আপন ভুবন


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


আপন ভুবন

নোয়াখালীর জয়পুরা গ্রামের ৭০ বছর বয়সী মিলন বেগম যাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখে নির্যাতন করা হত, সাতান্ন বছরের তিতলী মা, ৬০ বছরের বৃদ্ধা মানসিকভাবে অপ্রকৃতস্থ বিবি আছিয়া, জন্মগত বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বরগুনার বৃদ্ধা আনোয়ারা বেগম, সিরাজগঞ্জের রাবেয়া বেগম জন্মের সময়ই যাকে সবার চোখের আড়ালে ঘরের পিছনে মাটিতে পুঁতে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিলো  অথবা ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার পাগলী মা এরা সবাই এখন আপন ভুবন বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা। প্রতিষ্ঠানটির সদস্যদের আন্তরিক ভালোবাসায় তাঁরা এখন আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ।
 
অসহায় আশ্রয়হীন মায়েদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য, মানুষ হিসাবে মানুষের জন্য কিছু করার তাড়না থেকে ‘আপন ভুবন’ বৃদ্ধাশ্রমটির জন্ম। বয়সের ভারে নুহ্য হয়ে পড়া বিতাড়িত এবং বিপর্যস্ত মায়েদেরকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ এবং আনন্দিত রাখা সহজ কোন কাজ নয়। সারাটা জীবন পরিশ্রম করে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সন্তানের কাছ থেকে নিগ্রহের স্বীকার হওয়া, ঘাত-প্রতিঘাতে জীবনের প্রতি বিশ্বাস উঠে যাওয়া মায়েদের মুখে একটুখানি হাসি ফোটানো অত্যন্ত কঠিন। আপন ভুবনের মানুষগুলো নিজেদের ঐকান্তিক দায়বোধ থেকে সাধ্যের বাইরে চেষ্টা করেন এই অসহায় আর বঞ্চিত মায়েদের মুখে একটুখানি হাসি ফোটানোর জন্য।  

আমাদের দেশে অনেক বয়স্ক মা আছেন যারা অকালে সন্তান হারিয়েছেন। ভিটা বাড়ী আশ্রয় সব হারিয়ে মানবেতরভাবে তাঁদের জীবন কাটছে রাস্তার ধারে, যাত্রী ছাউনীর ফাঁকা বেঞ্চিতে অথবা হয়তো কোন নর্দমার পাশে। নির্বাক চোখে দীর্ঘনিঃশ্বাস নিয়ে অপেক্ষায় আছেন জীবনের শেষ মুহূর্তের জন্য। সমাজের এই নিপীড়িত, অবহেলিত মায়েদের সম্পূর্ণ ভরণপোষণ, চিকিৎসা এবং নিরাপদ আশ্রয় দিচ্ছে  আপন ভুবন নামের এই বৃদ্ধাশ্রমটি। শতভাগ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান আপন ভুবন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে অসহায় বৃদ্ধা মায়েদের বাসস্থান, খাবার এবং চিকিৎসা সহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বন্দবস্ত করার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। বৃদ্ধাশ্রমটি একদল অবৈতনিক স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে অনুপ্রাণিত। মানুষ হিসাবে নিজেদের ঐকান্তিক দায়বোধ থেকে এখানে তাঁরা বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। এই শহরে আক্ষরিক অর্থেই যারা অসহায় এবং আশ্রয়হীন, পরিবার থেকে বিতাড়িত এবং বঞ্চিত এমন মায়েদের খোঁজে গভীর রাতে বের হয়ে পড়েন আপন ভুবনের এই স্বেচ্ছাসেবক সদস্যরা। এমন কাউকে খুঁজে পেলে বিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ নিয়ে আসেন আপন ভুবনে।  

আপন ভুবনে তিনবেলা সকাল দুপুর ও রাতের খাবারসহ আরো দুইবেলা (সকাল ১১:৩০ এবং বিকাল বেলা) খাবারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বৃদ্ধা মায়েদের বয়সের বিবেচনায় দৈনন্দিন খাদ্য নির্বাচন করা হয় এখানে। খাবারের সাথে প্রতিষ্ঠানটির সামর্থ্যের মধ্যে বৃদ্ধা মায়েদের সীমিত আকারে চিকিৎসা সেবাও দেয়া হচ্ছে। সপ্তাহে একদিন ডাক্তার এসে চিকিৎসা নির্দেশিকা দিয়ে যাচ্ছেন। বয়স্ক বৃদ্ধাদের নাজুক শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট নিয়মিত সেবা দিচ্ছেন। দুজন শারীরিক প্রতিবন্ধী জায়গা পেয়েছেন প্রতিষ্ঠানটিতে। সুস্থ করে তোলার জন্য তাঁদের দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে বর্তমানে। একজন সন্তান তার বাবা-মাকে যেভাবে আগলে রাখেন এই প্রতিষ্ঠানটিও সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছে আপনজনের মত তাঁদেরকে আগলে রাখতে। 

