পক্ষ থেকে তৎকালীন প্রিন্স খালিদ আল-ফয়সাল কাবা পরিষ্কার করার সময় নতুন তালা ও চাবি শেখ আবদুল কাদিরের হাতে তুলে দেন।
দীর্ঘ অসুস্থতার পর শেখ আবদুল কাদিরের মৃত্যু হয়। এরপর ড. সালেহ বিন জয়নুল আবেদিন আল-শেবি এই চাবি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেন। ইতিহাস বলছে এর আগেও অনেক শাসক বহুবার কাবার তালা ও চাবি বদলেছেন।
আরও পড়ুন: কারবালার ময়দানে কি বলেছিলেন হয়রত ইমাম হোসেন (রাঃ)
ঐতিহ্যগতভাবে, কাবার চাবি যে ব্যাগে রাখা হয় তার গায়ে কোরানের আয়াতের নকশা করা আছে।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তালা খোলা ও বন্ধ করার মধ্যেই কাবার চাবি রক্ষকের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তবে সৌদি আরবে আসা রাজ অতিথিদের জন্য সৌদি আরবের বাদশাহের কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা আপদকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত সৈন্যবাহিনী চাবি ব্যবহার করে এই তালা খুলতে পারে।
এছাড়া ইসলামি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মহররম মাসের প্রতি ১৫ তারিখে বাদশাহের আদেশে চাবির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি এই দরজা খুলে দেন, যাতে কাবা শরীফের ভেতরটা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা হয়।
কাবার তালা ও চাবি
কাবার বর্তমান তালা ও এর চাবি ১৮ ক্যারেট সোনা ও নিকেল দিয়ে তৈরি। এছাড়া তালা এবং চাবিতে কুরানের আয়াতও লেখা আছে। সৌদি আরবে এই চাবির যে অনুলিপি রয়েছে তা খাঁটি সোনা দিয়ে তৈরি।
তুরস্কের জাদুঘরে ৪৮টি চাবি রয়েছে, যা অটোমান সাম্রাজ্যের তৎকালীন শাসকরা কাবার দরজা খোলার জন্য ব্যবহার করতেন। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের একটি জাদুঘরে রয়েছে ২টি চাবি এবং মিসরের রাজধানী কায়রোর ইসলামি আর্ট জাদুঘরে রয়েছে ১টি চাবি। এ ছাড়া কাবার ৫৮টি চাবি বিভিন্ন জাদুঘরে রাখা আছে।
চাবির নিলাম
দ্বাদশ শতাব্দীর কাবা শরীফের একটি চাবি ২০০৮ সালে নিলামে এক কোটি ৮১ লক্ষ ডলারে বিক্রি হয়েছিল। লন্ডনে ইসলামি বিশ্বের নিদর্শনগুলির নিলামের সময় অজ্ঞাত এক ক্রেতা সেই চাবি কেনেন।
নিলামে ওঠা কাবার চাবি লোহার তৈরি। এর দৈর্ঘ্য ছিল পনের ইঞ্চি। চাবিতে লেখা আছে, 'এটি আল্লাহর ঘরের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত।' লন্ডনে নিলামে ওঠা কাবার চাবিই একমাত্র চাবি যা কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।
জেবি/আজুবা