ভাওতাবাজিতে পাঁচ শত কোটি টাকার মালিক নুরুল দম্পতি


Janobani

বশির হোসেন খান

প্রকাশ: ০৩:৩১ অপরাহ্ন, ৫ই মার্চ ২০২৫


ভাওতাবাজিতে পাঁচ শত কোটি টাকার মালিক নুরুল দম্পতি
ছবি: পত্রিকা থেকে নেওয়া।

# বন্ধ ব্যবসায় অংশীদারিত্ব দেয়ার নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ

# অংশীদারিত্বের পাতা ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে

# আত্মসাৎকৃত অর্থে রাজধানীতে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়

# আত্মসাতের মানষিকতা, ভালো কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে

-তৌহিদুল হক. অপরাধ বিশেষজ্ঞ 


নিজেদের দৃশ্যমান তেমন কোনো আয়ের উৎস নেই। কোনো কোম্পানী কিংবা বৈধ ব্যবসাও নেই। তবে তারা ধন সম্পদে ক্রমান্বয়ে ফুলে ফেঁপে উঠছেন। আর এ সবই করছেন বায়বীয় প্রতিষ্ঠানের অংশীদারিত্বের ফাঁদে ফেলে। হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এভাবেই শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন প্রায় দুই যুগ পূর্বে বন্ধ হয়ে যাওয়া হেনোলাক্স কোম্পানীর মালিক নুরুল আমিন দম্পতি। শুধুমাত্র প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে হয়েছেন অন্তত পাঁচ শত কোটি টাকার মালিক। আর এসব আত্মসাৎকৃত টাকায় গড়ে তুলেছেন একের পর এক বিলাসবহুল বাড়ি ও ফ্লাট। 


জানা যায়, নুরুল আমিন ১৯৮১-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ঢাকার গোপীবাগ এলাকায় কাদের হোমিও হল নামে একটি প্রতিষ্ঠানে ১৫ বছর চাকরি করেন। ওই সময়ে তার একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠার কথা মাথায় এলে ১৯৯১ সালে হেনোল্যাক্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। চাকরির পাশাপাশি শুরু হলো ব্যবসা। আরও চার বছর পর ১৯৯৬ সালে অবশেষে দীর্ঘ ১৫ বছরের চাকরিটি তিনি ছাড়লেন। এরপর বেশ পরিচিতি পায় তার হেনোলাক্স কোম্পানি।  


নথি পর্যালোচনা ও তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, নরসিংদী জেলার শিবপুর গ্রামের সহজ সরল হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক নূরুল আমিন খুবই অর্থকষ্টে দিনযাপন করতেন। ত্বক ফর্সা ও মুখের দাগ দুর করার কয়েকটি ক্রিম নিয়ে তিনি হোনোলাক্স নাম দিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। হঠাৎ করেই নানা প্রতিকূলতায় ২০০৪ সালে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন নূরুল আমিন। পরবর্তিতে হেনোলাক্স ফুড নামে খাদ্যপন্য ও আমিন হারবাল কোম্পানী নামের ব্যবসা শুরু করলেও লোকসানের কারণে দুটি ব্যবসা-ই ২০১৯ সালে বন্ধ হয়ে যায়। 


বর্তমানে তিনি নিজেকে আমিন ফুড প্রসেসিং এন্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ও আমিন পোল্ট্রি লিমিটেডের চেয়ারম্যান দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে এসবের কোনোটিরই কোনো কার্যক্রম নেই। এমনকি এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় সবগুলোরই ঠিকানা দেখানো হয়েছে ৩/১, পুরানা পল্টন, হেনোলাক্স সেন্টারকে। আর বিভিন্ন ব্যাক্তিকে এইসব বায়বীয় কোম্পানীর নাম এবং সেগুলোতে অংশীদারীত্বের কথা বলে নুরুল আমিন দম্পতি হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। 


নুরুল আমিন দম্পতির ব্যবসায় অংশীদারীত্ব দেওয়ার এই ফাঁদে নিঃস্ব হয়েছেন তেমনই একজন হলেন কুষ্টিয়া জেলার ঠিকাদার গাজী আনিসুর রহমান। নুরুল আমিন দম্পতির প্রতারণার বিরুদ্ধে প্রতারিত অনেকেই প্রতিবাদ না করলেও গাজী আনিসুর রহমান নিজে আত্মাহুতি দিয়ে এই প্রতারক দম্পতির এক প্রকার মুখোশ উম্মোচন করে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে নুরুল আমিন দম্পতির বিরুদ্ধে শাহাবাগ থানায় মামলা করা হয়। মামলা নং ৯, তারিখ-৫/০৭/২০২২ইং।


