ময়মনসিংহ পাসপোর্ট অফিসের অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্য ফাঁস


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


ময়মনসিংহ পাসপোর্ট অফিসের অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্য ফাঁস

ঘুষ আর নানা অনিয়ম-দূর্নীতির আখড়ায় পরিণত হওয়া ময়মনসিংহের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসটি নয়া উপপরিচালকের নির্দেশে স্বচ্ছ হয়েছে বলে গুণকীর্তন ছড়িয়ে দিয়েছে কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের দাবি, এখন আর দালালের মাধ্যমে ঘুষ দিয়ে পাসপোর্ট করতে হয় না। দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

আসলেই কি তাই? এর সত্যতা খুঁজতে টানা ১৫ দিন অনুসন্ধান হয়েছে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অনিয়ম-দুর্নীতির নানা তথ্য।

আঞ্চলিক এই পাসপোর্ট অফিসের বর্তমান উপপরিচালক হাফিজুর রহমান। তিনি গত বছরের ১৪ অক্টোবর ওই পদে যোগ দেন। এরপর কার্যালয়ের সামনে বড় করে প্যানা টানিয়ে দেন তিনি।

সেখানে লেখা হয়, ‘আপনার পাশে আমরা। পাসপোর্ট করতে এসে কোনো ধরনের ভোগাšিন্ত সৃষ্টি হলে ২০৬ নম্বর কক্ষে সরাসরি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’

এমন লেখায় কার্যালয়টির পুরোনো চেহারা পাল্টাবে- এমনটাই প্রত্যাশা করেছিল সেবাগ্রহীতারা। কোনো ধরনের সমস্যা হলে প্রধান এই কর্মকর্তার কক্ষের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে একে একে যোগাযোগও করেছেন অনেকে। কিন্তু আসলেই কি স্বচ্ছ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। নাকি লোকদেখানো কিছু সেবাগ্রহীতাদের সমস্যা সমাধান করে প্রশংসা নিয়ে গেছে?

অনুসন্ধানে জানা যায়, আগের উপপরিচালক সালাহ উদ্দিন যোগদানের পর দালালদের সঙ্গে সমঝোতা করে প্রতিটি পাসপোর্ট বাবদ এক হাজার ২০০ টাকা করে ঘুষ নির্ধারণ করেন। হাফিজুর রহমানের যোগদানের পরও তা পাল্টায়নি।

বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ থেকে ২০০টি আবেদন জমা পড়ছে বলে জানিয়েছেন পাসপোর্ট অফিসের একাধিক কর্মকর্তা।

এই আবেদনের ৮০ শতাংশের বেশি জমা পড়ে দালালদের মাধ্যমে। এ হিসাবে গড়ে প্রতিদিন ২০০টি আবেদন জমা পড়লে একদিনে ঘুষের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৯২ হাজার টাকা। তবে ১৫০টি আবেদন জমা পড়লে প্রতিদিন ঘুষের পরিমাণ ২ লাখ ৪ হাজার টাকা। এ হিসাবে প্রতি মাসে ৪০ লাখ টাকার বেশি ঘুষ আদায় করা হচ্ছে।

অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে এসেছে, দালালরা প্রতিটি আবেদনে ব্যবহার করে বিশেষ সাংকেতিক চিহ্ন। প্রত্যেকের রয়েছে আলাদা বিশেষ কোড। পাসপোর্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া এসব চিহ্ন ও কোড বোঝার কোনো উপায় নেই।

এরপর আবেদনকারী পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে এগুলো জমা দেন। কর্মকর্তারা আবেদন দেখেই বুঝতে পারেন কোন দালাল আবেদনপত্র পূরণ করে পাঠিয়েছে। কে কতটি আবেদন করেছে, তাও নোট করে রাখা হয়।
এরপর দালালরা ঘুষের নির্ধারিত টাকাগুলো যথাসময়ে পাসপোর্ট অফিসে পৌঁছে দেন। অফিসের সূত্র বলছে, এই ঘুষের টাকা ভাগাভাগি হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে।

মাসোয়ারা হিসেবে অফিসের খাতায় তালিকাভুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে মাসের নির্দিষ্ট তারিখেই ঘুষের টাকা বণ্টন করা হয়।

এসব বিষয়ে জানতে একাধিকবার উপপরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। বলেছেন, বাইরে কিছু দালাল থাকতে পারে। তবে অফিসের কোনো কর্মকর্তাদের সঙ্গে দালালদের যোগাযোগ নেই বলে দাবি তার।

এরপরই পরিচয় গোপন রেখে পাসপোর্ট অফিসের সামনে কয়েকজন দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। প্রথমে মুখ খুলতে রাজি হননি কেউ।

এরপর কৌশল পাল্টে দালালদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করা হয়। পাসপোর্টের আবেদনের বিষয়ে জানতে ওই নম্বরে নিয়মিত যোগাযোগ করা হয়। পরিচয় গোপন রেখে ধীরে ধীরে সখ্য গড়ে তোলা হয়।

কয়েকজন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করবে জানালে পাসপোর্ট অফিসের সামনে তাদের নিজস্ব অফিসে আসতে বলে দালাল। আগে টাকার অঙ্কটা পরামর্শ করা প্রয়োজন জানালে একজন দালাল রাজি হন।

