আন্দোলনকারীদের দমনে ছাত্রলীগকে ফ্রি খাওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন ঢাকা কলেজ অধ্যক্ষ
ক্যাম্পাস প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৩:১৩ অপরাহ্ন, ১১ই আগস্ট ২০২৪
আল জুবায়ের: ক্যাম্পাস প্রতিনিধি: কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দমনে সব হলের ছাত্রলীগকে রাতে ফ্রি খাওয়ানো ও ফ্রি চিকিৎসা ব্যবস্থা করানোর অভিযোগ উঠেছে রাজধানীর ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ-উপাধ্যক্ষ প্রফেসর এটিএম মইনুল হোসেন ও আট হোস্টেল সুপারদের বিরুদ্ধে।
অভিযুক্ত হোস্টেল সুপাররা হলেন, উত্তর ছাত্রাবাসের ওবায়দুল করিম, শহিদ ফরহাদ ছাত্রাবাসের নাসির উদ্দিন, আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসের কামরুজ্জামান, ইলিয়াস ছাত্রাবাসের মাহমুদুল হাসান সবুজ, দক্ষিণ ছাত্রাবাসের আনোয়ার মাহমুদ, বিজয় ২৪ ( পূর্ব নাম শেখ কামাল) ছাত্রাবাসের রফিকুল ইসলাম, দক্ষিণায়ন ছাত্রাবাসের কাজী জাহাঙ্গীর।
কলেজের একাধিক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারি বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।তারা জানান, চিকিৎসার জন্য তাৎক্ষণিক নগদ ৫০ হাজার টাকা ছাত্রলীগকে দেয়া হয়। এছাড়াও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের জন্য সব হলের খাবার ফ্রি করে দেন অধ্যক্ষ এবং নির্দেশনা দেন যার যা কিছু লাগবে আমি দেবো, আমি তোমাদের সাথে আছি। এসব করা হয়েছে হোস্টেল সুপারদের ইন্ধনে বলেও জানা যায়।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, যখন আমরা সাইন্সল্যাবে বসে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ করছি তখন আমাদের অধ্যক্ষ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে ফোন করে ক্যাম্পাসে আসতে বলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিএনসিসি সদস্য বলেন, আন্দোলনের দিন আমি আমার বন্ধুদের সাথে সাইন্সল্যাবে ছিলাম, একদিকে আমরা অন্যদিকে পুলিশ-ছাত্রলীগ-যুবলীগ। এমন সময় আমার একজন শিক্ষক ফোনে বলেন, কোথায় তোমরা প্রিন্সিপাল স্যারের নির্দেশ দ্রুত ক্যাম্পাসে আসো ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী আহত তাদেরকে চিকিৎসা দিতে হবে।
এছাড়াও কলেজের ময়লা-আবর্জনার ব্যবহৃত গাড়িতে ইট-পাথর এনে কলেজের শহিদ মিনারের সামনে রাখেন। কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের এসব পাথর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপরে নিক্ষেপ করারও পরামর্শ দেন তিনি।
জানা যায়, ছোট ছোট ভ্যানগাড়িতে করে ইট-পাথর আনেন অধ্যক্ষ। এরপর সেগুলো প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে কলেজের আইসিটি ভবনের ছাদে ওঠানো হয়। এরপর শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে সেখান থেকেই ছুড়তে থাকে ইট-পাথর।
সরেজমিনে ভবনের ছাদের ওপরে গিয়েও এসব পাথর দেখা যায়। তবে, শিক্ষার্থীরা কয়েকটি বস্তা নিচে নামিয়েছেন বলে কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী নিশ্চিত করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ছাত্রলীগের বিভিন্ন প্রোগ্রামে অধ্যক্ষের নির্দেশে শিক্ষার্থীদের কলেজ বাস ব্যবহার করত ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ।এছাড়াও বিভিন্ন প্রোগ্রামে তাদেরকে কলেজ ফান্ড থেকে টাকা দেওয়া হতো বলে জানিয়েছে বিশেষ একটি সূত্র।
কলেজের একাধিক সূত্র বলছে, কলেজে ছাত্রলীগকে আলাদাভাবে শেলটার দিয়ে আসতো বর্তমান অধ্যক্ষ। ছাত্রলীগ হলে বিভিন্ন শিক্ষার্থী, সাংবাদিককে গেস্টরুমে নিয়ে নির্যাতন করলেও কখনও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।
জানা যায়, কলেজ সাংবাদিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক ওবাইদুর সাঈদসহ ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতক্ষ্য মদদদাতা ছিলেন অধ্যক্ষ।
এসব বিষয়ে সাউথ হলের প্রভোস্ট আনোয়ার মাহমুদ বলেন, ছাত্রলীগকে খাওয়াতে আমরা কোন চাপ সৃষ্টি করি নাই। এটার প্রশ্নই আসে না। শুধু এই না আমি ছাত্রলীগের হুন্ডা তালা দিয়ে আটকে রাখছি। এটা সে (প্রিন্সিপাল) বলছে দিয়ে দিতে কিন্তু আমি বললাম এখন তালা খোলা যাবে না।
তবে ছাত্রলীগের মাহির নামে সাবেক নেতা নর্থ হলে থাকতো, এখন কন্টাক্টারি করে। মাহির আমাকে বলছে ছাত্রলীগকে খাওয়াতে। তখন আমি বাধা দিই বললাম কেন খাওয়াবো? আর প্রিন্সিপাল কি বলছে এটা আমি জানি না।
শহিদ ফরহাদ ছাত্রাবাসের হল সুপার নাসির উদ্দিনের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সঠিক কোন উত্তর দিতে পারেননি। তিনি ঘুরিয়ে পিরিয়ে বিষয়টি না জানার ভান করার চেষ্টা করেছেন।
এ বিষয়ে অধ্যক্ষের কাছে মুঠোফোনে জানতে চাইলে বলেন, আমার জীবদ্দশায় এক টাকাও আমি ছাত্রলীগকে দেয়নি। তবে ডিম ও খিচুড়ি দিয়ে সেদিন রাতে ছাত্রলীগকে খাওয়ানোর কথা স্বীকার করেছেন তিনি।
অধ্যক্ষ বলেন, আমি ছাত্রলীগকে কখনও দেখতে যাইনি, সেসময় শিক্ষকরা সবাই আওয়ামীপন্থী ছিল এবং হল সুপার ও ছাত্রলীগের চাপে আমি তাদেরকে চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করি।
আপনি একজন অধ্যক্ষ হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে না থেকে ছাত্রলীগের পক্ষ কেন নিয়েছিলেন? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হলে ছাত্রলীগের ব্যানারে সাধারণ শিক্ষার্থী থাকতো, তাদেরকে তারা জোর করে নিয়ে গেছে ছাত্রলীগের নেতারা। শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে তখন তাদেরকে রাতে ডিম-খিচুড়ি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করি এবং সেটা বাবদ ৬০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলি।
শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ইট-পাথর আনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ষড়যন্ত্রের স্বীকার, এই বিষয়ে কিছু জানি না আমি। এমন অভিযোগ যারা করেছে তারা বিবেকবান বলে মনে হয় না। ভবনের উপরে যেসব ইট পড়ে আছে সেসব ইট ২০২০ সালের বলে দাবি করেন তিনি।
সবশেষে ক্ষমা চেয়ে অধ্যক্ষ বলেন, আমি সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি, তারা আমাদের সন্তান তাদেরকে আমরা নিরাপদ রাখতে পারিনি।
জেবি/এসবি