রাউজানে ফজলে করিমের অবৈধ সম্রাজ্য


Janobani

বশির হোসেন খান

প্রকাশ: ০৩:০৭ অপরাহ্ন, ১০ই মার্চ ২০২৫


রাউজানে ফজলে করিমের অবৈধ সম্রাজ্য
ছবি: পত্রিকা থেকে নেওয়া।

# অবৈধ সম্পদ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার

# সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগিয়ে মাদক পরিবহন 

# দিন-দুপুরে মানুষ পিটিয়ে হত্যা করা হয়


বশির হোসেন খান: কারান্তরীণ সাবেক এমপি ফজলে করিম চৌধুরীর সম্রাজ্য এখন ফজলে শহিদ চৌধুরীর হাতে। বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচারের প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন বলে একটি গোয়েন্দা তথ্যে উঠে এসেছে। রাউজানের ত্রাস ফজলে করিম চৌধুরী গ্রেফতারের পর তার ছেলে ফারাজ করিম চৌধুরীকে অবৈধভাবে বিদেশে পালাতে অনূঘটকের ভূমিকা পালন করেন ফজলে শহিদ চৌধুরী। 


লন্ডনে অবস্থানকারি ফারহান করিম চৌধুরী ও তুরস্কে অবস্থানকরা ফারাজ করিম চৌধুরীরে গোপনে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের খবর ছড়িয়ে পড়েছে। ফারায করিম চৌধুরী পাচারের টাকায় তুরস্কে নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ফজলে শাহিদ সব ব্যবসা (নিউ এরা ফ্যাশন) এবং গুলশান ১ থেকে আসা অর্থ পরিচালনা করছেন এবং ফজলে করিম চৌধুরীর মামলার ওপর প্রভাব ফেলতে চেষ্টা করছেন, যদিও তার নিজের বিরুদ্ধে মামলা বিদ্যমান।


আর এ সবের পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন গুলশান-১ এর ৩১ নম্বর রোর্ডে ৭ নম্বরে অবস্থিত ফজলে করিম চৌধুরীর আলিশান ভবনে থেকেই। গভীর রাতে রহস্যজনক লোকজনের আনাগোনা লেগেই থাকছে বাড়িটিকে ঘিরে। এতে করে আশপাশের বাসিন্দারা চরম নিরাপত্তা হীনতায় ভুগছেন বলে অভিযোগ করেছেন।


ফজলে শাহিদ চৌধুরীর ছেলে, ফাইক এস চৌধুরী, মাদক বিক্রেতা হিসেবে পরিচিত এবং ফজলে সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো গাড়ি ব্যবহার করে মাদক পরিবহন ও বিক্রি করতেন।


বিগত আওয়ামী লীগের ১৬ বছর ফজলে করিম চৌধুরীর কথায় শেষ কথা ছিল রাউজানে। তাকে রাউজানের অঘোষিত রাজা বলা হতো। নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করতেন সবকিছু। প্রশাসনের আলাদা কোনো অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। তার এবং তার সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা করা থাকল দুরের কথা মুখ খোলার সাহস ছিল না কারো। ভিন্নমতের শত শত মানুষ হয়রানি-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শিকার হয়েছেন গুম-খুনের। দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাড়ি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। বছরের পর বছর এলাকাছাড়া ছিলেন বিএনপি, জামায়াত, মুনিরিয়া যুব তবলিগসহ অঙ্গসংগঠনের অনেকেই।


এমনকি ভিন্নমত পোষণ করে আওয়ামী লীগের লোকজনও এলাকাছাড়া হয়েছেন। কোনো অপরাধেরই বিচার হতো না। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর ফজলে করিম এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেলে রাউজানের সাধারণ মানুষ রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি থেকে মুক্তি লাভ করেন। এতোদিন তারই অন্যতম সহযোগি এবং ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করেছে ফজলে শহিদ চৌধুরী। ফজলে করিম কারান্তরীণ হলেও তিনি এখনও রয়ে গেছেন বহাল তবিয়তে।


