জ্ঞান ও গুণে নবীজীর (সাঃ) শ্রেষ্ঠত্ব
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১:৫৫ পিএম, ২রা সেপ্টেম্বর ২০২৫

হযরত নবী করীমকে (সাঃ) আল্লাহপাক যে অজ্ঞাতপূর্ব জ্ঞান দান করিয়াছিলেন, তাহা যেদিন তিনি নবুয়তপ্রাপ্ত হন; সেদিনই আল্লাহ ঘোষণা করিয়াছিলেন। জীব্রাইল (আঃ) আল্লাহতায়ালার তরফ হইতে হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট প্রথম যে ওহী আনয়ন করিয়াছিলেন তাহাতে বলা হইল- ‘পাঠ কর, তোমার প্রভুর নামে, যিনি সমস্ত বিশ্ব নিখিল সৃষ্টি করিয়াছেন। যিনি এক বিন্দু রক্ত হইতে মানুষ সৃষ্টি করিয়াছেন। পাঠ কর, তোমার সেই মহিমাময় প্রভুর নামে যিনি কলমের মাধ্যমে জ্ঞান দান করিয়াছেন। যিনি মানুষকে অজ্ঞাতপূর্ব জ্ঞান দান করিয়াছেন।’ (সূরা আলাকঃ ১-৫)
নির্জন হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) যখন এই বাণী আল্লাহতায়ালার নিকট হইতে ফেরেশতা জীব্রাইলের দ্বারা প্রাপ্ত হইলেন-তিনি অভিভূত হইলেন। স্বাভাবিক চৈতন্য ফিরিয়া আসিলে তিনি দেখিলেন যে, হযরত জীব্রাইল (আঃ) তখনও দাঁড়াইয়া আছেন। সেই প্রথম তিনি হযরত জীব্রাইলকে (আঃ) দেখিলেন। অভিভূত ও আবেগাপ্লুত হইয়া বিবি খোদেজার নিকট গমন করিলেন। গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া তিনি বারংবার জীব্রাইলকে (আঃ) দেখিতে পাইতেছিলেন এবং তাহার কন্ঠ ধ্বনি শুনিতে পাইতেছিলেন, ‘হে মুহাম্মদ! আপনি আল্লাহর রাসূল। আমি জীব্রাইল।’
নবী করীম (সাঃ)-এর নূরে বিশ্ব জগৎ সৃষ্টি। তাই সর্বজগতের জ্ঞান তাহারই নিকট প্রাপ্ত হওয়া সম্ভব। নবী করীম (সাঃ) নবী ঘোষিত হইবার পর প্রথমে যিনি তাহার উপর ঈমান আনিয়া বায়াত লইলেন, তিনি পূণ্যময়ী মাতা খোদেজা। পুরুষদিগের মধ্যে যিনি ঈমান আনিলেন তিনি হযরত আলী (রাঃ)। হযরত নবী করীম (সাঃ) যখন আল্লাহতায়ালার তৌহিদের বা একত্বের বাণী শোনাইলেন, তখন মক্কার পৌত্তলিক পূজারী কোরায়েশবাসী সহ্য করিতে পারিল না- কারণ ইহাতে তাহাদের প্রাধান্য ঘুচিয়া যাইবার সম্ভাবনা ছিল। কোরায়েশদের অত্যাচার ও ভ্রুকুটি উপেক্ষা করিয়াও হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) আল্লাহতায়ালার সত্য দীন প্রচার অব্যাহত রাখিলেন। ইতিমধ্যে তিনি তায়েফ গমন করিয়া তৌহিদের বাণী প্রচার করিয়াছেন।
সর্বত্র পৌত্তলিক কোরায়েশগণ তাহাকে বাঁধা দিয়াছে। কিন্তু তিনি অকুতোভয়ে সকল অত্যাচার-উৎপীড়ন সহ্য করিয়া তৌহিদের সত্য বাণী প্রচার করিয়াছেন। মক্কার কোরায়েশগণ যখন তাহার উপর খড়গহস্ত, তখন আল্লাহতায়ালা হযরত রাসূলে করীমকে (সাঃ) মেরাজের নেয়ামতে ভূষিত করিলেন। এই মেরাজে আল্লাহপাক তাহাকে এমন নিয়ামত দান করিলেন- এমন নৈকট্য দান করিলেন, যাহা তৎপূর্বে অন্য কোনো নবী (আঃ) বা ফেরেশতা লাভ করেন নাই। মেশকাত শরীফে পবিত্র মেরাজের যে বর্ণনা রহিয়াছে, তাহার অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃত করা হইল- ‘রজনী দ্বিপ্রহর। ঘন অন্ধকার। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। নিস্তব্ধ নির্জন। হযরত নবী করীম (সাঃ) গৃহে ঘুমাইয়া আছেন। জাগিয়া দেখিলেন, ফেরেশতা জীব্রাইল (আঃ) শিয়রে দন্ডায়মান। জীব্রাইল (আঃ) প্রথমেই হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর হৃদয় পরীক্ষা করিলেন- নবী করীম (সাঃ) এর হৃদয় আবারও প্রসারিত করিয়া দিলেন। তাহার পর জোতির্ময় বাহন বোরাকে চড়িবার জন্য হযরত নবী করীম (সাঃ) কে ইশারা প্রদান করিলেন। হযরত (সাঃ) বোরাকে আরোহন করিলে তাহা বিদ্যুতের চেয়েও লক্ষ গুণ বেগে ছুটিয়া চলিল। প্রথমে তিনি মসজিদুল আক্সায় অবতরণ করিলেন।
