নিশ্চিত করতে হবে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অধিকার


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


নিশ্চিত করতে হবে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অধিকার

প্রতিবন্ধিতা জীববৈচিত্রের একটি অংশ। সব প্রতিবন্ধিতা দৃশ্যমান নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধিতা দীর্ঘস্থায়ীও নয়। বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে অস্থায়ী প্রতিবন্ধিতা দেখা যায়। বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছে মর্মে ধারণা করা হয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বেশিরভাগই দারিদ্র্যের শিকার তথা নিম্ন আয়ভুক্ত বলে বিভিন্ন গবেষণায় লক্ষ্য করা যায়। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য নিরসন ও জীবনমান উন্নয়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ সময়ের দাবী। দারিদ্র্য নিরসন ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন তাদের উপযোগী চিকিৎসা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানে লক্ষ্যভিত্তিক পরিকল্পিত কার্যক্রম গ্রহণ। বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার আক্রান্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য একটি দিবস যা প্রতিবছর ২রা এপ্রিল পালিত হয়। 

প্রতিবন্ধিতার ধরন চিহ্নিতকরণ, মাত্রা নিরূপণ ও কারণ নির্দিষ্টপূর্বক প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সঠিক পরিসংখ্যান নির্ণয়ের নিমিত্তে দেশব্যাপী প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। দেশব্যাপী প্রসারের পূর্বে পদ্ধতিগত কার্যকারিতা নির্ভুল করার লক্ষ্যে পাইলটভিত্তিতে জরিপ শুরু হয়। পাইলটভিত্তিতে গোপালগঞ্জ জেলা এবং জামালপুর সদর, বরুড়া (কুমিল্লা), পবা (রাজশাহী), মোড়লগঞ্জ (বাগেরহাট), বরিশাল সদর, চুনারুঘাট (হবিগঞ্জ) ও ফুলবাড়ি (দিনাজপুর) উপজেলাসহ সর্বমোট ১২ টি উপজেলায় জরিপ কাজ সম্পন্ন করা হয়। পাইলট ভিত্তিতে জরিপ পরিচালিত উপজেলা ব্যতীত দেশের অবশিষ্ট এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে জরিপ পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১ জুন ২০১৩ থেকে মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয় এবং ১৪ নভেম্বর ২০১৩ সালে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন হয়।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক মনোনীত ডাক্তার এবং জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের আওতাধীন প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের কনসালট্যান্ট কর্তৃক জরিপের আওতাভুক্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিবন্ধিতার ধরন ও মাত্রা নিরূপণের কাজ শুরু হয়। বয়স, লিঙ্গ, জাতি, সংস্কৃতি বা সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী আর দশজন যে কাজগুলো করতে পাওে, ইমপেয়ারমেন্টের কারণে সে কাজগুলো প্রাত্যহিক জীবনে করতে না পারার অবস্থাটাই হল ডিসএবিলিটি বা প্রতিবন্ধিতা৷ ইমপেয়ারমেন্ট বলতে দেহের কোন অংশ বা তন্ত্র যদি আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে, ক্ষনস্থায়ী বা চিরস্থায়ী ভাবে তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারায় সে অবস্থাটিকেই বোঝায় ৷

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত "International Classification of Impairment, Disability and Handicap (ICIDH)" শীর্ষক প্রকাশনায় বিকলাঙ্গ ও প্রতিবন্ধী সমস্যাকে ৩ শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা- ১. দূর্বলতা, ২. অক্ষমতা এবং ৩. প্রতিবন্ধী। বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন, ২০০১-এ বলা হয়েছে, "প্রতিবন্ধী অর্থ এমন এক ব্যক্তি যিনি জন্মগতভাবে বা রোগাক্রান্ত হয়ে বা দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বা অপচিকিৎসায় বা অন্য কোনো কারণে দৈহিকভাবে বিকলাঙ্গ বা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন এবং উক্তরুপ বৈকল্য বা ভারসাম্যহীনতার ফলে স্থায়ীভাবে আংশিক বা সম্পুর্ণ কর্মক্ষমতাহীন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে অক্ষম"।

