প্রেম বিতরণে নবীজীর (সাঃ) শ্রেষ্ঠত্ব
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮:৪৭ পিএম, ১লা সেপ্টেম্বর ২০২৫

বিশ্ব নিখিল যখন নবীজীর আবির্ভাবের আনন্দে মুখর; ঐ শিশু নবী (সাঃ) এর কণ্ঠে তখনই শোনা গিয়াছিল 'ইয়া উম্মতি, ইয়া উম্মতি’। সৃষ্টির দুঃখ বেদনায় তখনই নবী (সাঃ) এর কণ্ঠে বাজিল বেদনার ক্রন্দন জানি। যে সৃষ্টি তাহারই নূর হইতে সৃষ্ট, জন্মের মুহূর্ত হইতেই সেই সৃষ্টির বেদনায় নবী (সাঃ) ব্যথিত হইবেন, ইহাইতো স্বাভাবিক। জন্মের প্রথম মুহূর্ত হইতে তদীয় মহত্তম জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সৃষ্টির জনাই উৎসর্গীকৃত হইয়াছে; শুধু মানুষের জন্য নয়, সৃষ্টির বহু ক্ষুদ্র প্রাণীর জন্যও তিনি তাহার করুণার ধারা অবারিত রাখিয়াছেন- ইহারও প্রমাণ রহিয়াছে।
পবিত্র হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) একদা এক বনের নিকট দিয়া যাইবার সময়ে দেখিতে পান, একটি হরিণ শিকারীর জালে আটকা পড়িয়াছে। হরিণ নবীজী (সাঃ) এর নিকট তাহার হৃদয়ের ভাষায় অশ্রুসিক্ত নয়নে বলিল, 'হে নবী করীম (সাঃ)! আমি শিকারীর জালে আটকা পড়িয়াছি। কিন্তু আমার দুইটি শিশু শাবক রহিয়াছে। ঐ শিশু শাবকদ্বয়কে আমি শেষবারের মত দুধ খাওয়াইয়া আসিতে চাই। আর তাহাদের নিকট হইতে বিদায় লইয়া আসিতে চাই। তাহা না হইলে তাহারা আমাকে খুঁজিতে খুঁজিতে এমন কোন জায়গায় গিয়া পড়িতে পারে, যাহাতে তাহাদেরও জীবন বিপন্ন হয়। আপনি সকল সৃষ্টির জন্য আল্লাহতায়ালার করুণা। আপনি দয়া করিয়া জাল খুলিয়া দিন। আমি আবার এই স্থানে ফিরিয়া আসিব।
মাতৃস্নেহে আপ্লুত হরিণীর সজল নয়নের অনুরোধ হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) ফেলিতে পারিলেন না। তিনি জাল উঠাইয়া হরিণীকে মুক্ত করিয়া সেখানে বসিয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ পরে ইহুদী শিকারী সেখানে আসিয়া নবী করীম (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করিল, জাল গুটানো কেন? নবীজি সকল ঘটনা খুলিয়া বলিলেন। ইহুদী নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট অনুযোগ করিতে লাগিল, 'ইহা কি সম্ভব। বনের হরিণী জাল হইতে মুক্ত হইয়া কি আর ফিরিয়া আসিবে?' নবী করীম (সাঃ) তাহাকে বলিলেন, আমিতো হরিণের জন্য জামিন রহিয়াছি।
হরিণ নিজ আবাসে যাইয়া তাহার শাবকদের বলিল, ‘তোমরা শিগগিরই দুখ খাইয়া লও। ইহাই তোমাদের জন্য আমার শেষ দুধ পান করানো। আমি শিকারীর জালে আটকা পড়িয়াছিলাম। বরাত গুণে হযরত নবী করীম (সাঃ) ঐ পথ দিয়া যাইতেছিলেন। নবী করীম (সাঃ) এর নিকট তোমাদের কথা বলিয়া সামান্য সময়ের জন্য ছুটিয়া আসিয়াছি।’ হরিণ শাবকগণ কহিল, 'স্বয়ং নবী করীম (সাঃ) তোমার জন্য জামিন হইয়া অপেক্ষা করিতেছেন, ইহা তো সাংঘাতিক কথা। আমরাও তোমার সঙ্গে যাইব।' কিছুক্ষণ পরে ইহুদী শিকারী দেখিল, বনের হরিণ ফিরিয়া আসিতেছে। তাহার দুই শাবক তাহার পশ্চাতে আসিতেছে। হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) এর নিকট দেয়া কথা রক্ষা করিতে বনের হরিণ ফিরিয়া আসিয়াছে। ইহা দেখিয়া ইহুদীর জ্ঞানোদয় হইল। ইহুদী তৎক্ষণাৎ নবী করীম (সাঃ)-এর কদমে পড়িল- ইসলাম গ্রহণ করিবার জন্য। নবী করীম (সাঃ) এর নিকট সে বায়াত হইল, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিল।