আত্মীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে হাত করে রাতারাতি ঢুকে পড়েন রাউজান উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে চাচাতো ভাই বিএনপি নেতা গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ৭ হাজার ৩২৯ ভোটে হারিয়ে চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনের সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে সংসদ-সদস্য হন তিনি। চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিনটিতে কোনো ভোটই হয়নি। তার একক আধিপত্যের মাধ্যমে এলাকায় মুতিমান আতঙ্কে পরিণত হন।  


কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলমের স্ত্রী সুমি আক্তার বলেন, ‘আমার সামনে থেকে স্বামীকে শহরের বাসা থেকে তুলে নিয়েছিল ফজলে করিমের ক্যাডাররা। শহর থেকে রাউজানে নিয়ে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখে। স্বামী খুন হয়ে গেল অথচ এর বিচার চেয়ে থানায় মামলাও করতে পারিনি। ঘটনার সাত বছর পর চকবাজার থানায় ফজলে করিম চৌধুরীসহ ১৭ জনকে আসামি করে মামলা করেছি। রাউজানের ১৪ নম্বর বাগোয়ান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু জাফর অপহরণ ও গুমের নেপথ্যেও ছিলেন ফজলে করিম।


ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম নুর ছাড়াও পৌরসভা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জয়নাল আবেদীন হান্নান, উপজলা যুবদল নেতা আবুল হাশেমকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। প্রবাসফেরত যুবদল নেতা মুসাকেও দিনদুপুরে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এসব ঘটনার পেছনেও ছিলেন ফজলে করিম চৌধুরী ও ফজলে শহিদ চৌধুরী। 


স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগের শেষ ১০ বছর স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। মাদ্রাসা-মসজিদ, স্কুল কমিটির নির্বাচন পর্যন্ত হয়নি। বিনা ভোটে তার পছন্দের লোকজনকেই তিনি প্রার্থী করে নির্বাচিত ঘোষণা করতেন। কেউ নির্বাচন করতে চাইলে তাকে ভোগ করতে হতো নানা শাস্তি। এমনকি একবার রাউজানের পৌর মেয়র হিসাবে নির্বাচিত হওয়া নিজ দলের কর্মী দেবাশীষ রোষানলে পড়ে চেয়ারে বসতে পারেননি। যেতে পারেননি এলাকায়। তার অপরাধ ছিল তিনি ফজলে করিমের নিষেধ সত্ত্বেও নির্বাচন করেছিলেন।


৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান ফজলে করিম চৌধুরী। ১৩ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সিমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর সময় দুই সহযোগীসহ তাকে হাতেনাতে আটক করে বিজিবি। তার বিরুদ্ধে ৩২ মামলা চলমান রয়েছে। ২৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ ও রাউজান থানা পুলিশ তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বেশকিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে। এর মধ্যে রয়েছে রিভলভার, পিস্তল, রাইফেল, শটগান, টিয়ার গ্যাস লঞ্চার, বিপুল পরিমাণ গুলি, একনলা বন্দুক ও বন্দুকের কার্তুজ, বিস্ফোরক দ্রব্য। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করে রাউজান থানা পুলিশ।


এ ব্যাপারে ফজলে শহিদ চৌধুরী মুঠো ফোন কল দিলে তিনি রিসিভ করেনি। এমনকি ক্ষুর্দে বার্তা পাঠিয়ে উত্তর মেলেনি।  


দুর্নীতি কমিয়ে আনতে দরকার সদিচ্ছা: সম্প্রতি কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে গণশুনানি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ড. মো. আব্দুল মোমেন বলেছেন, আমাদের আকাঙ্ক্ষা হলো একটা ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ গঠিত হোক। সেই ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ যদি গঠিত হতে হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে দুর্নীতি একেবারে নির্মূল হবে এখনো সেটা মনে করি না। দুর্নীতি সেই পুরোনো আমলেও ছিল, অদূর ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু আমরা অনেকটাই কমিয়ে আনতে পারব। তার জন্য দরকার হচ্ছে আমাদের সদিচ্ছা।


এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ড. ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুর্নীতিবাজরা যতই ক্ষমতাধর হউক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।  


এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দুর্নীতিবাজরা সক্রিয় থাকে। তাই তাদের নিমূল করা কঠিন। তবে দিন দিনে বাড়ছে দুর্নীতি। 


আরএক্স/