অভিযোগ রয়েছে, প্রায় দুই যুগ ধরে বন্ধ থাকা কোম্পানির ভূয়া অংশীদারীত্ব দিতে ভয়ঙ্কর প্রতারণার ফাঁদ পাতেন নুরুল আমিন দম্পতি। তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ব্যবসায় অংশীদার হতে চাওয়া আগ্রহীদের অনেকেই খুইয়েছেন কোটি কোটি টাকা। প্রতারক এই দম্পতি কথিত হেনোলাক্স গ্রুপের প্রধান কার্যালয় হিসেবে ফেসবুক সহ বিভিন্ন মাধ্যমে ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করেন ৩/১, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০। আর স্কাইভিউ হেনোলাক্স সেন্টার নামের ১১ তলার এই বানিজ্যিক ভবনটির তৃতীয় তলায় কথিত হেনোলাক্স গ্রুপের প্রধান কার্যালয় দেখানো হয়েছে।


কর্নফুলি গার্ডেন সিটির বাসিন্দা মো. সাইফুল ইসলাম সজিব জানান, সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি অ্যাপার্টমেন্টে নূরুল আমিন অনেক আধিপত্য ছিল। কারন কর্নফুলী গার্ডেন সিটির নূরুল আমিনের বাসায় গত পলাতক সরকারের অনেক মন্ত্রী ও প্রভাবশালী লোকের যাতায়াত ছিল। আর এ প্রভাবে তিনি আওয়ামী লীগ সরকার আমলের দীর্ঘদিন কর্নফুলি গার্ডেন সিটি মালিক সমিতির কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তার দাপটে ভবনের সবাই তটস্থ থাকতো। তিনি বলেন, অনেকদিন ধরে তার কোনো ব্যবসা নেই, অথচ অর্থ সম্পদ বেড়েছে অনেক। তার এ সবই হয়েছে প্রতারণার মাধ্যমে অন্য মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করে।


এদিকে নূরুল আমিনের কথিত হেনোলাক্স কারখানা নামের রাজধানীর কদমতলী এলাকায় মোহাম্মদবাগে ৩ তলা ভবন রয়েছে। যার নম্বর ৯৮৭। ভবনটিতে গিয়ে দেখা যায় সেখানে এক ভুতুরে পরিবেশ বিরাজ করছে। কিছুদিন পূর্বে এখানে সেমাই উৎপাদন করা হতো বলে জানা গেছে। 


ভবনের পাশেই থাকা আফজাল হোসেন নামের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, মোহাম্মদবাগের এই বাড়িটি এক সময়ে হেনোলাক্সের কারখানা ছিল। সেটি অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর এই ভবনের একটি অংশে কিছুদিন সেমাই উৎপাদন হয়েছে। এখন সেটিও বন্ধ রয়েছে। আগে এই কারখানাটি কদমতলীর মেরাজনগরে ছিল, পরে এটি মোহাম্মদবাগে এসেছে।


আবার কদমতলীর মেরাজনগরে নূরুল আমিনের ‘হেনোলাক্স ভবন-১’ নামের আরো একটি ভবন রয়েছে। যার নম্বর ১০৭৬। ভবনটির নামকরনেই এলাকাবাসীর কাছে হেনোলাক্স মোড় বলে পরিচিত। সেখানেই হেনোলাক্সের প্রথম কারখানা ছিল। পাঁচকাঠা জমির ওপর চার তলা বিশিষ্ট নির্মিত ‘হেনোলাক্স ভবন-১’ নামের এই ভবনটির নিচ তলায় বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং উপরের তিন তলায় আবাসিক ফ্লাট আকারে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।


নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ভাড়াটিয়া বলেন, তিনি এখানে প্রায় আট বছর যাবৎ বসবাস করছেন। এই বাড়ির মালিক নুরুল আমিন ও তার স্ত্রী ফাতেমা আমিন বলে জানেন, তবে তাদের কখনো দেখেননি। তাদের একজন তত্ত্বাবধায়ক এই বাড়ির দেখাশুনা করেন এবং তিনিই ভাড়া তোলেন।


এসব ছাড়াও নুরুল আমিনের পূর্বাচল এলাকার পিংক সিটিতে এ ব্লকের ৮ নম্বর রোডের ৫ নম্বর ডুপ্লেক্স বাড়ি, ১০৯ নম্বর কর্নফুলি গার্ডেন সিটিতে ৪টি ফ্লাট, যার নাম্বার ১৬/ডি, ১৭/এ, ১৭/ডি এবং ১৯/এ। আবার পূর্বাচল এলাকার পিংক সিটিতে ‘এ’ ব্লকের ৮ নম্বর রোডের ৫ নম্বর ডুপ্লেক্স বাড়িটিও তার।


