ওজোপাডিকোর সাবেক চেয়ারম্যান মাকসুদা খাতুনের আত্মীয় পরিচয়ে দুর্নীতি
দুর্নীতির মাস্টার মাইন্ড যুলফিকার-বারী মানিকজোড়
বশির হোসেন খান
প্রকাশ: ১২:১৫ অপরাহ্ন, ১১ই সেপ্টেম্বর ২০২৪
দুর্নীতিতে মানিকজোড় যুলফিকার আলী ও হাফিযুল বারী। ঘুষ, ব্ল্যাক মেইল, তদন্ত রিপোর্ট উল্টে দেয়া, পারসেন্টেজ নিয়ে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেয়াসহ কি নেই করেন না এই দুজন। এসব করেই আগের সরকারের সময়ে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইলেকট্রিকাল কোম্পানীর শুরুর দিকে শেখ হাসিনা সরকারের এক আমলা অতিরিক্ত সচিব ও ওজোপাডিকোর চেয়ারম্যান মাকসুদা খাতুনের রেফারেন্সে তাঁর আত্মীয় হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যান যুলফিকার। পরে সঙ্গে পান দুর্নীতির বরপুত্র হাফিযুল বারীকে। দুজনে মিলে গড়ে তোলেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত এই চক্রের পরিকল্পনা এই কোম্পানিকে শেষ করে দিয়ে নিজেদের আখের গোছানো।
হাফিযুল বারী কাজে অদক্ষ ও বাচাল। বারী ও যুলফিকার দুজন মিলে সই করে কোম্পানীর টাকা মেরে খাওয়াকে নিজেদের কাজ বলে গণ্য করে অন্য কোনো কাজ করেননি। নিজেরা ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার করেছেন এবং বিভিন্ন কায়দায় অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছেন। কানাডায় সব ছেলে-মেয়েকে পাঠিয়ে এই পদে মাত্র দুই বছরে তার প্রচুর উপার্জন।
সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ইলেকট্রিকাল কোম্পানীর শুরুর দিকে সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও ওজোপাডিকোর চেয়ারম্যান মাকসুদা খাতুনের আত্মীয় হিসেবে ২০১৯ সালে যুলফিকারকে সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে সাময়িক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগপত্রের চুক্তি অনুযায়ী যুলফিকার আলীর নিয়োগ দেওয়া হয় অস্থায়ী কর্মচারী হিসেবে ১ বছরের প্রবেশন পিরিয়ড সহ ৩ বছর মেয়াদের জন্য। আত্মীয়ের নাম ভেঙে আধিপত্য বিস্তার করে যুলফিকার প্রতিষ্ঠানে প্রচুর অন্যায়, অনিয়ম ও নিপীড়ন করে। যুলফিকারের দৌরাত্মে ফ্যাক্টরীতে কাজ করা তরুণরা আতংকের মধ্যে আছে।
হাফিযুল বারীকে ২০২২ সালের ১ মার্চ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করা হয় ২ বছরের জন্য। অর্থলোভী হাফিযুল বারী রতন কুমার দেবনাথ-এ এন এম মোস্তাফিজ তথা ভুয়া অডিট রিপোর্ট চক্রের সাথে যোগ দেন প্রতিযোগী অন্য কোম্পানীর থেকে পাওয়া ঘুষের টাকার ভাগের জন্য। রতন কুমার দেবনাথ, তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অতিরিক্ত দায়িত্ব একটি একপাক্ষিক তদন্ত কমিটি করে মনগড়া রিপোর্ট দিয়ে সেই রিপোর্টের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় দুর্নীতির অভিযোগ ও নিজে বাদী হয়ে মামলা করেন। হাফিযুল বারীর দায়িত্ব নেন এই মামলাটি ধীর গতিতে রাখার এবং মামলার প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট পাল্টে দেওয়ার।
যুলফিকার আলীকে অনিয়ম করে বোর্ডের মাধ্যমে প্রমোশন দিয়ে সহকারী ব্যবস্থাপক থেকে এক লাফে ম্যানেজার পদ দিয়ে দুটি ইনক্রিমেন্ট দিয়ে পুরষ্কৃত করে এই চক্রের লোকজন।
কর্মস্থল খুলনা হলেও হাফিযুল বারী কোম্পানির গাড়ি নিয়ে ঢাকায় থাকতেন দিনের পর দিন এবং কোম্পানীর থেকে একসাথে সিরিজ ট্রাভেল এলাওয়েন্স এবং ডেইলি এলাওয়েন্স তুলতেন। বিভিন্ন অজুহাতে ভুয়া বিলের মাধ্যমে নিজের পকেট ভারী করেন। এমনকি নিজে জোর করে বোর্ডের শেয়ার নেন এবং বোর্ডের ডিরেক্টর হন বোর্ড মিটিংয়ের সম্মানী পাওয়ার জন্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর কোম্পানির কোনো ডকুমেন্ট, লাইসেন্স, সার্টিফিকেট নবায়ন করা হয়নি। দুই অর্থবছরের অডিট রিপোর্ট হয়নি। রেজিস্টার অফ জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে নিবন্ধিত এই যৌথ উদ্যোগ কোম্পানির কোনো এজিএম মিটিং করা হয়নি গত দুই বছর। কোনো ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেয়া হয়নি। আইএসও সার্টিফিকেট করেননি। বোর্ডের বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেননি। প্রতিষ্ঠানটি হালনাগাদ কাগজ না থাকায় পুরনো অমীমাংসিত বিষয়ের জন্য প্রায় দেড় বছর ধরে কাঁচামাল কেনার জন্য এলসি খুলতে পারছে না। প্রতিষ্ঠানটিকে তিনি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যান।
