শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ জিনাতের শত কোটি টাকার প্রতারণা
বশির হোসেন খান
প্রকাশ: ০১:০১ অপরাহ্ন, ২রা ফেব্রুয়ারি ২০২৫
# চাঁদাবাজী, অপহরণ ও অর্থ আত্মসাৎ, হত্যার চেষ্টায় ৪৬ মামলা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে আত্মগোপনে আছেন প্রতারণার এই মাষ্টারমাইন্ড
# কর্মকর্তার যোগসাজশে অভিনব কায়দায় ৪ কোটি টাকার আয়কর ফাঁকির অভিযোগ
# প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে এজেন্ট নিয়োগ করে লন্ডন, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, জাপান, পর্তুগালে আদম পাচারের নামে প্রতারণা
# ৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরি থেকে ঢাকার পূর্বাচলে ১০ কাঠার প্লট, দুটি সিএনজি ফিলিং স্টেশন, হবিগঞ্জে তিন হাজার বিঘার ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্লট, আমেরিকায় বাড়ি
# সাবেক এমপি নিজাম হাজারীর রক্ষিতা
# ফাঁদে পড়ে নিঃশ্ব হয়েছেন বিদেশগামীরা
# নিজামের চাঁদার টাকা জিনাতের একাউন্টে
# জনপ্রতি নিতেন ২৫-৩০ লাখ টাকা
# ধনকুবেরদের ফুসলিয়ে শারীরিক সম্পর্ক, গোপনে ভিডিও ধারণ
জিনাত রেজওয়ানা পেশায় আদম ব্যবসায়ী হলেও নিজেকে পরিচয় দিতেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয়। বিমানবালার চাকরির সুবাদে শেখ হাসিনার গনভবনে যাতায়াতে নিজেকে হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচয় দিতেন। বসবাস করেন ঢাকা সেনানিবাসে। বিগত সরকারের কট্টর সমর্থক বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সেনাকর্মকর্তার সঙ্গে রয়েছে তার ঘনিষ্ঠতা। নিজাম হাজারীর রক্ষিতা হিসাবে খ্যাতিলাভ করা এই জিনাত সারাদেশে গড়ে তুলেন আদম ব্যবসার আড়ালে ভংঙ্কর প্রতারণার ফাঁদ। সেই ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন শতশত বিদেশগামী। সেনানিবাসের মধ্যে বাড়ি আর ঘনিষ্ঠ সেনাকর্মকর্তাদের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন পাওনাদারদের ভয় প্রদর্শনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এই বিষয়ে সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট বিভাগে এক ভুক্তভোগী লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।
সূত্র জানায়, ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর রং মহলে নিয়মিত যাতায়াত ছিল জিনাত রেজওয়ানার, প্রায় সময়ই নিজাম উদ্দিন হাজারী ফেনীর বিলাস বহুল বাংলো কাম রংমহল ও এমপি হোষ্টেলে তার ফ্ল্যাটে একান্তে সময় কাটাতেন দুজন। সেই সুবাদে নিজাম হাজারীর প্রভাব খাটিয়ে গড়ে তুলেছেন প্রভাব প্রতিপত্তি। এমনকি নিজাম হাজারীর সকল অবৈধ ব্যবসার অংশিদারও ছিলেন তিনি। জনশ্রুতি রয়েছে, পলাতক এমপি নিজাম হাজারীর আমেরিকার সকল সম্পত্তি ও ব্যবসার মুল নিয়ন্ত্রক তিনি। গত বুধবার ২৯ জানুয়ারি রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে একটি অভিযোগ দায়ের করেন আনোয়ার হোসেন নামে এক ভুক্তভোগী।
ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন বিদেশগামী:
জিনাত রিজওয়ানা সাবেক প্রভাবশালী এমপি নিজাম হাজারীর প্রভাব খাটিয়ে সারাদেশে গড়ে তুলেন আদম ব্যবসার আড়ালে এক ভংঙ্কর প্রতারণার ফাঁদ। এই ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন বিদেশগামী থেকে শুরু করে ট্রাভেলস এজেন্সীর কর্ণধাররা। সরকার পরিবর্তনের পর থেকে বন্ধ রয়েছে রিজওয়ানার অফিস, তালাবদ্ধ অফিসে লোকজনও নেই, তাই জিনাত রেজওয়ানার সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না ভুক্তভোগীরা। এমনকি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মতো সংরক্ষিত এলাকায় তার বাসা হওয়ায় তার সঙ্গে দেখাও করতে পারছেন না সাধারণ ভুক্তভোগীরা।