সহীহ রেওয়াতে আছে, একদা হযরত জীব্রাইল (আঃ) আল্লাহতায়ালার নিকটে আরজ করিলেন, হে আল্লাহপাক। আপনি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে কেন রাহমাতুল্লিল আ'লামীন উপাধিতে ভূষিত করিলেন, অন্য কোনো নবী কেন এমন নামে অভিহিত হইলেন না। আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীন হযরত জীব্রাইল (আঃ) কে তখন বলিলেন, 'তুমি আমার হাবীবের নিকট গমন কর, তাহা হইলেই ইহার কারণ জানিতে পারিবে।' হযরত জীব্রাইল (আঃ) তখন এক বাজ পাখীর রূপ ধারণ করিলেন। তাহার অন্য এক সহযোগী ফেরেশতাকে এক কবুতর শাবকের রূপ ধারণ করিতে বলিলেন।
অতঃপর বাজ পাখী রূপী জীব্রাইল (আঃ) কবুতর রূপী পক্ষী শাবককে তাড়া করিয়া হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) এর নিকট গমন করিলেন। কবুতর রূপী ফেরেশতা রাসূলে করীম (সাঃ) এর নিকট প্রাণ রক্ষার জন্য আশ্রয় চাহিল। হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) তাহাকে তাহার নিজের জামার পকেটের মধ্যে লুকাইয়া রাখিলেন। ইহার পর বাজপাখী রূপী জীব্রাইল (আঃ) আসিয়া হযরত নবী করীম (সাঃ) কে বলিল, 'ইয়া রাসুলাল্লাহ। আমি ক্ষুধার্ত: এই পাখীটাকে যদি আপনি আমাকে ফেরত না দেন, তাহা এইলে আমাকে ক্ষুধায় কষ্ট পাইতে হইবে।’
নবী করীম (সাঃ) তখন বাজপাখীকে বলিলেন, 'তুমি আমার শরীরের যে কোনো স্থান হইতে গোশত যতখানি খুশী খাইয়া যাও।’ তখন বাজপাখী নবী করীম (সাঃ)-এর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় তাহার ঠোঁট লাগাইল- কিন্তু দেখিতে পাইল, নবী করীম (সাঃ)-এর দেহ মোবারকের কোথাও গোশত নাই। কেবলই হাড়ের কাঠামোর উপর চামড়া আবৃত। বাজপাখীরূপী জীব্রাইল (আঃ) তখন বলিলেন, ‘হে নবী (সাঃ)। আপনার দেহ মোবারকের কোথাও একটুও গোশত নাই, যাহা দিয়া আমার ক্ষুধা নিবৃত্ত করিতে পারি।’ তখন নবী করীম (সাঃ) তাহাকে বলিলেন, ‘আমার চক্ষু নিশ্চয়ই নরম। তুমি না হয় আমার চক্ষু খাইয়া তোমার ক্ষুধা নিবৃত্ত কর। যে কবুতর আমার কাছে আশ্রয় চাহিয়াছে তাহাকে আমি তোমার হাতে তুলিয়া দিয়া তাহার মৃত্যু ঘটাইতে পারিব না।’ তখন জীব্রাইল (আঃ) আপন পরিচয় জানাইয়া ও ঐরূপ বেশ সাজিবার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করিয়া নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট ক্ষমা চাহিয়া বলিলেন, ‘আমার সকল ভ্রান্তি অপসারিত হইয়াছে, আপনিই রাহমাতুল্লিল আ‘লামীন, সমস্ত বিশ্ব নিখিলের জন্য করুণা ধারা।
কথিত আছে, একদা হযরত নবী করীম (সাঃ) পথের মধ্যে একটি আহত বিড়াল ছানা দেখিতে পাইয়া তাহাকে নিজ গৃহে লইয়া আসিলেন, নিজ হাতে পরিচর্যা করিয়া নিজ বিছানায় শয়ন করাইলেন। পরদিন প্রত্যুষে নামাজ পড়িবার জন্য তিনি উঠিতে চাহিলেন। দেখিলেন, জামার অস্তিনের উপর বিড়াল ছানা তখন ঘুমাইয়া আছে। আহত বিড়াল ছানার ঘুম ভাংগিলে তাহার কষ্ট হইবে; তাই তিনি একটি ধারাল ক্ষুর দ্বারা জামার আস্তিন কাটিয়া ফেলিলেন। তবুও তিনি আহত বিড়াল ছানার ঘুম ভাংগিতে দিলেন না।
নবী করীম (সাঃ) কে সকল জীব জানোয়ার পশু পাখী চিনিত, তাহার আরও প্রমাণ রহিয়াছে। হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ) সহ যখন হিজরতের উদ্দেশ্যে গমন করিতেছিলেন, তখন তাহাদের অন্বেষণে আগমনকারী কোরায়েশ চরদের দৃষ্টি এড়াইবার জন্য এক পাহাড়ের গুহায় তাহারা আশ্রয় লইয়াছিলেন। ঐ গুহার একটি গর্তে এক সর্প অপেক্ষা করিতেছিল।