প্রতিবন্ধিতার প্রকারভেদ বিভিন্ন ভিত্তিতে করা হয়ে থাকে ৷ যেমন: কখন শুরু হয়েছে তার ভিত্তিতে ১। প্রাথমিক প্রতিবন্ধিতাঃ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধিত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করলে তাকে প্রাথমিক প্রতিবন্ধিতা বলা হয় ৷ ২। পরবর্তী বা অর্জিত প্রতিবন্ধিতাঃ জন্মের পরে বিভিন্ন কারণে প্রতিবন্ধিত্ব বরন করে থাকলে থাকে তাকে পরবর্তী বা অর্জিত প্রতিবন্ধিতা বলা হয় ৷ কোন অঙ্গ আক্রান্ত হয়েছে তার ভিত্তিতে ১। শারীরিক প্রতিবন্ধি, ২। দৃষ্টি প্রতিবন্ধি, ৩। শ্রবন প্রতিবন্ধি, ৪। বাক প্রতিবন্ধি, ৫। বুদ্ধি প্রতিবন্ধি এবং ৬। বহুবিধ প্রতিবন্ধি। মাত্রা অনুযায়ী ১। মৃদু, ২। মাঝারি, ৩। তীব্র এবং ৪। চরম।

বেশীর ভাগ প্রতিবন্ধতার কারণ জানা যায় না ৷ কিন্তু যেগুলো সম্বন্ধে জানা যায়, তা কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় ৷ যেমন: সাধারণ কারণ সমূহঃ ক) বংশানুক্রমিক, খ) রক্তের সম্পর্ক রয়েছে এমন কোন কোন আত্মীয়ের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক, গ) দুর্ঘটনা, ঘ) উচ্চ মাত্রার জ্বও, ঙ) বিষক্রিয়া, চ) মস্তিষ্কের কিছু কিছু ইনফেকশন বা অসুখ বা টিউমার, ছ) পুষ্টি, ভিটামিন, আযয়োডিন ইত্যাদির অভাব। জন্ম-সম্পর্কিত কারণ সমূহঃ জন্মের পূর্বেঃ ক) মায়ের বয়স যদি ১৬ বছরের নিচে অথবা ৩০ বছরের উপরে হয়, খ) গর্ভাবস্থায় মায়ের পুষ্টির অভাব, গ) গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাসের মধ্যে যদি মা কোনরকম কড়া ঔষধ গ্রহণ করে থাকে অথবা কীটনাশক, রাসায়নিক, রশ্মি, বিষক্রিয়া গ্রহণ করে থাকে, ঘ) গর্ভাবস্থায় যদি মায়ের বিশেষ হাম হয় ৷ 

এটি সাধারণত প্রভাব বিস্তার করে থাকে ইন্দ্রিয়স্থান (শ্রবন এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধিদের ক্ষেত্রে), মস্তিস্কের সেরেব্রাল পালসি অথবা মানসিক প্রতিবন্ধিত্ব অথবা শরীরের অভ্যন্তরের বাহুতেও প্রভাব বিস্তার করতে পাওে, ঙ) গর্ভধারণকারী মায়ের যদি হৃদযন্ত্র সংক্রান্ত জটিলতা বা ডায়াবেটিস থাকে, চ) গর্ভধারণকারী মায়ের যদি বিভিন্ন অভ্যাস থাকে ৷ যেমন- মদ পান, ধূমপান করা, তামাক ব্যবহার করা ইত্যাদি৷ জন্মের সময়ঃ ক) অপরিপক্বতা, খ) প্রসবের সময় অব্যবস্থাপনা, গ) প্রসবের সময় সঠিক ভাবে যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করা হলে, গ) মাথায় আঘাত, ঘ) প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অভাব। জন্মের পরেঃ ক) মাথায় আঘাত প্রাপ্ত হলে, খ) প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অভাব, গ) দুর্ঘটনা, ঘ) উচ্চ মাত্রার জ্বও, ঙ) বিষক্রিয়া, চ) মস্তিষ্কেও কিছু কিছু ইনফেকশন, রোগ এবং টিউমার। সাধারণত এইসব কারণে প্রতিবন্ধী ছেলে মেয়ে হয়ে থাকে। 

