গণপূর্তে হরিলুটের মাস্টার প্রকৌশলী চুন্নু
বশির হোসেন খান
প্রকাশ: ১১:২৭ পূর্বাহ্ন, ২৯শে জানুয়ারী ২০২৫
# মুখে ধান অন্তরে নৌকা
# কাজ না করেই টাকা উত্তোলন
# শতকোটি টাকার মালিক
এদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিন
- ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি
ফরিদপুর গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী মো.সাইফুজ্জামান চুন্নুর আধিপত্যের গল্প কে-না জানে। ক্ষমতার ব্যবহার কিভাবে করতে হয় তা তিনি অক্ষরে অক্ষরে দেখিয়েছেন গণপূর্তের প্রকৌশলীদের। আওয়ামী লীগের তোকমা লাগিয়ে কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে ঢাকায়।
এ সময়ে তিনি নিজের ইচ্ছেমতো ঠিকাদারদের কাজ দেওয়া থেকে শুরু করে নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পছন্দের ঠিকাদারদের কাজে লাগিয়ে প্রায় শত’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পক্ষে অর্থ জোগান দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। রামপুরা থানায় ছাত্র হত্যা মামলায় আসামীও তিনি। অদৃশ্য ক্ষমতা দেখিয়ে দুর্নীতির বরপুত্র সাইফুজ্জামান চুন্নু এখন বিএনপি হতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। একদিকে তিনি আওয়ামী লীগের দাপুটে নেতা, অন্যদিকে তিনি মন্ত্রী ও সচিবের আস্থাভাজন। এই দুই ক্ষমতার প্রভাবে তিনি গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব ক্যাড়ার বাহিনী। ভয়ে তার অপকর্মের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদের সাহস করত না। তাই চুন্নু’র একক আধিপত্য চলত পুরো গণপূর্ত অধিদপ্তরে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গণপূর্ত অধিদপ্তরের ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৪ এর নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাকালীন সময়ে মো. সাইফুজ্জামান চুন্নু দুর্নীতি, নিয়োগ, বদলি, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, কমিশনের বিনিময়ে কাজ ভাগিয়ে নেয়া এবং প্রকল্পের কাজ না করেই অর্থ আত্মসাৎ করার মতোও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি রাজধানী ঢাকাসহ নিজ এলাকায় গড়ে তুলেছেন দুর্নীতির সাম্রাজ্য। গণপূর্ত অধিদপ্তরের মিরপুর ডিভিশনের পূর্ত সার্কেলে মিরপুর পাইকপাড়াস্থ পিডব্লিউডি ট্রেনিং সেন্টার (পুরাতন) এর ২য় তলার সিড়ির পূর্ব পাশের পূর্ব প্রান্তের ৭ ও ৮ নম্বরের দুটি কক্ষকে আইবি বাংলোতে রূপান্তরের লক্ষ্যে সংস্কার ও আধুনিকায়নের জন্য একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়া হয়। কোনরূপ কাজ না করেই ওই কাজের জন্য ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বরাদ্ধকৃত অর্থ আত্মসাত ও অনিয়মের একটি অভিযোগ পায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। উল্লেখ্য সেই সময় মিরপুর ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন মো. সাইফুজ্জামান চুন্নু। এই অভিযোগের বিষয়ে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মুহাম্মদ সোহেল হাসানকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তদন্তের এক পর্যায়ে মুহাম্মদ সোহেল হাসান উক্ত আইভি বাংলো পরিদর্শনকালে দেখতে পান, উক্ত কক্ষগুলোতে কোনরূপ কাজ না করেই ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বরাদ্ধকৃত অর্থ ইতোমধ্যেই উত্তোলন করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করা হয়েছে। তবে ৭ নম্বর কক্ষে দুই শ্রমিককে তড়িঘড়ি করে ডেকোরেশনের কাজ শুরু করতে দেখা যায়। তখন তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত নতুন করে কোনো কাজ না করার জন্য নির্বাহী প্রকৌশলীসহ অন্যান্যদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশনা অমান্য করে রাতের আঁধারে গোপনে উক্ত সংস্কার কাজ চলেছে বলে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে। পরবর্তীতে ওই দুটি কক্ষে যেনো আর কোনো সংস্কার কাজ না করতে পারে সেজন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী (সংস্থাপন) আহমেদ আব্দুল্লাহ নূর এবং নির্বাহী প্রকৌশলী (ই/এম) পবিত্র কুমার দাশ এর সহযোগীতায় উক্ত কক্ষ দুটিকে সিলগালা করার নির্দেশ দেয়া হয়। যা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (উন্নয়ন অধিশাখা-০৯) মো. মাহমুদুর রহমান হাবিবকে অবহিত করা হয়।
জানা গেছে, গণপূর্ত অধিদপ্তরের মিরপুর ডিভিশনের পূর্ত সার্কেলে থাকাকালীন বদলি হওয়ার আগমুহূর্তে প্রকল্পের এই অর্থ উত্তোলন করেন প্রকৌশলী সাইফুজ্জামান চুন্নু। বর্তমানে মিরপুর ডিভিশনের পূর্ত সার্কেলে দায়িত্বে আছেন রাশেদ আহসান। গণপূর্ত অধিদপ্তর মিরপুর বিভাগে থাকাকালে সবচেয়ে বেশি কাজ ভাগিয়ে নিয়েছেন চুন্নু। পরবর্তীতে ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৪ এসেও বড় বড় কাজ ভাগিয়ে নিয়েছেন তিনি। এর মাধ্যমে হাতিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। সাইফুজ্জামান চুন্নু সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের কাছের লোক বলে পরিচয় দিতেন। গণপূর্তের ঢাকা মেট্রো জোনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন কাজ ভাগিয়ে নেন। বর্তমানে তিনি গণপূর্ত প্রধান প্রকৌশলীর আস্থাভাজন হয়ে ওঠার জন্য তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে।
সূত্র জানায়, ২০২২ সালে মিরপুর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী থাকা অবস্থায় সাইফুজ্জামান চুন্নু ১৭৬টি কাজের চাহিদার বিপরীতে ১২ কোটি টাকা পেয়েছিলেন। তখন মিরপুরের আবাসিক এলাকার অধিকাংশ ভবন নতুন থাকায় সেই ১২ কোটি টাকা খরচ করার তেমন সুযোগ না থাকায় এর বেশিরভাগ টাকাই আত্মসাত করেছেন তিনি। এর আগে ঢাকার বাইরে থাকা অবস্থায় ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে ১৯ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বানের মতো অনিয়ম করেছেন তিনি। তাই তখন তাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
জানা যায়, বিভিন্ন অনিয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে স্বল্প সময়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলেছেন প্রকৌশলী সাইফুজ্জামান চুন্নু। গণপূর্তের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, গণপূর্ত অধিদপ্তরে একটি সিন্ডিকেট চক্র গড়ে তুলেছেন চুন্নু। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যেমে গণপূর্ত অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। দুর্নীতি ও অনিয়মের টাকায় গড়ে তুলেছেন একাধিক বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
এ বিষয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতারকে ফোন দিলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এ বিষয় অভিযুক্ত প্রকোশলী মো. সাইফুজ্জামান চুন্নুকে ফোন দিলে তিনিও ফোন রিসিভ করেনি। এমনকি ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে উত্তর পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ড. ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুর্নীতিবাজরা আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায়। তারা ক্ষমতাধর বলেই ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতিবাজরা সব সময় ক্ষমতাশীন দলের ছাত্রছায়ায় থাকেন। এদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিন। না হলে দুর্নীতি বাড়বে, কমবে না।
আরএক্স/