গত বছরের ১৪ নভেম্বর ৯ কোটি ২ লাখ টাকা আত্মসাতের দায়ে এক ভুক্তভোগী ফেনী সদর থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় জিনাত রিজওয়ানাকে ১ নম্বর আসামী এবং ফেনী সদর আসনের পলাতক এমপি নিজাম উদ্দীন হাজারী, হাজারীর খালাতো ভাই আব্দুল আওয়াল সবুজ এবং জাতীয় পার্টির সাবেক পলাতক এমপি আহসান আদেলুর রহমানসহ আরও কয়েকজনকে আসামী করা হয়।
মামলার এজাহারে নিজাম হাজারী ও রিজওয়ানার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজী, অপহরণ ও টাকা আত্মসাৎ, হত্যার চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়। জামিন অযোগ্য মামলায় আদালত থেকে সুকৌশলে জামিন নিয়ে বর্তমানে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসা নং ১৬/এ, ফ্ল্যাট ৬/সি, রোড ২-এ, বাসায় আত্মগোপনে আছেন প্রতারণার মাষ্টারমাইন্ড রিজওয়ানা। রিজওয়ানার সঙ্গে যোগাযোগে ব্যার্থ হয়ে এবং টাকা না পেয়ে এখন পথে পথে ঘুরছেন প্রতারণার শিকার অসহায় মানুষেরা। আবার অনেকই বাধ্য হয়ে তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মামলা করছেন। প্রতিনিয়তই বাড়ছে মামলার সংখ্যা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন আদালতে বর্তমানে ৪৬ টি মামলা চলমান রয়েছে, এমনকি অনেক মামলায় ইতিমধ্যে তিনি গোপনে জামিনও নিয়েছে, আবার অনেক মামলায় আদালত জামিন বাতিল করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, জিনাত রিজওয়ানার কাছে পাওনা টাকা চাইতে গেলে অনেককে ধর্ষণের চেষ্টার মামলা দিয়ে হয়রানীর অভিযোগও রয়েছে এই প্রতারকের বিরুদ্ধে। এমনি একজন ভুক্তভোগী টাকা চাওয়াতে তার বিরুদ্ধে জিনাত রিজওয়ান ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে মামলাও করেন। মিথ্যা মামলায় পাওনাদারকে জেলও খাটিয়েছেন। পাওনাদাররা টাকা চেয়ে যোগাযোগ করলে তিনি ধর্ষণ মামলা দিয়ে হয়রানীর ভয় দেখান। একাধিক সূত্র জানায়, চতুর জিনাত রিজওয়ানা আর্থিক সচ্ছল ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কৌশলে প্রথমে ব্যবসায়ীক সম্পর্ক তৈরি করেন। ব্যবসার সূত্রধরে জড়িয়ে পড়েন অনৈতিক সম্পর্কে। এরপর ধনকুবেরদেরকে ফুসলিয়ে বাধ্য করেন শারীরিক সম্পর্কে। আর সেই চিত্র গোপনে ভিডিও ধারণ করেন। এরপর শুরু হয় তার ব্ল্যাকমেইল। সামাজিক অবস্থানের কথা চিন্তা করে অনেকই মুখ বন্ধ রেখে তার দাবি মতো টাকা পয়সা, এমনকি নিজের ব্যবসা পর্যন্ত তাকে দিয়ে দিতে হয়েছে।
আনোয়ার হোসেন নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, জিনাত রেজওয়ানার নেতৃত্বে নিজাম হাজারী তার বাহিনী দিয়ে আমাকে গুম করে। তারা আমাকে হত্যার ভয় দেখিয়ে ৯৫ লাখ ৯৪ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন। সে সময় আমার স্ত্রী আমানা খাতুন এনসিসি ব্যাংক সোপান ফিলিং স্টেশনের হিসাব নং-০৯৭-০৩২৫০০০০১৬, বিশ্ব রোড মোড় শাখায় ঢাকা ব্যাংকের ফেনী শাখার হিসাব নং-০৯৬২০০০০৩২৯৭৪ হতে আরটিজিএস-এর মাধ্যমে ৭০ লাখ চাঁদার টাকা পাঠানো হয়। এ ভাবে নানা সময় আমাকে জিম্মি করে আমার সব কিছু লুট করে নিয়ে গেছে এই চক্র। শুধু আমি একাই নই, আমার মতো আরো অনেকেই নিঃস্ব হয়েছে। তার কাজই হচ্ছে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে সব কিছু লুট করে নেওয়া। জিনাত রেজওয়ানা একজন প্রতারক।
জানা যায়, বিপুল পরিমাণ আয়কর ফাঁকির অভিযোগে জোন-৯, সার্কেল ১৮১ কর্তৃক ৪ কোটি টাকা আয়কর ধার্য করেছে, তাও প্রভাবশালী আইনজীবী ও আয়কর কর্মকর্তার যোগসাজশে ধার্য কৃত আয়কর পরিশোধ না করে অবৈধ ভাবে কর ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
