রঙে-ঘ্রাণে প্রকৃতির উৎসব: জাবিতে প্রাণবন্ত ১৪তম প্রজাপতি মেলা


Janobani

ক্যাম্পাস প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৪:২৯ অপরাহ্ন, ৭ই ডিসেম্বর ২০২৪


রঙে-ঘ্রাণে প্রকৃতির উৎসব: জাবিতে প্রাণবন্ত ১৪তম প্রজাপতি মেলা
ছবি: প্রতিনিধি

‘প্রজাপতি, প্রজাপতি, কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা?’ কাজী নজরুলের সেই বিখ্যাত সঙ্গীতের মতো দিনভর রঙিন প্রজাপতির ওড়াওড়ির মধ্য দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) অনুষ্ঠিত হলো ১৪তম প্রজাপতি মেলা-২০২৪। প্রজাপতি সংরক্ষণ ও গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যতিক্রমী এ মেলার আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের কীটতত্ত্ব শাখা।


শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) সকাল দশটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বেলুন উড়িয়ে দিনব্যাপী এই প্রজাতি মেলার উদ্বোধন করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান।


আরও পড়ুন: জাবিতে ছাত্রীর মৃত্যুর বিচারের দাবিতে রেজিস্ট্রার ভবনে তালা


প্রজাপতি, প্রজাপতি, কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা?’ কাজী নজরুলের সেই বিখ্যাত সঙ্গীতের মতো দিনভর রঙিন প্রজাপতির ওড়াওড়ির আর দর্শনার্থীদের পদচারণার মুখরিত হয়ে উঠে জাবি ক্যাম্পাস। সকাল থেকেই প্রজাপতি দেখতে মেলায় ভিড় জমান বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা দর্শনাথীরা। শহরের যান্ত্রিকতা, কোলাহল থেকে থেকে একটুখানি হাফ ছেড়ে বাঁচতে পরিবার, আত্মীয়—স্বজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে অনেকেই ছুটে এসেছেন প্রকৃতির কোলে রং ছড়ানো এই পতঙ্গটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে।


নগর জীবনের ব্যস্ততা থেকে মুক্তি পেতে একটুখানি প্রশান্তির আশায় সাভারের নবীনগর থেকে প্রজাপতি মেলা উপভোগ করতে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ৪১তম ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী কামরুন ফারজানা কনিকা। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তার ছোট্ট দুইটি মেয়েকেও। মেলায় এসে মেয়েরা ভীষণ আনন্দিত। প্রজাপতির হাটে রঙ-বেরঙের প্রজাপতি দেখতে তারা ছোটাছুটি করছে এদিক-সেদিক। তিনি মেয়েদের বিভিন্ন প্রজাপতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। কনিকা তার ছোট্ট মেয়েদেরকে প্রজাপতির মতো ডানাও পড়িয়েছেন। কনিকা জানান, ‘ইট-পাথরের শহুরে জীবনে প্রজাপতি দেখা পাওয়া দুর্লভ। আমি প্রতিবছরই এই প্রজাপতি মেলা দেখতে আসি। মেয়েরা প্রজাপতি দেখে অনেক আনন্দ পায়। মেয়েরাও কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে এছাড়াও পাপেট শো, গান, ছবি আঁকায় চমৎকার সময় পার করেছে তারা।’


জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অদুরে আমবাগান এলাকা থেকে বাবা সুমন কুমার সেনের সঙ্গে মেলা দেখতে এসেছেন ছোট মেয়ে সাশ্বতা সেন তান। বিচিত্র রকমের প্রজাপতি দেখে সে খুবই খুশি। এছাড়াও ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পেরে এবং পাপেট শো দেখে খুবই উচ্ছ্বাসিত দেখা যায় ছোট্ট তান'কে।


বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে দিনব্যাপী মেলার আয়োজনের মধ্যে ছিল শিশু-কিশোরদের জন্য প্রজাপতি বিষয়ক ছবি আঁকা প্রতিযোগিতা, কুইজ প্রতিযোগিতা, আলোকচিত্র প্রদর্শনী, প্রজাপতির আদলে ঘুড়ি উড্ডয়ন, বারোয়ারি বিতর্ক প্রতিযোগিতা, প্রজাপতি চেনা প্রতিযোগিতা, প্রজাপতি বিষয়ক ডকুমেন্টারী প্রদর্শনী ও পুরস্কার বিতরণী। দিনব্যাপী নানা আয়োজনে আমন্ত্রিত অতিথিরা বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন।


