আরেকজনকে কোপানোর ভিডিও ধারণ করায় খুন হন সাংবাদিক তুহিন
জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১২:০০ পিএম, ৮ই আগস্ট ২০২৫

গাজীপুর চান্দনা চৌরাস্তা মোড় এলাকার ঈদগাহ মার্কেটের সামনে বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) রাতে সাংবাদিক তুহিনকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়।
গাজীপুরে প্রকাশ্যে এক ব্যক্তির ওপর হামলা-কোপানোর ঘটনার ভিডিও ধারণ করায় সাংবাদিক তুহিনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ঘটনার সময়ের আশেপাশের সিসিটিভির ফুটেজ পর্যালোচনা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে এমন তথ্য পাওয়া গেছে জানিয়েছেন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার রবিউল ইসলাম।
নিহত মো. আসাদুজ্জামান তুহিন (৩২) দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার গাজীপুর প্রতিনিধি ছিলেন। গাজীপুরের চান্দনায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির কাজও করতেন।
বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) রাতে চান্দনা চৌরাস্তা মোড় এলাকার ঈদগাহ মার্কেটের সামনে তাকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নিহতের বড় ভাই মো. সেলিম বলেন, বুধবার (৬ আগস্ট) রাতে তুহিন চান্দনা চৌরাস্তা থেকে বাসার দিকে যাচ্ছিল। এসময় ৬-৭ জন যুবক দা ও চাপাতি নিয়ে তাকে ধাওয়া করে। সে প্রাণ রক্ষার জন্য দৌড়ে ঈদগাহ মার্কেটের চা-পান বিক্রেতা খায়রুল ইসলামের দোকানে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
সন্ত্রাসীরা সেখানে গিয়ে তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে বুকে, গলায়, কাঁধে ও পিঠে এলোপাতাড়ি কোপায়। এতে সে ঘটনাস্থলেই মারা যায়।
মো. সেলিম বলেন, ‘ঘটনার সময় স্থানীয় কলকারখানা ছুটি হওয়ায় আশপাশে বহু লোকজনের উপস্থিত ছিল। কিন্তু ভয়ে কেউ তুহিনকে বাঁচাতে এগিয়ে যায়নি। আমার ভাইকে হত্যার পর সন্ত্রাসীরা সদর্পে সেখান থেকে চলে যায়।”
ঘটনার কিছুক্ষণ আগে থেকে তুহিনের সঙ্গেই ছিলেন তার বন্ধু ও দৈনিক নবচেতনা পত্রিকার মহানগর প্রতিনিধি মো. শামীম হোসেন। ঘটনার পর তিনিই বাসন থানা পুলিশকে বিষয়টি জানান।
শামীম বলেন, ‘আমরা এক সঙ্গেই হেঁটে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একজন নারী এক ব্যক্তিকে নাজেহাল করছিল। ওই ব্যক্তি নারীটিকে আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন দুর্বৃত্ত ধারালো অস্ত্র দিয়ে ব্যক্তিকে আঘাত করে। তখন তিনি দৌঁড়ে পালিয়ে যান।
‘এ সময় সাংবাদিক তুহিন ঘটনাটি দেখে দৌঁড়ে সাইডে গিয়ে ভিডিও করছিলেন। পরে দুর্বৃত্তরা ভিডিও ধারণ করার দৃশ্য দেখে ফেলায় তুহিনকে ধাওয়া দেয়। তুহিন দৌঁড়ে পালানোর চেষ্টা করলেও দুর্বৃত্তরা তাকে ধরে ফেলে এবং প্রকাশ্যে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়।’
জিএমপির উপ-কমিশনার রবিউল ইসলাম বলেন, ‘খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। ঘটনা সম্পর্কে স্থানীয়দের কাছ থেকে তথ্য এবং আশপাশের এলাকা থেকে সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘সিসিটিভির ফুটেজ পর্যালোচনা এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে দেখা যায়, সন্ধ্যা ৭টার দিকে বাদশা মিয়া নামে এক ব্যক্তি চান্দনা চৌরাস্তা মোড়ে এক নারীর সঙ্গে বিবাদে জড়ান। এ সময় বাদশা মিয়া ওই নারীকে আঘাত করেন। তখন একদল দুর্বৃত্ত নারীর পক্ষ নিয়ে ধারালো চাপাতি হাতে বাদশা মিয়াকে আঘাত করলে তিনি দৌঁড়ে পালিয়ে যান। আর এ ঘটনাটি রাস্তার পাশ থেকে মোবাইলে ভিডিও করছিলেন সাংবাদিক তুহিন।’
জিএমপির উপ-কমিশনার বলেন, ‘তখন সন্ত্রাসীরা তুহিনকে দেখে ফেলে ভিডিও মুছে ফেলতে বলে। তবে তুহিন ভিডিও মুছতে অস্বীকার করলে তাকে ধাওয়া দেয় সন্ত্রাসীরা। এসময় তুহিন দৌঁড়ে পালাতে থাকে। সন্ত্রাসীরাও তার পিছু নিয়ে ধাওয়া করে।
‘এক পর্যায়ে চান্দনা চৌরাস্তার মসজিদ মার্কেটের সামনে একটি দোকানের কাছে সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তুহিনের মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যায়।’
রবিউল ইসলাম বলেন, বাদশা মিয়ার গ্রামের বাড়ি শেরপুরে। তিনি স্থানীয় রোজ সোয়েটার কারখানায় চাকরি করেন। সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত অবস্থায় তিনি শহীদ তাজউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
পুলিশ আরও জানায়, যে নারীটির সঙ্গে বাদশা মিয়ার বিবাদ হয়, তিনি মানুষের সঙ্গে কৌশলে সম্পর্ক তৈরি করে সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে সব লুটে নেওয়ার চক্রের সঙ্গে জড়িত।
এর আগে প্রাথমিকভাবে স্থানীয়রা বলছিলেন, চাঁদাবাজি নিয়ে ফেইসবুকে লাইভ করার পর তুহিনের ওপর হামলা হয়।
এ বিষয়ে পুলিশ বলছে, এটি কোনো চাঁদাবাজির ঘটনা নয়। নারীঘটিত একটি ঘটনার ভিডিও ধারণ করার কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে সন্ত্রাসীরা তুহিনকে কুপিয়ে খুন করে।
তুহিনের ফেইসবুক প্রোফাইলে দেখা যায়, সেখানে চাঁদাবাজি সম্পর্কিত কোনো লাইভ, ভিডিও বা কোনো রিপোর্ট নেই। তিনি চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার বিভিন্ন সমস্যা ও মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ফেইসবুকে পোস্ট করতেন।
বৃহস্পতিবার (৬ আগস্ট) সন্ধ্যার দিকে তিনি চান্দনা চৌরাস্তার এক মিনিট ৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও আপলোড করেন।
যার ক্যাপশনে লেখা রয়েছে, ‘যেমন খুশি তেমন রাস্তা পার হওয়ার দৃশ্য’। এর কিছু সময় আগে তিনি আরও দুটি ছবি ও ভিডিও আপলোড দেন।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন বাসন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি শাহীন খান বলেন, নিহতের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
এছাড়া ফুটেজ ও ক্লু সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে। কী কারণে এ হত্যাকাণ্ড তা জানার এবং জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।