কথা হল এই বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেয়া বৃদ্ধা মিলন বেগমের সাথে। বয়স ৭০ পার করেছেন। একসময় বাস করতেন নোয়াখালীর জয়পুরা গ্রামে। জীবনে অত্যন্ত অমানবিক অত্যাচারের শিকার হয়েছেন এই বৃদ্ধা মা। স্বামী ছিল ড্রাইভার, আয়-রোজগারও ভালই ছিল। কিন্তু স্বামীর কাছে থেকে কখনোই স্ত্রীর মর্যাদা পাননি তিনি। এক পর্যায়ে এই স্বামীর কাছ থেকে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। তাকে শিকল দিয়ে আটকে রাখত ঘরের এক কোনায়। ধীরে ধীরে মানসিক ভারসম্য হারান মিলন বেগম। পাশের বাড়ির প্রতিবেশী তাঁর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একদিন সুযোগ বুঝে কোমরের শিকলের বন্ধন থেকে মুক্ত করেন তাঁকে। এরপর থেকে তিনি একাকী রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেন আর প্রলাপ বকতেন। অভুক্ত অনাহারে প্রায় অচেতন অবস্থায় প্ড়ে ছিলেন ফুটপাথে। আপন ভুবনের এক স্বেচ্ছাসেবক সদস্য রাত তিনটার দিকে রামপুরাতে তাঁকে খুঁজে পান। কালবিলম্ব না করে মানসিক ভারসাম্যহীন, অভুক্ত এবং ধূলিমাখা অবস্থাতে তাকে নিয়ে আসা হয় আপন ভুবনে। মিলন বেগমের থাকা-খাওয়া এবং চিকিৎসার দায়িত্ব নেয় প্রতিষ্ঠানটি। শারীরিক চিকিৎসা দেয়ার পরবর্তীতে তাঁর মানসিক চিকিৎসার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। আপনারা জানেন মানসিক চিকিৎসা বেশ জটিল এবং সময় সাপেক্ষ বিষয়। ভালোবাসা আর নিবিড় পরিচর্যায় ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হওয়া শুরু করেছেন মিলন বেগম। ডাক্তারের সাথে কথা বলার সময় অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে বলেন আমি মরেই গিয়েছিলাম, এখানে আমি নতুন জীবন পেয়েছি।  

তিতলী মা, আদর করে এই নামেই এখন তাঁকে ডাকেন আপন ভুবনের সদস্যরা। সাতান্ন বছরের অসহায়, দরিদ্র, পরিবার বঞ্চিত এই বৃদ্ধাকে আপন ভুবনের এক স্বেচ্ছাসেবক সদস্য গত ২৬ শে ফেব্রুয়ারী ২০২২ রাত তিনটার সময় খুঁজে পান। তাঁর জীবনের ঘটনা নিতান্ত মর্মান্তিক এবং হৃদয়বিদারক। উনচল্লিশ বছর আগে তিতলী মায়ের এক রিক্সা চালকের বিয়ে হয়। নতুন সংসার ভালোই কাটছিল। দুই সন্তানের জননীও হন সময়ের পরিক্রমায়। কিন্তু সতের বছর আগে এই মায়ের জীবনে হঠাৎ করেই এক অমানিশা নেমে আসে। তাঁর স্বামীর শরীর আজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে ধীরে ধীরে প্যারালাইজড হয়ে মারা যান। সন্তানের জন্য দুমুঠো ভাতের ব্যবস্থা করতে তিতলী মা রাস্তায় রাস্তায় কাগজ কুড়িয়ে তা বিক্রি করা শুরু করেন। কখনো আধবেলা কখনো অভুক্ত থেকে দিনগুলি পার হতে থাকে। এর মধ্যেই বড় ছেলে বিয়ে করে নতুন বউ ঘরে তুলে আনে, সংসারে টাকাপয়সা দেয়া বন্ধ করে দেয়। অভাবের সংসারে টানাটনি, অশান্তি নিত্য দিনের বিষয়। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে মা সন্তান-সংসার ছেড়ে রাস্তাতে নামতে বাধ্য হন। কিন্তু অর্ধাহারে অনাহারে শরীর আর আগের মত চলতে চায় না। বয়সের ভারে ন্যুহ্য হয়ে পড়া এই শরীর নিয়েই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কাগজ কুড়িয়ে তা বিক্রী করে একদিন খাবার জোটে তো অন্যদিন জোটে না। এমন অবস্থায় খিলগায়ের ব্রীজের নীচে আপন ভুবনের এক স্বেচ্ছাসেবকের চোখে পড়েন তিনি, মাকে নিয়ে আসা হয় আপন ভুবনে। আপন ভুবনের প্রায় সব মায়েদেরই জীবন কাহিনী এমনভাবে কোন না কোন দুঃখে জর্জরিত। 

এই বৃদ্ধাশ্রমটির মায়েদের সাথে কথা বলে জানা গেছে তাঁরা এখানে ভালো আছেন, তাঁদের হারানো পরিবারকে এখানে খুঁজে পেয়েছেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁরা এখানেই থাকতে চান। যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সেবা দিয়ে যাচ্ছে সেহেতু সমাজের পক্ষ থেকে সামর্থ্যবান এবং প্রভাবশালী সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গ যদি আর্থিক সহায়তা বা অনুদান নিয়ে এই মহৎ কাজে পাশে এসে দাড়ান তাহলে আমাদের এই সমাজেরই কোন একজন পরিবার বঞ্চিত অসহায় মা হয়তো তাঁর আশ্রয় খুঁজে পাবে, থাকার একটু ঠাই পাবে। বর্তমানে আপন ভুবনের একমাত্র শাখা বাসাঃ ৩৬, রোডঃ ২০, সেক্টরঃ ১৩, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০। মোবাইলঃ +88 01886 107 109,  ওয়েবসাইট: www.aponbhubon.com

এসএ/