এবারের আসরে প্রকৃতি সম্পর্কিত বিশেষ রিপোর্টিংয়ের জন্য বাটারফ্লাই মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড'২৪ (ডিজিটাল ক্যাটাগরিতে) লাভ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের ৫১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোঃ সজীবুর রহমান সজীব। তিনি বাহান্ন নিউজ এবং দৈনিক জনবাণী পত্রিকায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণে বিশেষ অবদানের জন্য বন ও প্রকৃতি বিষয়ক সংগঠন ‘প্ল্যানটেশন ফর নেচার’ এর প্রতিষ্ঠাতা সবুজ চাকমাকে বাটারফ্লাই অ্যাওয়ার্ড-২০২৪ প্রদান করা হয়। এছাড়া প্রজাপতি নিয়ে গবেষণা কর্মের জন্য বাটারফ্লাই ইয়াং ইনথুসিয়াস্ট অ্যাওয়ার্ড'২০২৪ লাভ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. সাব্বির আহমেদ।


মেলার আয়োজনকে ঘিরে শিশু-কিশোরদের পাহাড় সমান আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো। হরেক রকমের প্রজাপতির ওড়াউড়ি শিশু-কিশোরদের মনে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিচিত্র ও মনোমুগ্ধকর এসব প্রজাপতির পাখা যেন রঙ ছড়াচ্ছে শিশু-কিশোরদের মনে। মেলা উপলক্ষে বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রজাপতি পার্ক ও গবেষণা কেন্দ্র জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। দিনব্যাপী সেখানে জীবন্ত প্রজাপতি, প্রজাপতিবান্ধব বৃক্ষরাজি ও প্রজনন ক্ষেত্রসহ উন্মুক্ত বাগান ঘুরে দেখেন দর্শনার্থীরা।


আরও পড়ুন: জাবিতে গাঁজা সেবনকালে দুই ছাত্রী আটক


মেলার আহ্বায়ক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় ১১০ প্রজাতির প্রজাপতির দেখা মিলতো। কিন্তু ক্যাম্পাসে নগরায়নের ফলে প্রজাপতি তার আবাসস্থল হারাচ্ছে। এখন ক্যাম্পাসে ৭০ প্রজাতির প্রজাপতির  দেখা মিলে। আমরা বৃক্ষরোপণের ফলে হয়তো বড় বড় গাছ লাগাই, কিন্তু নিচের ঝোঁপঝাড় হচ্ছে প্রজাপতির আবাসস্থল। সেটা একবার নষ্ট হয়ে গেলে আর লাগানো হয়না। ফলে দিন দিন কমছে প্রজাপতির পরিমাণ। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই প্রাণ-প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবে। তিনি আরও বলেন, প্রজাপতি এই পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পরাগায়নের মাধ্যমে প্রজাপতি পরিবেশ ও প্রকৃতি এবং বনাঞ্চল রক্ষায় ভূমিকা রাখছে। প্রজাপতিসহ বিভিন্ন পতঙ্গ আমাদের বাস্তুসংস্থান টিকিয়ে রেখেছে। তিনি প্রজাপতি রক্ষায় এর বাসযোগ্য পরিবেশ অক্ষুণ রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং প্রজাপতিসহ সকল পতঙ্গ টিকিয়ে রাখতে জৈববৈচিত্রের সাথে সমন্বয় করে দ্রুত মাস্টারপ্ল্যান কার্যকরের দাবি জানান তিনি।


প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, প্রজাপতিসহ সকল প্রাণের প্রতি মানুষের দায়িত্ব শুধু সহানুভূতি দেখানো নয়, তাদের প্রতি আমাদের নৈতিক দায়বদ্ধতাও রয়েছে। প্রজাপতি মেলা আয়োজনের মাধ্যমে আমাদের নৈতিক বিবেচনা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। প্রজাপতির কাছ থেকে মানুষের শেখার আছে। প্রজাপতি পরাগায়ণের মাধ্যমে কোনো প্রকার ক্ষতি ছাড়াই আমাদের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ধর্ম, বর্ণ এবং বৈচিত্র্যেভেদে মানুষের কাছেও সকল মানুষ নিরাপদ হতে হবে। প্রজাপতির কাছ থেকে গোটা বিশ্বকে নিরাপদ রাখার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে মানুষকে। সকল ষড়যন্ত্র থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে হবে। এছাড়া উপাচার্য প্রকৃতির সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সবাইকে দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানান।


অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সোহেল আহমেদ, জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক মোহাম্মদ মাফরুহী সাত্তার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মাসুদ,  প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের অধিকর্তা মুকিত মজুমদার বাবু, বন বিভাগের বণ্যপ্রাণী অপরাদ দমন ইউনিটের পরিচালক মো: ছানাউল্যা পাটওয়ারী এবং আরণ্যক ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি মুরাদ বিন আজিজ প্রমুখ।


আরএক্স/