মানসিক প্রতিবন্ধিতা শিশুর বিকাশকালিন তার শারীরিক, সামাজিক ও ভাষা আয়ত্বের অপারগতাজনিত অবস্থা। প্র্রথমিক অবস্থায় গৌণ প্রতিয়মান হলেও সাধারণত তিনবৎসর বয়সের আগেই তা প্রকাশ পেয়ে থাকে এবং প্রতিবন্ধী ছেলেদের সংখ্যা মেয়েদের চেয়ে প্রায় চারগুণ বেশি হয়ে থাকে। তাদের কথা শিখতে দেরি হয় এবং আদর-যত্নের প্রতি তারা আগ্রহ না দেখিয়ে উদাসীন হয়। তবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু ধীরে ধীরে তাদের মাতা-পিতা বা বিশেষ কোনো ব্যক্তির প্রতি আকর্ষণ দেখায়। অনেকে কোনো অর্থহীন বা অন্যের উচ্চারিত কোনো শব্দ বারংবার উচ্চারণ করে। কেউ কেউ কোনো বিশেষ শব্দের প্রতি ভীত হয়। ব্যথায় ও বিপদজনক পরিস্থিতিতে এদের মধ্যে স্বাভাবিক সাড়ার অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় যদিও তাদের মধ্যে ভাবাবেগের কোনো অভাব দেখা যায় না। 

দেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে ফিজিওথেরাপি ও অন্যান্য চিকিৎসা সহায়তা প্র্রানের লক্ষ্যে অর্থ বিভাগের ধারণাপত্রের ভিত্তিতে প্রথমবারের মতো দেশের পাঁচটি জেলায় প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র চালু করা হয়। প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের সেবা কার্যক্রম বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হওয়ায় ২০১০-২০১১ অর্থ বছরে পূর্বের পাঁচটি কেন্দ্রের কার্যক্রম নবায়ন করে আরও ১০টি, ২০১১-১২ অর্থ বছরে পূর্ববর্তী বছরগুলোর ১৫টি কেন্দ্রের কার্যক্রম নবায়ন করে আরও ১০টি এবং ২০১২-১৩ অর্থ পূর্ববর্তী বছরগুলোর ২৫টি কেন্দ্র নবায়নসহ আরও ৩৩টি জেলায় প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র সম্প্রসারণ করা হয়েছে। তাছাড়া প্রতিটি কেন্দ্রে একটি করে অটিজম কর্ণার চালু করা হয়েছে। 

জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ফাউন্ডেশনের নিজস্ব ক্যাম্পাসে অটিজম রিসোর্স সেন্টার চালু করা হয়েছে। উক্ত কেন্দ্র থেকে নিম্নোক্ত সেবাসমূহ প্রদান করা হয়- সনাক্তকরণ, এসেসমেন্ট, অকুপেশনাল থেরাপি, স্পিচ এ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপি, ফিজিওথেরাপি, কাউন্সেলিং, রিসোর্স বেইজড সেমিনার, টেলি থেরাপি,  গ্রুপ থেরাপি, দৈনন্দিন কার্যবিধি প্রশিক্ষণসহ রেফারেল সেবা প্রদান, অটিস্টিক শিশুদের পিতা-মাতাদের কাউন্সেলিং সেবা প্রদান। উক্ত সেন্টার হতে বিভিন্ন বয়সের অটিজম আক্রান্ত শিশু/ব্যক্তিকে বিনামূল্যে সেবা প্রদান অব্যাহত আছে। এ কেন্দ্র থেকে ঐড়সব ওহঃবৎাবহঃরড়হ সুবিধাও প্রদান করা হচ্ছে।

অটিজমসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এসব প্রশিক্ষণে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি তাদের পিতামাতা ও অভিভাবককেও সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় এ পর্যন্ত অভিভাবক/পিতা-মাতা, অটিস্টিক শিশুসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া জনবলকে দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।

প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে একটি করে অটিজম ও নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী (এনডিডি) কর্ণার স্থাপন করা হয়েছে। ঢাকা শহরের মিরপুর, লালবাগ, উত্তরা ও যাত্রাবাড়ীতে ১টি করে, ৬টি বিভাগীয় শহরে ৬টি এবং গাইবান্ধায় ১টিসহ মোট ১১টি স্পেশাল স্কুল ফর চিলড্রেন উইথ অটিজম চালু করা হয়েছে। এ স্কুল থেকে অটিজম আক্রান্ত শিশুরা বিনা বেতনে প্রি স্কুলিং এর সুযোগ পাচ্ছে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের আওতায় জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্র নামে একটি কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল সৃষ্টি, বিশেষ শিক্ষা উপকরণ তৈরি ও বিতরণসহ সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন করে তোলাই এ কেন্দ্রের মূল উদ্দেশ্য। 

মো: আরাফাত রহমান সহকারি কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়