পিংক সিটিতে ডুপ্লেক্স বাড়ি, কর্নফুলি গার্ডেন সিটিতে ৪টি ফ্লাট, পুরানা পল্টনে বহুতল ভবন, কদমতলীর দুটি বাড়ি থাকার কথা স্বীকার করে নুরুল আমিন বলেন, আমার বিরুদ্ধে করা সকল অভিযোগ মিথ্যা। আমি কারো কাছ থেকে ব্যবসার কথা বলে কোনো টাকা নেই নি। এক পর্যায়ে তিনি সরাসরি দেখা করতে চাইলে এ প্রতিবেদক দৈনিক জনবাণী’র অফিসে আসার জন্য বললে তিনি তার স্ত্রীর সাথে কথা বলার জন্য অনুরোধ করে স্ত্রী ফাতেমা আমীনের কাছে ফোনটি দেন। পরবর্তিতে তার স্ত্রী ফোন ধরেই বলেন আমরা কারো কাছ থেকে টাকা নেইনি। কুষ্টিয়ার বাসিন্দা গাজী আনিসুরের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন কিনা এমন জিজ্ঞাসায় তিনি বলেন, গাজী আনিসুরের কাছ থেকে আমরা কোনো টাকা নেইনি। আপনাদের কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে গাজী আনিসুর রহমান জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শরীরে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করায় শাহবাগ থানার একটি মামলায় আপনাকে এবং আপনার স্বামীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল কি না এমন প্রশ্নে ফাতেমা আমীন গ্রেফতারের বিষয় অস্বীকার করেন। 


এক পর্যায়ে তাদের গ্রেফতারের ছবি রয়েছে এমনটি বলা হলে ফাতেমা আমীন বলেন, আপনি সরাসরি আসেন কথা বলবো। এরপরই ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। ফের ফোন করা হলেও আর তারা রিসিভ করেননি।


নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমিন হারবাল লিমিটেডের মার্কেটিং ম্যানেজার বলেন, হেনোলাক্স কোম্পানীটি বন্ধের পর আমরা কয়েকজন পুরানা পল্টন স্কাই ভিউ টাওয়ারে অফিস করেছি। সেখানে ২০২১ সালের শেষ দিকে টাঙ্গাইল এলাকার জনৈক আকরাম হোসেন নামের একজন কোম্পানীর মালিকের কাছে বহুবার এসেছেন। তার দাবি ছিল তিনি নুরুল আমিনে কথায় বিশ্বাস করে তার কাছে ব্যবসার জন্য আড়াই কোটি টাকা দিয়েছেন। সেই টাকা তিনি ফেরৎ নিতে আসেন কিন্তু তাকে টাকা না দিয়ে বার বার ওয়াদা দিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। এছাড়া দেনা-পাওনা নিয়ে একটি দুর্ঘটনার পর ২০২২ সালে আরো অনেকেই পাওনাদার হিসেবে অফিসে এসেছেন কিন্তু কোম্পানীর মালিক নূরুল আমিনকে না পাওয়ায় কেউ কেউ একাধিকবারও এসেছেন।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক  এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কিংবা কোনো স্বার্থ কেন্দ্রিক বিষয়গুলো নিয়ে কোনো জটিলতা বা ভুল বোঝাবুঝি তৈরী হলে আমাদের দেশে সেটি সমাধানের বিভিন্ন উপায় রয়েছে। আমাদের দেশে ব্যবসায়ীদের আড়ালে একটি মহল রয়েছে যারা নানা ধরনের অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তারা বিভিন্নভাবে শক্তি প্রয়োগ করে। কখনো রাজনৈতিক শক্তি বা পরিচয়ে, কখনো আর্থিক শক্তি অথবা আর্থিক এবং রাজনৈতিক শক্তিকে দিয়ে তারা প্রশাসন বা পুলিশের শক্তিকে নিজের পক্ষে রাখার চেষ্টা করে।


তিনি বলেন, আমাদের দেশে আত্মসাতের মানষিকতা সম্পন্ন মানুষের কারনেই আমাদের অনেক ভালো উদ্যোগ কিংবা ভালো কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে। একেবারে ধ্বংসের দার প্রান্তে নিয়ে যায়। আমাদের দেশের বাস্তবতায় অপরাধ করার সুযোগও যেমন রয়েছে আবার তেমন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে প্রক্রিয়াগুলোও রয়েছে। এটি প্রচলিত প্রেক্ষাপট বা ব্যবস্থা অনুযায়ী সমাধান করতে পারলেই এটি সুরাহা করা সম্ভব।


নরসিংদী জেলার শিবপুরের জয়নগর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নাদিম সরকার বলেন, একসময় নুরুল আমিনের পরিবার খুব একটা স্বচ্ছল ছিল না। তিনি নিজ এলাকায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক নামে পরিচিত ছিলেন। হেনোলাক্স  প্রতিষ্ঠার পর খুব দ্রতই তার ভাগ্য বদলে যায়। তিনি ঢাকা ও নরসিংদীতে অনেক জমি ক্রয় করেছেন। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুনেছি তিনি অনেকের সাথে ব্যবসায় নামে নানা প্রতারণা করেছেন।