চুয়াডাঙ্গায় তালাক সুনামি: বছরে ৮ হাজার বিয়ে, ৫ হাজার বিচ্ছেদ
জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৩:১৫ পিএম, ৩১শে জুলাই ২০২৫

চুয়াডাঙ্গায় দাম্পত্য সংকট ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। সংসার টিকছে না, সম্পর্ক হারাচ্ছে স্থায়িত্ব। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, বিয়ের তুলনায় তালাকের হার ক্রমেই বাড়ছে। জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে জেলায় বিয়ে হয়েছে ৮,১০৬টি, কিন্তু একই বছরে তালাক হয়েছে ৫,৫২১টি—যা মোট বিবাহের প্রায় ৬৮ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা একে 'তালাক সুনামি' বলে উল্লেখ করছেন।
জেলার চারটি উপজেলায় বিয়ে ও তালাকের সংখ্যা নিম্নরূপ—
- চুয়াডাঙ্গা সদর: বিয়ে ২,২২৬টি, তালাক ২,১৭৭টি
- আলমডাঙ্গা: বিয়ে ২,৪৩১টি, তালাক ১,২৩৭টি
- দামুড়হুদা: বিয়ে ১,৮২৮টি, তালাক ৯২১টি
- জীবননগর: বিয়ে ১,৬২১টি, তালাক ১,১৮৬টি
চুয়াডাঙ্গা সদরে বিয়ে ও তালাকের সংখ্যা প্রায় সমান। ফলে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে পরিবার, সমাজ ও প্রশাসনের মধ্যে।
চুয়াডাঙ্গা সদরের কাজী মো. সামসুল হক বলেন, “বর্তমান সময়ে বিবাহবিচ্ছেদের অন্যতম প্রধান কারণ পরকীয়া। এছাড়া, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, স্বামীর বিদেশে অবস্থান, অবিশ্বাস ও সহনশীলতার অভাবও তালাকের পেছনে বড় কারণ।”
কাজী মিরাজুল ইসলাম বলেন, “সাংসারিক জীবনে সমস্যার মূল উৎস অনেকাংশেই পরকীয়া। মানসিক দূরত্ব তৈরি হলে বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে পড়ে।”
জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্য মতে, অধিকাংশ তালাকের উদ্যোগই আসে নারীদের পক্ষ থেকে। বিশেষ করে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী নারীরা তালাকের ক্ষেত্রে বেশি সক্রিয়।
জীবননগরের মুনিয়া (ছদ্মনাম) বলেন, “স্বামী মাদকাসক্ত ছিলেন, কাজ করতেন না, মারধর করতেন। বাধ্য হয়ে তালাক দেই।”
চুয়াডাঙ্গা সদরের আরিফুল বলেন, “স্ত্রী সারাদিন ফেসবুকে ব্যস্ত থাকত। একদিন মোবাইল নিয়ে নিই, এরপর সে বাবার বাড়ি চলে যায়। মাসখানেক পর তালাক পাঠায়।”
আলমডাঙ্গার আসমত আলী বলেন, “বউ পরকীয়া করতো, সংসারে তার মনোযোগ ছিল না। তাই তাকে তালাক দিয়েছি।”
চুয়াডাঙ্গার সি.বি.আই সেলিম খান জানান, “পরিবারের অমতে বিয়ে করেছিলাম। স্ত্রী পরিবারের চাপে তালাক পাঠায়।”
জীবননগরের ইউএনও আল-আমিন বলেন, “বাল্যবিবাহ, পরকীয়া, হিংসা, পারিবারিক অজ্ঞতা ও অশিক্ষা— এসবই তালাক বৃদ্ধির মূল কারণ। আমরা সচেতনতামূলক সভা করছি, এবং খুব শিগগিরই সমস্যার মূল চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করা গবেষক অধ্যক্ষ সাজেদা পারভীন বলেন, “নারীর ক্ষমতায়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে অনেকেই এখন অবহেলিত জীবনকে মেনে নিচ্ছেন না। তবে এ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে সমাজ ও সরকারকে সমানভাবে এগিয়ে আসতে হবে।”
ফাতেমাতুজ জোহরা মহিলা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুফতি শিফাউদ্দিন মাদানী বলেন, “ইসলামী বিধান উপেক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষার অভাব ও পরকীয়া— এই তিনটি বিষয়ই এখন তালাক মহামারির মূল চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
চুয়াডাঙ্গার এই তালাক প্রবণতা শুধু পরিসংখ্যান নয়, এটি সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের করুণ প্রতিফলন। প্রয়োজন সম্মিলিত সামাজিক উদ্যোগ, পারিবারিক সচেতনতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মূল্যবোধে ফিরে যাওয়া।
আরএক্স/