গর্তের সর্প দেখিয়া হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ) শঙ্কিত হইলেন। তিনি ভাবিলেন, এখন সর্প দেখিলে বিশ্রামরত নবী করীম (সাঃ)-এর বিশ্রামে বিয় ঘটিবে। সর্পকে মারিতে গেলে শব্দ শুনিয়া কোরায়েশদের চরেরা এই গুহার মধ্যে আসিয়া পড়িতে পারে। তখন নবী করীম (সাঃ) এর জীবন বিপদাপন্ন হইতে পারে। এই ভাবিয়া তিনি গর্তের উপর নিজ পা দিয়া চাপিয়া রাখিলেন। সর্প বাহির হইতে চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হইলে হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ) এর পায়ে ছোবল দিল। বেদনায় হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ) এর পা নীলবর্ণ ধারণ করিল। কিন্তু পাছে নবী করীম (সাঃ) এর ঘুম ভাংগিয়া যায়, তাই হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) কোনো শব্দ করিলেন না।
এমন সময় হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) এর ঘুম ভাংগিয়া গেল। তিনি দেখিলেন, হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ) ছাহেবের চোখে পানি। বেদনায় তাহার সমগ্র শরীর নীল বর্ণ ধারণ করিয়াছে। নবী করীম (সাঃ) কারণ জানিতে চাহিলে হযরত আবুবকর (রাঃ) ইশারায় সর্পের গর্ত দেখাইয়া দিলেন।
হযরত নবী করীম (সাঃ) ভদীয় মুখ মোবারক হইতে একটু থুতু নিয়া হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ) এর ক্ষতস্থানে লাগাইয়া দিলেন, ইতিমধ্যে সর্প গর্ত হইতে বাহির হইয়া হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) কে জানাইল, 'ইয়া নবী (সাঃ)। আপনি বিশ্ব নিখিলের নবী, সকল সৃষ্টির নবী। আপনাকে এক নজর দেখিয়া জন্মস্বার্থক করিবার জন্যই আমি গর্ত হইতে বাহির হইয়া আসিতে চাহিয়াছিলাম। কিন্তু হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ) ছাহেব আমাকে বাধা দিবার কারণেই আমি তাহাকে দংশন করিয়াছি। অন্য কোনো কারণে নয়। আমি আপনাদের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি।’
হযরত নবী করীম (সাঃ) এর এক উম্মত জেহাদে শহীদ হইয়াছিলেন। তাহার এক শিশু পুত্র ছিল। ঈদের আগের দিন সকল শিশু নতুন পোশাক পাইয়া আনন্দ করিতেছিল। কিন্তু এতিম শিশুর পোশাক কিনিয়া দিবার মত কেউ ছিল না। সে তাহার মায়ের কাছে গিয়া পোশাকের আরজি জানাইল। এতিম শিশুর মাতা বলিলেন, নবী করীম (সাঃ) এর মহব্বতে তোমার আব্বা শহীদ হইয়াছেন। তুমি তাহার নিকট যাও। এতিম শিশুটি নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট গমন করিল। কিন্তু তখন নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট এমন কোন অর্থ ছিল না-যাহার দ্বারা তিনি শিশুটির পোশাক কিনিয়া দিতে পারিবেন। এতিম শিশুর দুঃখে তাহার হৃদয়ে হাহাকার উঠিল। তাহারও ক্রন্দন আসিল, যেই ক্রন্দনে পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা অস্থির হইলেন। তিনি জীব্রাইল (আঃ) কে দিয়া বেহেশতের পোশাক ঐ শিশুর জন্য প্রেরণ করিলেন। শিশুটি আনন্দে আত্মহারা হইয়া মায়ের নিকট প্রত্যাবর্তন করিল।
মানুষ তথা জীবের দুঃখ এমন আপন করিয়া নিতে আর কে পারিয়াছে? বিশ্ব নিখিল তাহারই নূর দ্বারা সৃষ্টি তাই মানব ও প্রাণীর দুঃখ তাহার হৃদয়ে এমন দহন করিবে এটাই স্বাভাবিক। আর আল্লাহপাকের পক্ষ হইতে তিনি সকলেরই আশ্রয়স্থল-তাই তাহার তুলনা নাই যেমন মহত্বে, তেমনি জ্ঞানে, শৌর্যে ও বীরত্বে। নবী করীম (সাঃ)-এর জীবনের প্রতি কর্মে এই শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন রহিয়াছে; তাহা আমরা বুঝি বা না বুঝি।
এসডি/