মিটার স্থাপনকারী ঠিকাদারদের থেকে ঘুষ খেতে খেতে বারী এবং যুলফিকার ভাবলেন নিজেরাই ঠিকাদারের কাজ করবেন। সেই ঠিকাদারীর কাজ সঠিকভাবে করতে না পেরে প্রজেক্টে এলডি হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরী করেন।
সূত্রে জানা গেছে, হাফিযুল বারী হেক্সিং ইলেকট্রিকাল কোম্পানীকে কাজের সন্তোষজনক পারফরম্যান্স সার্টিফিকেট প্রদান করেন। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে মন্ত্রনালয়ের প্রিপেইড মিটার স্থাপন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে আনা ওজোপাডিকোর ৬০ হাজার সম্পূর্ণ মিটারও তিনি সার্টিফাই করেন। তিনি ওজোপাডিকোকে অনুরোধ করে চিঠি দেন ওজোপাডিকোর করা মামলা ও অভিযোগসমূহ প্রত্যাহার করার জন্য। নিজে বাকি অভিযোগগুলো প্রত্যাহার করবেন এবং তাতে সমস্যার সমাধান হবে সেই মর্মে।
হাফিযুল বারী তার নিজের চিঠি অনুযায়ী বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিকাল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রতনের করা বিভিন্ন অভিযোগ প্রত্যাহার করার কথা থাকলেও তিনি ৩ টি চিঠি সই করা বাবদ ১০ লাখ টাকা অগ্রীম দাবী করেন। ঘুষের টাকা না দেওয়ায় তার মেয়াদ শেষের সময় চলে আসার সময় পর্যন্ত দেরী করতে থাকেন। মেয়াদ শেষের সময় চলে আসলে বোর্ডের ডিরেক্টরদের ব্ল্যাকমেলিং করতে থাকেন তার চাকরীর মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য। হুমকি দেন নাহলে উনি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করবেন। কর্তৃত্ববাদী সরকারের সময়কার ওজোপাডিকোর চেয়ারম্যান এনামুল কবীর তার এই ঘুষ নেয়ার ব্যাপারে অবগত ছিলেন না। তিনি বারীকে সমর্থন করেছেন তার কানকথা বিশ্বাস করে। নিজের স্বার্থে অবসরে যাওয়ার পরও চেয়ারম্যান থাকা এই ব্যক্তিকে ম্যানিপুলেট করেন বারী।
যুলফিকারের চাকরী কখনো কনফার্ম না হলেও বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া একটি মেয়াদ বৃদ্ধির কাগজ পরবর্তীতে সে হাফিযুল বারীর কাছ থেকে পেয়েছে বলে জানায়। অফিস অর্ডারে তার চাকরীর মেয়াদ ২০২৭ পর্যন্ত বৃদ্ধি এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাফিযুল বারীর স্বাক্ষর রয়েছে। স্মারক ও তারিখ ২০২২ এর এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে বারী সাহেবের সই এর নিচের তারিখ ২০২৩। সেখানে বারী সাহেব সই করার আগে লিখেছেন নির্দেশক্রমে। কার নির্দেশে সেটা বলা নেই কারণ কোম্পানিটির বোর্ডের এসংক্রান্ত কোনো নির্দেশ নেই।
অভিযোগ আছে এই মেয়াদ নবায়নের ডকুমেন্টটি জালিয়াতি করে বানানো হয়েছে। যুলফিকার নিজের স্বার্থে প্রতারণা করে হাফিজুল বারীর স্বাক্ষর জাল করে এটি তৈরী করে রেখেছে নিজের জন্য যাতে পারফরম্যান্স যতোই খারাপ এবং কোম্পানীদ্রোহী হোক, তার চাকরী যাতে বহাল তবিয়তে থাকে। ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য দুই পক্ষের ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্ট ভুয়া তথ্যের ভিত্তিতে করা এই ভুয়া মামলা চালানো তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, যুলফিকার আলী ও হাফিযুল বারীর ক্ষমতার উৎস তৎকালীন স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তি। হাফিযুল বারী দুটি কোম্পানি অ্যাডভান্স ভারটেক্স ভেনচার ও এভিটি ভ্যানচার নামের দুটি নামসর্বস্ব কোম্পানি যেগুলো প্রকৃতপক্ষে একই কোম্পানি। মিটার স্থাপন করার কাজ দেওয়া হয় যেই কোম্পানিগুলোকে তার স্বত্ত্বাধিকার ইঞ্জিনিয়ার মাহাবুব হোসেন। তিনি খুলনা জেলার ৪ আসনের আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। যদিও পরবর্তীতে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তার বাসস্থান ও অফিস হাফিযুল বারীর বাসা একই এলাকা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। তাকে বেশি দামে কাজ দেওয়া থেকে বিল পাইয়ে দেওয়ার জন্য এই দুই মানিকজোড় ভীষন তৎপর। মাহাবুব হোসেন তাদের গডফাদার হিসেবে রাজনৈতিক সহযোগিতা করতেন। সেই সুবাদে স্থানীয় শেখ পরিবারের সাথে তাঁদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
বারিধারাস্থ এই নাম সর্বস্ব ঠিকাদারকে কাজ দিয়ে পরবর্তীতে কাজ করতে না পেরে প্রজেক্ট ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এক পর্যায়ে অন্য ঠিকাদারদের কাজ দেন কাজ শেষ করার জন্য। কাজের থেকে বেশি বিল দাবি করলে দ্রুত সমাধান করে তাদের বিল দেন বারী।
জানা গেছে, নিয়োগের চুক্তি অনুযায়ী হাফিযুল বারীর চাকরীর মেয়াদ ছিলো দুই বছর। দুই বছর পর চাকরীর মেয়াদ শেষে তিনি ১৩ মার্চ অবসরে যান।
হাফিযুল বারীর বয়স এখন ৬৩। খারাপ পারফরম্যান্সের কারণে তার চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি হয়নি এবং স্বেচ্ছায় খুলনা ছেড়ে চলে আসেন চাকরীর মেয়াদ শেষে। এখন পরিস্থিতি বুঝে ভোল পাল্টে আরো বছরের পর বছর চাকরি করার জন্য তিনি তার আগের দাবির বিপক্ষে। তার নিজের লেখা চিঠি এবং বর্তমান বক্তব্য সাংঘর্ষিক।
বর্তমানে র্স্বৈরাচারের দোসর বর্তমানে বেকার হাফিযুল বারী একবার যেখান থেকে চলে গেছেন আবার লুটপাট করতে সেখানে ফেরত আসতে চান। পুনরায় এই কোম্পানিতে চাকরির জন্য পায়তারা করছেন বারী। বর্তমান পরিস্থিতি ও দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে যুলফিকারের নেতৃত্বে আন্দোলন করার পরিকল্পনা করছেন। আন্দোলন ও ঘেরাও করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে বর্তমান ম্যানেজমেন্টকে পদত্যাগ করিয়ে উনি এমডি পদটি আবারো দখল করতে চান।
সবার চোখ এড়িয়ে এবং মালিকপক্ষদ্বয়ের কোনো বাঁধা ছাড়াই নিজেরা অবৈধ টাকা উপার্জন করে লাভবান হতে চান। এরই মধ্যে দুর্নীতির এই মানিকজোড়ের নামে প্রধান উপদেষ্টা ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে অভিযোগ জমা পড়েছে।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত একজন জানান, “আমাদের প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। এখানে প্রায় ২০০ জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। আমরা এখন প্রায় ৭০ জন কাজ করছি এই প্রতিষ্ঠানে। প্রতিনিয়ত যুলফিকার তার নিজস্ব ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য আমাদের ব্যবহার করছে। আমাদের বাধ্য করছে আন্দোলন করার জন্য। ভুয়া নোটশীট তৈরি করে আমাদের সই করার জন্য চাপ দিচ্ছে না হলে আমাদের একঘরে করে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। আমরা চাই না আমাদের প্রতিষ্ঠান একজন ব্যক্তির কাছে কুক্ষিগত হয়ে থাক এবং আমাদের সবার চাকরি চলে যাক।”
এ বিষয়ে বুয়েটের একজন অধ্যাপকের সাথে কথা বলা হলে তিনি বলেন, “কোনো যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি সাধারণত এক প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে আসলে সেখানে পুনরায় চাকরি করতে যান না।”
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত যুলফিকার আলী ও হাফিযুল বারী ফোন রিসিভ করেনি। এমনকি ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে জবাব পাওয়া যায়নি। বর্তমানে তারা ফ্যাক্টরীতে অস্থিতিশীলতা তৈরী করার চেষ্টায় লিপ্ত বলে জানা গেছে।
জেবি/এসবি