দখলদারিত্বে বিলুপ্তির পথে দেশের নদ-নদী
মো. বাকি বিল্লাহ
প্রকাশ: ০৭:২৩ অপরাহ্ন, ১১ই ডিসেম্বর ২০২৪
এই ভরা-এই মরা এভাবেই চলছে বাংলার নদ-নদী। খাল ভরাট-ছোট নদী দখল, অবৈধ ড্রেজারে বালু উত্তলোন, শিল্প-কারখানার বর্জ্য আধমরা করে ফেলেছে দেশের নদ-নদীগুলোকে। রূপ-জৌলুসের নদীগুলো আজ শুধুই আক্ষেপ। মনুষ্যসৃষ্ট কৃত্রিম দুর্যোগে নদী এখন কাল দাড়াচ্ছে সুজলা-সুফলা সোনার বাংলার জন্য। অসময়ে ভাঙন, নদীতে চরম পানিশুণ্যতা, আকস্মিক বন্যা, খরায় বিপর্যয় দেখেও যেন অসহায় প্রশাসন।
তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে নদীভাঙনের ফলে ভূমি বিলীন হয়েছে প্রায় সাত লাখ একর। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ। এ সময়ে অর্থনৈতিকভাবে দেশের ক্ষতি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ৮৫টি শহর ও বন্দরসহ মোট ২৮৩টি স্থানে নিয়মিত প্রতি বছর নদীভাঙন দেখা দেয়।
নদীমাতৃক এ দেশের এক বড় সমস্যা নদীভাঙন। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক অভ্যন্তরীন সর্বোচ্চ প্যানেল-আইপিসিসির সম্প্রতি এক পরিসংখ্যানে বলা হয় বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫ থেকে ৬ হাজার হেক্টর জমি বিলীন হচ্ছে নদী ভাঙ্গনে। এ হিসেবে গেলো ২০ বছরে নিশ্চিহ্ন হয়েছে দেশের অন্তত ১ লাখ হেক্টর ভূমি। আর্থিক হিসেব ধরলে যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। নদী ভাঙ্গন ঠেকাতেও গেলো দুই দশকে ১ লাখ কোটি টাকার অধিক ব্যায় হয়েছে। আইপিসিসি বলছে-নদীভাঙ্গনই এখন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ঝুঁকির দুর্যোগ। এখন বছরে গড়ে প্রায় ২ লাখ মানুষ নদী ভাঙ্গনে সর্বশান্ত হচ্ছেন। এসব মানুষ জীবন জীবিকা আর কর্মসংস্থানের জন্য গ্রাম ছেড়ে আসছেন শহরে।
জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে দেশের বড় বড় নদীগুলির ভাঙ্গনের তীব্রতা গেলো কয়েক বছর ধরে বাড়ছে। ফলে বহু পাড়া-মহল্লা, ইউনিয়ন এমনকি উপজেলার মানচিত্রও পাল্টে যাচ্ছে। এমনকি সীমান্তের অনেক নদীর অস্বাভাবিক ভাঙ্গন দেশের সীমান্ত রেখা বদলে দিচ্ছে। এমন আশংকা উল্লেখ করেছে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস (সিইজিআইএস)। সীমান্ত এলাকায় নদী ভাঙ্গন কেনো এতো বিধংসী হচ্ছে- তাও খুঁজে বের করেছেন গবেষকরা। তারা বলছেন-বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যে ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহিত হচ্ছে তার প্রধান ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা। এ চারটি নদীই সবচেয়ে বেশী ভাঙ্গনের শিকার। নদীরপাড় গঠনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সবচেয়ে বেশী ভাঙ্গনপ্রবণ হল যমুনা নদী। এরপর পদ্মা। অতিরিক্ত পলি পড়ে নদীর তলদেশ ভরাট, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য নদীর গতিপথ পরিবর্তন এবং শাখা-উপশাখা দখল ও ভরাটও ডেকে আনছে নদী ভাঙ্গনের এই মহা সর্বনাশ। প্রধান নদীগুলো ছাড়াও তিস্ত, ধরলা, আত্রাই, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, কুশিয়ারা, খোয়াই, সুরমা, মনু, মগড়া, ধনু, জুরী, সাঙ্গু, ধলাই, গোমতী, মাতামুহুরি, মধুমতি, সন্ধ্যা, বিশখালী এসব নদীও ভাঙ্গনপ্রবণ। এসব নদীর অন্তত দেড়’শ স্পটে এখনো বড় ধরনের ভাঙ্গন বিদ্যমান।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গানের কথা মনে পড়ে যায়, ‘একূল ভাঙে ওকূল গড়ে এই তো নদীর খেলা।’ সংবাদমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন নদীতীরবর্তী জনপদে নদীভাঙনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। নদীভাঙন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বছরের অন্যান্য সময় নদীভাঙনের খবর খুব বেশি শোনা না গেলেও প্রতি বছরের বর্ষা মৌসুমের সময়টাই নদীভাঙন মারাত্মক আকার ধারণ করে।
