গুমের সঙ্গে জড়িত ছিল যেসব স্পেশাল সংস্থা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৭:১৬ অপরাহ্ন, ১৮ই ডিসেম্বর ২০২৪
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন জানিয়েছেন, গুমের সঙ্গে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি), ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই), গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) এবং ভারতের এজেন্টরা জড়িত ছিল।
সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পতিত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে হওয়া গুমের তদন্ত শেষে এমনই ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।
নূর খান লিটন বলেন, আমরা যে পরিমাণ সিক্রেট সেল দেখেছি, যে পরিমাণ বন্দিরা ফেরত এসেছে, তাদের বয়ান থেকে আমরা যা জেনেছি তা- সত্যিই ভয়াবহ। বন্দিদের রাখা হতো ৪ ফিট লম্ব আর ৩ ফিট চওড়া ছোট্ট ঘরে। সেখানে রাতদিনের কোনো তফাৎ বোঝা যেত না। বন্দিরা তাদের খাবার দেখেই দিনরাতের হিসাব মেলাতেন। বন্দি ঘরের দেয়ালে গুহামানবদের মতো আঁচড় দিয়ে বিভিন্ন কথা লিখে রাখতেন বন্দিরা। বাথরুমের চেয়েও ছোট সেসব বন্দিঘর। সেখানে আলো-বাতাস সীমিত পরিমাণে প্রবেশ করানো হতো, যাতে সেখানকার বন্দিরা রাতদিনের পার্থক্য না বোঝে।
আরও পড়ুন: ইজতেমা মাঠে দু-পক্ষের সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়েছেন: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
তিনি বলেন, যখন খাবার দেওয়া হতো, বন্দিরা খাবার দেখে শনাক্ত করতে পারতেন এখন দিন না রাত। সকালের নাস্তায় সাধারণত রুটি বা খিচুড়ি দেওয়া হতো, যা দেখে বুঝতো তারা একটি দিন পার করেছে। আমরা গুহামানবের কথা শুনেছি, যেখানে তারা দেয়ালে চিত্র আঁকতো, বিভিন্ন সংকেত লিখে রাখত।
তিনি আরও বলেন, আমরা দেখেছি বন্দিরা থালা দিয়ে বা ইটের টুকরা দিয়ে দেয়ালে আঁচড় কেটে দিনের হিসাব রাখত। এভাবে আমরা ১৮২ দিন থেকে ৩০০ দিনের মতোও ডেট পেয়েছি। অস্পষ্ট কয়েকটি মোবাইল নম্বর এবং দুএকটি নামও পেয়েছি। মানুষ মৃত্যুর আগে যে আকুতি জানায়- সেসব মর্মস্পর্শী বার্তাও সেখানে পেয়েছি। যেমন- কেউ লিখেছেন ‘আই লাভ মাই ফ্যামিলি’। কেউ লিখেছেন- ‘বিজয় সুনিশ্চিত’। কেউ লিখেছেন- ‘হে আল্লাহ তুমি আমাকে রক্ষা করো’ আবার কেউ কোরআনের আয়াত লিখে রেখেছেন।
নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে নূর খান লিটন বলেন, পাশাপাশি মানুষকে কীভাবে নির্যাতন করা হতো তার কিছু সিনড্রোম (নমুনা) আমরা হাতে পেয়েছি। কাউকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে যখন হত্যা করা হয়; তখন তাকে ইনজেকশন পুশ করা হয় অথবা কাউকে পলিথিন দিয়ে মুখ মুড়িয়ে শ্বাস রোধ করে হত্যা করা হয়। সেসব মরদেহ পেট কেটে সিমেন্টের বস্তা দিয়ে বেঁধে নদীর মাঝখানে ফেলে দেওয়া হতো। ফেলে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা কিছু কিছু জায়গায় দেখেছি। পোস্তগোলায় একটা নৌকা আমরা দেখেছি যেটা সুন্দরবনের দস্যুদের কাছ থেকে উদ্ধার করা। পরে সেই নৌকাটি ঢাকায় নিয়ে এসে গুমের হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা হতো। নদীতে নেওয়ার ক্ষেত্রে এই নৌকাটি ব্যবহৃত হয়েছে। যখন ভিকটিমকে নেওয়া হতো হত্যার উদ্দেশে, তখন নৌকার চারপাশে র্যাবের সদস্যরা পাহারা দিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্পিড বোর্ড থাকত যা নৌকার চারপাশে চক্কর দিতে থাকত।
