তত্বাবোধায়ক সরকারের রায় পরিবর্তন
সাবেক প্রধান বিচারপতি বিরুদ্ধে মামলার আবেদন খারিজ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:২৫ অপরাহ্ন, ১৮ই আগস্ট ২০২৪
প্রধানবিচারপতির পদ ব্যবহার করে অবৈধভাবে তত্বাবোধায়ক সরকারের ঘোষিত রায় পরিবর্তন করার অভিযোগে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন খারিজ করেছেন আদালত।
রবিবার (১৮ আগস্ট) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট দিলরুবা আফরোজ তিথির আদালত ২০৩ ধারায় মামলা গ্রহণের উপাদান না থাকায় এ আদেশ দেন।
মামলার অভিযোগে বাদী উল্লেখ করেন, মামলার অভিযুক্ত বংলাদেশের ১৯ তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান কর্তৃক বিগত ২০১০ সালের ১ অক্টোবর নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ২০১১ সালের ১৭ মে পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন।
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনাসহ ৩৪ জনের নামে হত্যা মামলা
মামলার অভিযোগে বাদী উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে যোগ করা হয়েছিল। এরপর থেকে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়ে পরবর্তী সরকার গঠিত হচ্ছিল। ফলে আমরা দেখতে পাই যে, ১৯৯৬. ২০০১ ও ২০০৮ সনের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছিল। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে অ্যাডভোকেট এম সলিম উল্লাহসহ কয়েকজনের রিট আবেদনে ২০০৪ সালে হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ বলে ঘোষণা করে রায় দেন। ঐ রায়ের বিরুদ্ধে রিট আবেদনকারি পক্ষই আপিল বিভাগে আপিল করেন। তবে এম সলিম উল্লাহ অসুস্থতার কারণে মারা যাওয়ায় আব্দুল মান্নান খান নামের আরেকজন আইনজীবী রিট আবেদনটিকে এগিয়ে নিয়ে যান।দীর্ঘ সময় পরে ২০১০ সালের ১ মার্চ আপিল বিভাগে এর শুনানি শুরু হয়। আপিল আবেদনকারি এবং রাষ্ট্রপক্ষ ছাড়াও শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে শীর্ষস্থানীয় আটজন আইনজীবী বক্তব্য দিয়েছেন। অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে সিনিয়র আইনজীবী টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, আমীর-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম ও রোকনউদ্দিন মাহমুদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। বিভক্ত বাংলাদেশি সমাজের শীর্ষ সব আইনজীবী একটি প্রশ্নে একমত পোষণ করলেন। এমনকি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশেষ ব্যবস্থা বহাল রাখার পরামর্শ দিলেন তারা। এমনকি শুনানির সময় প্রয়াত সিনিয়র আইনজীবী টিএইচ খান চরম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন। বললেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হলে দেশে বিপর্যয় তৈরি হবে, গৃহযুদ্ধ লেগে যাবে।
মামলার অভিযোগে আরো বলা হয়,অ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্য অভিযুক্ত আমলে না নিয়ে তাহার চাকরিকাল শেষ হয়ে যাবে তার জন্য তড়িঘড়ি করিয়া অভিযোগকারীর নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ৬+১=৭ জন বিচারপতির সংখ্যাগরিষ্ট বিচারপতির মতামতের ভিক্তিতে রায এর জন্য দিন নির্ধারন হলে পর ০৬ জন বিচারপতির মধ্যে ০৩ জন বিচারপতি অ্যামিকাস কিউরিদের সাথে একমত হন এবং ত্রয়োদশ সংশোধনী কোন সংকট তৈরি করেনি বলে মত দেন কিন্তু অপর ০৩ জন বিচারপতি ভিন্ন মত তুলে ধরলে মামলার ফলাফল টাই হয়। ফলে প্রদান বিচারপতি হিসেবে এ বি এম খায়রুল হকের হাতে এ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ছিল এবং তিনি তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন এবং বিগত ১০-০৫-২০১১ ইং তারিখে তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে রায় প্রদান করেন। ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় প্রকাশ্যে আদালতে ঘোষিত রায়ে সুপ্রিম কোর্ট দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পথ খোলা রেখেছিল। কিন্তু রায়ের ব্যাপারে রাজনৈতীক অংগনসহ জনমনে অসন্তুষ্টি দেখা দেয়ায় তিনি আর স্বাক্ষর প্রদান করেন নাই এবং নথি নিজ জিম্মায বাসায় নিয়ে রাখেন। বিগত ১৭-০৫-২০১২ ইং তারিখে অবসর গ্রহন করেন। সেই সাথে তিনি অত্র আপীল মামলার নথি বাসায় নিয়ে যান যা বেআইনি। এই বিষয়ে বিগত ১৯-০১-২০১৬ ইং তারিখে তৎকালীন প্রদান বিচারপতি এস কে সিনহা এক বানীতে বলেন যে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগন বাংলাদেশ সংবিধান, আইনের রক্ষন, সমর্থক ও নিরাপত্তা বিধানের মত গ্রহন করেন। কোন বিচারপতি অবসার গ্রহনের পর তিনি একজন সাধারন নাগরিক হিসেবে গন্য হন বিধায় তার গৃহিত শপথ ও বহাল থাকে না। আদালতের নথির সরকারি দলিল। কোন কোন বিচারপতি অবসর গ্রহনের পর দীর্ঘদীন পর পর্যন্ত রায় লেখা অব্যহত রাখেন যা আইন ও সংবিধান পরিপন্থি।"
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনা ও নওফেলের বিরুদ্ধে কলেজছাত্র হত্যা মামলা
মামলার অভিযোগে আরো বলা হয়েছে, বিগত ২০১৪ সালের নির্বাচন এগে আসলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্যী শেখ হাসিনার দল আওয়ামিলিগকে চিরকাল ক্ষমতায রাখার জন্য রায় এর ১৬ মাস ০৩ দিন পর পরে তথা ২০১২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পূর্নাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করেন। ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় প্রকাশ্যে আদালতে ঘোষিত রায়ে সুপ্রিম কোর্ট দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পথ খোলা রেখেছিল। কিন্তু প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ১৬ মাস ০৩ দিন পর যে রায় প্রকাশ করলেন সেখানে তিনি এ অংশটি রাখেননি। আপিল বিভাগের দুই জন বিচারপতি এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। দৃশ্যত আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তই অনুসরণ করেছিলেন খায়রুল হক। বিচারপতি খায়রুল হকের এ রায় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টে এক আলোচনা সভায় এ নিয়ে কথা বলেন তিনি। যদিও বিচারপতি খায়রুল হকের নাম মুখে নেননি। বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী বলেছিলেন, পদ্ধতিগত কারণে আপিল বিভাগের রায়ে দেরি হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে সেটা যৌক্তিক সময়, যেমন এক মাসের মধ্যে হতে পারে। কিছুতেই এক-দেড় বছর হতে পারে না। আর অবশ্যই পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদেশের অংশ কোনোভাবেই পরিবর্তন করা যাবে না। সেটা করতে গেলে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন ও শুনানি হতে হবে। কিন্তু তা না করেই যদি রাতের অন্ধকারে, এক-দেড় বছর পর রায় পরিবর্তন করে ফেলেন, তাহলে সেটা ফৌজদারি অপরাধ। মাহমুদুল আমীন চৌধুরীর এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি মানবজমিন এ দেয়া এক স্বাক্ষাৎকার এ বলেন, রায়ে এ ধরনের পরিবর্তন ফৌজদারি অপরাধ।
মামলার অভিযোগে বলা হয়,বিচারকদের ওপর অর্পিত দায়িত্বের মূল হলো আস্থা ও বিশ্বাস। অভিযুক্ত প্রধান বিচারপতির পদে আধিপত্যের ভারপ্রাপ্ত হয়ে সেই পদকে ইচ্ছামত নিজের পছন্দের দলকে চিরকালের জন্য ক্ষমতায় বসিয়ে রাখার জন্য নির্বাচনহীন একটি প্রহসনের দেশ তেরী করার জন্য অসাধুভাবে প্রধানবিচারপতির পদ ব্যবহার করিয়া ঘোষিত রায় পরিবর্তন করা ফৌজদারি অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ এবং পুরো জাতির সাথে প্রতারনা বিধায় দণ্ডবিধি আইনের ৪২০/৪০৬ ধারায়, বাংলাদেশের জনগনের ক্ষতি বা অনিষ্ট করার জন্য প্রকাশিত রায় আইনি পন্থা ব্যাতিরকে অর্থাৎ কোন রিভিউ পিটিশন ছাড়াই অত্র রায় এর অংশবিশেষ বাতিল করে ১৬ মাস ০৩ দিন পর চাকরি না থাকা অবস্থায় স্বাক্ষর করত রায় প্রচার করায় দণ্ডবিধি আইনের ৪৬৭/৪৬৮ ধারায় অপরাধ করেছেন।
জেবি/এসবি