সম্প্রতি পদ্মা, মেঘনা, যমুনা নদী ও এসব নদ-নদীর শাখা নদীতে ভাঙনের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে নদী পারের বাতাস। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ও শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায় পদ্মার ভাঙন ও রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় তিস্তা নদীর ভাঙন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। পদ্মার ভাঙন মানুষের স্বপ্ন ভাঙছে, কপাল পুড়ছে। নিজেরাই ভেঙে ফেলছেন নিজেদের হাতে গড়া আপন ঘরবাড়ি। চেনা নদী বাড়ির দুয়ারে এসে হানা দিয়েছে অচেনা ভয়ংকররূপে। মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে নদী পারের কোনো কোনো গ্রাম-ইউনিয়ন! সাধারণত প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে নদীর ভাঙন দেখা দেয়। প্রতি বর্ষা মৌসুমে নদনদীর ভাঙন যেন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের খাল-বিল-প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে নদীর ওপর বাড়তি পানির চাপ পড়ছে। বৃষ্টিপাত ও নদীর উজানে পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্রচণ্ড গতির সৃষ্টি হলে ভূমিক্ষয় ত্বরান্বিত হয়। তা ছাড়া নদী সমুদ্রের কাছাকাছি এলে স্রোতের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। নদীর গতিপথে বাধা সৃষ্টি হলে সেই বাধা ঠেলে সবকিছু ভেঙেচুরে নদী সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। নদীতে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ দিলে তা নদীভাঙনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নদীতীর পলি মাটি দ্বারা ভরাট হওয়ার কারণে অল্প বৃষ্টিপাতেও নদীভাঙনের সৃষ্টি হতে পারে। দিনে দিনে নদ-নদীগুলোর নাব্য সংকট বেড়ে যাচ্ছে। নদীগুলো থেকে অপরিকল্পিত ও অবৈজ্ঞানিকভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে নদী শাসন করা হচ্ছে। নদীর ওপর এতসব অত্যাচারের কারণে নদীভাঙন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদীভাঙনের প্রাকৃতিক কারণ রোধ করা না গেলেও মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলোও যদি দূর করা যায় তাহলে অর্ধেকের বেশি এলাকায় নদীভাঙন কমানো সম্ভব হবে।
সারাদেশে ব্যাপক ভাঙন কবলিত এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম রংপুর, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, ফরিদপুর, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, নীলফামারী। এসব অঞ্চলে মানুষদের মাঝে সময়-অসময় ভাঙন আতঙ্ক বিরাজমান। তাছাড়া শুস্ক মৌসুমের খরা হয়ে দাড়ায় মরার উপর খাড়ার ঘা। এছাড়াও ফসল নষ্ট হয়ে হাজারো পরিবার অনাহারে দিন কাটায়। সর্বশান্ত অনেক পরিবারের অনেকেই আজ পর্যন্ত মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি।
অন্যদিকে ফারাক্কাবাধ, ফারাক্কা নিয়ে সমস্যা চলমান স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই। রাজনৈতিক জাতাঁকলে পড়ে ফারাক্কা সংকট সমস্যা আলাপ আলোচনা গড়িয়ে দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। ১৯৭৪ সালে ফারাক্কা ফিডার ক্যানেল মাত্র ৪১ দিনের জন্য পরিক্ষা মূলক চালু করা হয়েছিল। ৪১ দিন ৪১ বছরে গড়িয়ে গেছে, শুল্ক মৌসুমে নদীর পানিতে টান পড়েছে। তবুও পরিক্ষামূলক ফারাক্কার ৪১ দিন শেষ হয়নি? রাজনৈতিক ঘূর্ণিবতে ১৯৭৪ সালের ৪১ দিন ২০২৪ পর্যন্ত এসে গেছে, যা অতীত ও বর্তমান সর্বসময়ে বাংলাদেশের গলার কাঁটা হিসাবে ঝুলছে। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। অসংখ্য নদী ও তাদের শাখাপ্রশাখা জড়িয়ে রেখেছে এদেশের ভূমিকে। নদীবাহিত পলিমাটি এদেশের মাটিকে অনন্যা উর্বরতা দান করেছে। আমাদের নদী মাছ সমৃদ্ধ এবং জমি গুলো ফসল উৎপাদন স্বর্গরাজ্য হিসাবে বিবেচিত। আগের মত সুদিন বর্তমানে ধ্বংসের দিকে। নদীর পানির চরম সংকট এবং গভীরতা কমে যাওয়ার প্রভাবে জনজীবন পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। নদীর গভীরতা হ্রাস পাওয়াতে শুকনো মৌসুমে নদীর চেহারা মৃত পশুর হাড়ের মত চেহারা হয়ে যায়। পানি শূন্য হয়ে স্থানে স্থানে চর জেগে উঠে । তাছাড়া বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি হয় বন্যা। বাংলাদেশে বন্যা প্রাকৃতিক দূর্যোগ। প্রাকৃতিক দূর্যোগ সামাল নেওয়া যতটা না সহজ কৃত্রিম দূর্যোগ সামাল দেওয়া ততোধিক কঠিন। ভরা মৌসুমে ভারতের অতিরিক্ত পানির অংশ ছেড়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশের দিকে। ফারাক্কা বাঁধ হয়ে অতিরিক্ত পানি দেশে প্রবেশ করলে নিম্নঅঞ্চল সহজে প্লাবিত হয়। ফসলি জমির ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। কখনো সম্পূর্ণ জমি তলিয়ে যায় পানির নিচে। জলাবদ্ধতা কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়ছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানিয়েছেন, আগামী বছর পহেলা বৈশাখে নদ-নদীর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় পানি ভবনের মাল্টিপারপাস হলরুমে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের নদ-নদীর সংখ্যা নির্ধারণ বিষয়ক এক অবহিতকরণ সেমিনারে তিনি এ কথা জানান।। পাশাপাশি ৩ মাসের মধ্যে সব জেলার খালের তালিকা পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন উপদেষ্টা। উপদেষ্টা বলেন, নদ-নদীর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় একইসঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়কেও যুক্ত করা হবে। মৃত নদী বলতে কোনও নদী নেই, প্রবাহহীন বলতে পারেন। প্রবাহহীন নদীকে প্রবহমান করার অনেক প্রক্রিয়া বা রাস্তা আছে। মৃত নদী দেখিয়ে নদীর জায়গা ইজারা বা লিজ দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। আমরা কিন্তু হাওরের তালিকা চূড়ান্ত করে ফেলেছি, আমরা বিলেরও একটা তালিকা চূড়ান্ত করে ফেলেছি। পরবর্তী কাজ হচ্ছে খালের তালিকা চূড়ান্ত করা। অবহিতকরণ সেমিনারে ভার্চুয়ালি যুক্ত থাকা সারা দেশের জেলা প্রশাসকদের গতকাল মঙ্গলবার থেকে আগামী ৩ মাসের মধ্যে জেলার সব খালের তালিকা রেকর্ড অনুযায়ী যাচাই-বাছাই করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্য উপদেষ্টা নির্দেশনা দেন উপদেষ্টা। ঢাকার চারপাশে থাকা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা এই ৩টি নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করার একটা বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা করে কাজ শুরু করার জন্য উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। তিনি আরও বলেন, ঢাকার ভেতরে থাকা ২১টি খাল দখল ও দূষণমুক্ত করে একটা ব্লু নেটওয়ার্ক করার পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছি এবং এটির বাস্তবায়ন কাজ দ্রুতই শুরু করা হবে। দেশের প্রতিটি জেলায় ১টি করে নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করার কাজ আমরা অচিরেই শুরু করে দেবো। সেমিনারে অতিথির বক্তব্যে নৌ-পরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বাংলাদেশ নদীবিধৌত দেশ। এ দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নদ-নদীর ওপর নির্ভরশীল। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য উন্নয়নের নামে নদ-নদী খালবিল দখল করা হয়েছে। নদীকে বাঁচাতে হলে দূষণ ও অবৈধ দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করতে হবে। নদী বাঁচানোর এখনই উপযুক্ত সময়। অন্য সময় করতে হলে স্বার্থের সংঘাত শুরু হবে। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মুহাম্মদ আমিরুল হক ভূঞাসহ আরও অনেকে।
আরএক্স/