ফেনীর সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারীর গডফাদার ও আওয়ামী লীগের সাবেক এমপির ভাইয়ের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে তার বিপুল পরিমানে বিনিয়োগ এর তথ্য পাওয়া গেছে, যা জিনাত রেজওয়ানার আয়কর নথিতে গোপন করেছে। জানা যায়, আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী পলাতক সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতাদেরকে জিনাত রিজওয়ানার মাধ্যমে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে গোপনে অন্তরঙ্গ মুহুর্তের ভিডিও ধারণ করে তাকে দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায় করতেন। এমনকি নিজাম হাজারীর নামে যেসকল চাঁদা উঠত তার একটি বড় অংশ যেত জিনাত রিজওয়ানার একাউন্টে। প্রায় সময় তিনি বিভিন্ন ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ট্যাক্সের মাধ্যমে রিজওয়ানার ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার দিয়ে এই একাউন্টে টাকা পাঠানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করতেন।
জিনাত রিজওয়ানার প্রতারণার অন্যতম হাতিয়ার ছিল আদম ব্যবসা। তিনি প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা বিশেষ করে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগ সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিজে এমনকি এজেন্ট নিয়োগ করে মানুষকে ইংল্যান্ড, এ্যামেরিকা, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, জাপান, পর্তুগাল সহ বিভিন্ন দেশে পাঠানোর নাম করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। জনপ্রতি ১৫ থেকে ২৫-৩০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। এমনকি কোন কোন এজেন্টের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকাও হাতিয়ে নিয়েছেন।
সরকার কর্তৃক অবৈধ ভাবে বিদেশে পাচারের মাধ্যমে সম্পদ এর খোঁজ খবর নিতে দেখে চতুর জিনাত রিজওয়ান অবৈধভাবে পাচার করা টাকায় আমেরিকার ক্রয় কৃত বাড়ি গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর বিক্রয় করে দেয়।
আয়ের উৎস: আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার আগে ৫ হাজার টাকা বেতন জিএমজি এরয়ারলাইনস এ চাকরি করতেন জিনাত রিজওয়ানা, এখন দুটি সিএনজি ফিলিং স্টেশনের মালিক, ঢাকা পূর্বাচলে ১০ কাঠার প্লট, হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরে তিন হাজার বিঘার ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্লট, আমেরিকায় একাধিক বাড়ি, সন্তান আমেরিকায় পড়ালেখা করায় এতো সম্পদের মুল উৎস কি?
তার ঘনিষ্ট সূত্রমতে, চতুর জিনাত রিজওয়ানা, তার শশুর বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) ছিদ্দিকুর রহমানের দুটি সিএসডি প্রতিষ্ঠান সুকৌশলে দখল করে নেন। এরপর শশুরের নামে ৩০ টির অধিক মামলা করে তাকে দেশ ছাড়া করেন। তার শশুর বিগত ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর দেশে ফিরে তার বিরুদ্ধে ৫ কোটি ৭০ লক্ষ টাকার চেকের প্রতারণার মামালা দায়ের করেন। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যমতে, তার বিরুদ্ধে সিলেট বিভাগ ও চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন থানায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীরা।
এ ব্যাপারে জিনাত রিজওয়ানার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে উত্তর মেলেনি।
দুর্নীতি কমিয়ে আনতে দরকার সদিচ্ছা: সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ড. মো. আব্দুল মোমেন বলেছেন, আমাদের আকাঙ্ক্ষা হলো একটা ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ গঠিত হোক। সেই ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ যদি গঠিত হতে হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে দুর্নীতি একেবারে নির্মূল হবে এখনো সেটা মনে করি না। দুর্নীতি সেই পুরোনো আমলেও ছিল, অদূর ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু আমরা অনেকটাই কমিয়ে আনতে পারব। তার জন্য দরকার হচ্ছে আমাদের সদিচ্ছা।
আরএক্স/