তিনি বলেন, অনেক সময় রাতের অন্ধকারে গুলি করে ডেড বডি নদীতে ফেলে দেওয়া হতো। লাশ ফেলানোর লোক না পাওয়ায় অনেক সময় কোনো কোনো ডেড বডি ২-৪ দিন ফ্রিজিং করেও রাখা হতো। তারপর সেসব ডেড বডি নিয়ে গাজীপুরের টঙ্গী এলাকার রেললাইনের ওপরে ফেলে রাখত। এ ক্ষেত্রে অনেক হিসাব-নিকাশ করেই তারা ডেড বডি ফেলতো।
আরও পড়ুন: ইজতেমা মাঠ ছাড়ছেন মুসল্লিরা
৭ আগস্ট গঠন করা হয় পাঁচ সদস্যের গুম তদন্ত কমিশন। এই কমিশনের কাছে গত তিন মাসে জমা পড়েছে এক হাজার ৬৭৬টি অভিযোগ। যার মধ্যে ৫৫৮ জনের অভিযোগের যাচাইবাছাই করে আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ শিরোনামে প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় গুম তদন্ত কমিশন। তদন্তকালে জানা গেছে বাংলাদেশের দেশীয় বাহিনীর পাশাপাশি ভারতীয় বিভিন্ন বাহিনীর সম্পৃক্ততাও পাওয়া গেছে।
নূর খান লিটন বলেন, আমরা অনুসন্ধানের সময় ৯টি সিক্রেট সেল পেয়েছি। আমরা ইতোমধ্যে ঢাকা ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকা নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের সেলগুলো পরিদর্শন করেছি। ঢাকার ভিতরে এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে এমন সেল গঠন করা হয়েছে। এসব সেলে বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার করা হতো। এটা সিটিটিসি করেছে, ডিজিএফআই করেছে, ডিবি করেছে।
তিনি বলেন, একটা কথা পরিষ্কার করতে চাই সেটা হলো, আমরা সম্ভাব্য অপরাধীদের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করেছি। যেখানে যার বক্তব্য নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেছি তার বক্তব্যই নিয়েছি। সম্পূর্ণ বিষয়টি নিশ্চিত করে তারপরে আমরা প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছি। পুরো জিনিসটাই আমাদের ধারণ করা। পুরো ভিজুয়ালাইজ করে রাখা হয়েছে। প্রশ্ন করার সুযোগ থাকলেও প্রশ্ন করে আমাদের দুর্বল করা যাবে না। কারণ যা সত্য আমরা তাই প্রকাশ করেছি।
আরও পড়ুন: ডি-৮ সম্মেলনে যোগ দিতে কায়রো পৌঁছেছেন ড. ইউনূস
এখনো গুমের শিকার হওয়া অনেকেই অভিযোগ করতে ভয় পাচ্ছেন। তাদের অভয় দিয়ে তিনি বলেন, মানুষ স্পষ্টভাবে কথা বলতে চাচ্ছে না। যারা ছাড়া পেয়েছেন বা গুমের শিকার হয়েছেন তারা এখনো পর্যন্ত স্বাভাবিক হতে পারেননি। তাদের মধ্যে এখনো যে ধারণা রয়ে গেছে তা হচ্ছে স্বৈরাচার যদি আবার তাদের কোনো ধরণের ক্ষতি করে! একটি সময় পার হলে এই অভিযোগের সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে আশা করা যায়। কারণ এই অপরাধ এত বিস্তৃত ছিল এত গভীরে ছিল, অপরাধের মূল আমরা কল্পনাও করতে পারব না। এই অপরাধ যে কত ভয়াবহ ছিল, কত নির্মম ছিল, কত বর্বর ছিল, তা কল্পনাও করা যায় না। একটি বয়ান শুনেও বিশ্বাস করতে পারিনি। যখন আমরা সিক্রেট সেলগুলো, সিক্রেট প্রিজমগুলো সরেজমিনে দেখেছি, তখন আমরা বিশ্বাস করেছি এসব ঘটনা আসলে কত ভয়াবহ হতে পারে।
এমএল/