গত ৩০ মার্চ বিকেল ৫টার দিকে উজ্জ্বল নামের ওই দালালকে নগরীর চরপাড়া এলাকায় ডেকে আনা হয়। এ সময় খোলামেলা আলোচনা হয় তার সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘১০ বছরের জন্য পাসপোর্ট নিতে চাইলে আমাদের হাতে ১০ হাজার টাকা দিতে হবে। আর ৫ বছরের জন্য করলে ৭ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হবে। গ্যারান্টি দিচ্ছি, এক মাসের মধ্যে পাসপোর্ট হাতে পাবেন৷’

এই লাইনে তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার গর্বও করলেন উজ্জ্বল। বলেন, ‘২৩ বছর ধরে দালালি করছি। এখন পর্যন্ত কথার বরখেলাপ করিনি।’

নিজে আবেদন করে পাসপোর্ট অফিসে জমা দিলেই পাসপোর্ট পাওয়া যায়। তাহলে আপনাদের বাড়তি টাকা দেব কেন? এমন প্রশ্নে রীতিমতো রাগান্বিত হয়ে যান উজ্জ্বল। বলেন, ‘তাহলে ডেকেছেন কেন?’

চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দিলেন তিনি। বললেন, ‘সাধারণ পাবলিক হিসেবে গিয়ে দেখেন, পাসপোর্ট সময়মতো পান কি না। এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে দৌড়াদৌড়ি করে জুতা ক্ষয় করতে হবে। পরে আমাদের সঙ্গেই যোগাযোগ করতে হবে।’

একপর্যায়ে ঘুষ লেনদেনের সব তথ্য বলে দেন এই উজ্জ্বল। বলেন, ‘অফিসের তালিকাভুক্ত দালাল ছাড়াও সহযোগী দালাল রয়েছে পাঁচ শতাধিক। কিছু দালাল রয়েছে যারা সরাসরি নিজে আবেদন প্রক্রিয়া শেষ না করে আরেক দালালকে দিয়ে করায়। এ জন্য সেই দালালকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে হয়৷

‘আবেদন প্রক্রিয়া শেষ করে বিশেষ সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়৷ এরপর আবেদনকারী নিজে গিয়ে আবেদন জমা দেন। ওই চিহ্ন দেখেই কর্মকর্তারা বুঝতে পারেন কোন দালালের মাধ্যমে কতটি আবেদন জমা পড়েছে।’

দালাল যতটি আবেদন করবে প্রতিটি আবেদন বাবদ এক হাজার ২০০ টাকা করে জমা দিতে হবে। এরপর নির্দিষ্ট সময়ে পাসপোর্ট পাওয়া যাবে- এটাও বলে দিলেন উজ্জ্বল।

উজ্জ্বল জানান, কারও কোনো সমস্যা থাকলে বা আবেদনে ত্রুটি-বিচ্যুতির পাসপোর্টের জন্য দর-কষাকষি করে নেয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা।

তিনি বলেন, ‘আমরা (দালালরা) যে আবেদনগুলো করে দেই, সেগুলো অফিসের কর্মকর্তারা ভুল ধরতে পারবেন না। ভুল থাকলেও সব ঠিক। তবে সাধারণ লোক নিজে আবেদন করে জমা দেয়ার সময় সামান্য ত্রুটি থাকলে এটিকে বড় ভুল হিসেবে ধরা হয়। ফলে আমাদের সঙ্গেই যোগাযোগ করতে বাধ্য হয় আবেদনকারীরা।'

ঘুষ বন্ধ হয়েছে, কাউকে বাড়তি টাকা দিতে হয় না বলে যে দাবি অফিস থেকে করা হচ্ছে, সে বিষয়ে উজ্জ্বলের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি কটাক্ষের হাসি হাসেন।

বলেন, ‘যাদের মুখ পরিচিত, তারা অনলাইনে আবেদন করে সরাসরি জমা দিলে নির্দিষ্ট সময় পর হলেও পাসপোর্ট পাবেন। তবে এ সংখ্যাটা হাতে গোনা কয়েকজন। আর প্যানা টানানোর বিষয়টি লোকদেখানো। যদি পাসপোর্ট অফিস স্বচ্ছই হয়, তাহলে মাস শেষে বণ্টন করা টাকাগুলো আসে কীভাবে? এগুলো ঘুষের টাকা।’

উজ্জ্বলের এসব বক্তব্য যাচাই করতে গিয়ে নিউজবাংলা কথা বলে পাসপোর্ট নিয়ে কাজ করেন এমন এক কর্মকর্তার সঙ্গে। পরিচয় ও সংস্থার নাম গোপন রাখার শর্তে এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমি এই পাসপোর্ট অফিস থেকে প্রতি মাসে দুই হাজার করে টাকা নেই। এটা আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। যার রেকর্ড সংরক্ষিত রয়েছে।’

পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে কথা হয় রাফিউল্লাহ নিলয় নামের এক যুবকের সঙ্গে। তিনি গত ২৩ মার্চ জেলার গফরগাঁও উপজেলা থেকে পাসপোর্ট করতে আসেন।

আবেদনপত্র জমা দিতে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দালাল ডিঙিয়ে আবেদন জমা দিতে গিয়ে পদে পদে হয়রানির শিকার হয়েছি। ফলে বাধ্য হয়েই দালালদের শরণাপন্ন হতে হয়েছে।

‘এক দালালকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছি। তিনি আবেদন প্রক্রিয়া শেষ করেছেন। এরপর আমি জমা দিতে গেলে তাৎক্ষণিক জমা রাখা হয়। ত