সেখানে তিনি দুই রাকাত নামাজ আদায় করিবার পর আবার বোরাকে আরোহন করিলেন। একে একে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম আসমান অতিক্রম করিলেন। তিনি এই সকল আসমানে যথাক্রমে হযরত আদম (আঃ), হযরত ইউছুফ (আঃ), হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) ও হযরত ঈসা (আঃ), হযরত ইদ্রিস (আঃ), হযরত হারুন (আঃ), হযরত মুসা (আঃ) ও হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে দেখিতে পাইলেন। ইহার পর সিদরাতুল মোনতাহা পার হইয়া রায়তুল মামুর বা হকিকতে কাবায় গমন করিলেন। বায়তুল মামুরের দরজা তাহার জন্য খুলিয়া দেওয়া হইল। তিনি আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভ করিলেন। আল্লাহপাক তদীয় বর্ণনাতীত রূপ হযরত নবী করীম (সাঃ) কে দর্শন করাইলেন- উভয়ের মধ্যে কালাম বিনিময় হইল। এই মেরাজে হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) বেহেশত-দোযখ, আরশ-কুরছি, লওহ-কলম, সপ্তম আসমান সবকিছুই প্রত্যক্ষ করিলেন। আল্লাহতায়ালার সহিত প্রেমময় মিলনে মিলিত হইলেন- এমন নৈকট্য লাভ করিলেন যাহা আর কোনো নবী বা ফেরেশতা লাভ করেন নাই। আল্লাহতায়ালার জাতপাক মোবারকের সহিত মিলন লাভ করিয়া হযরত নবী করীম (সাঃ) আল্লাহতায়ালার পরিপূর্ণ জ্ঞানে জ্ঞানী ও গুণান্বিত হইলেন।
মে’রাজ সম্পর্কে আল্লাহপাক কুরআন মজীদে নিম্নলিখিত আয়াত নাজিল করিয়াছেন-’ইহা তাহারই মহিমা, যিনি তাহার দাসকে এক রজনীতে পবিত্র মসজিদ হইতে দূরতম মসজিদ (কাবা হইতে বায়তুল মোকাদ্দাম) পর্যন্ত পরিভ্রমণ করাইয়াছিলেন।’ (সূরা বনী-ইসরাঈলঃ ১) আল্লাহপাক আবার বলিতেছেন- “অস্তগামী তারকার শপথ, তোমদের বন্ধু মুহাম্মদ (সাঃ) ভুল করেন না, অথবা লক্ষ্যভ্রষ্ট হন না অথবা নিজের ইচ্ছাতেও তিনি কিছু বলেন না, ইহা (পাক কুরআন) তাহার নিকট প্রকাশিত পাক কালাম ছাড়া আর কিছুই নহে। অসীম ক্ষমতাশীল (প্রভু) তাহাকে জ্ঞান দান করিয়াছেন। [শক্তির অধিকারী আল্লাহপাক- কাজেই তিনি (রাসূলে করীম (সাঃ)) পূর্ণতা লাভ করিলেন এবং তিনি আকাশের সর্বোচ্চ শিখরে পৌছাইলেন, তারপর অতি নিকটবর্তী হইলেন- ফলে ব্যবধান রহিল তাহাদিগের (নবী-করীম (সাঃ) ও আল্লাহপাক) মাঝে দুই ধনুকের।
তিনি (আল্লাহ) তাহার ভৃত্যের (মুহাম্মদ (সাঃ) এর) নিকট যাহা প্রকাশ করিবার ছিল প্রকাশ করিলেন। যাহা তিনি দেখিয়াছিলেন তাহা তাহার হৃদয় ভুল করে নাই। তিনি যাহা দেখিয়াছিলেন তাহা সম্পর্কে তোমরা কিরূপে অবিশ্বাস করিবে? নিশ্চয়ই তিনি দ্বিতীয়বার দূরতম সিদরাতুল মোনতাহার নিকট দেখিয়াছেন, যাহার নিকট পূণ্যাত্মা দিগের বাসস্থান রহিয়াছে। যখন সেই সিদরাতুল মোনতাহা আল্লাহতায়ালার জ্যোতিতে পরিপূর্ণ হইল তখন তাহার (নবী করীম (সাঃ)) চক্ষু ভ্রান্ত বা লক্ষ্যভ্রষ্ট হইল না। নিশ্চয় তিনি তাহার প্রভুর শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন দেখিলেন।” (সূরা নাজুমঃ ১-১৮)
রাসূলে করীম (সাঃ) মহা পবিত্র মেরাজের মাধ্যমে খোদাতত্ত্ব জ্ঞান লাভ করিয়া পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করিলেন-এই জ্ঞান যাহাতে তদীয় উম্মতগণ লাভ করিতে পারেন তদজন্যে তিনি আল্লাহতায়ালার নিকট ফরিয়াদ করিলেন। আল্লাহতায়ালা তদীয় রাসূল (সাঃ)-এর অনুরোধ অনুযায়ী উম্মতের জন্য নামাজে এমন হেকমত রাখিলেন যাহাতে মোমিন নামাজে আল্লাহতায়ালার জাত মোবারক দর্শন লাভ করিতে পারেন ও তদীয় জাত মোবারকের নূর দ্বারা জ্ঞান লাভ করিতে পারেন। আল্লাহতায়ালার নূর হিসাবে ও সমস্ত জগতের ধারক ও বাহক হিসেবে হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) ছিলেন বিশ্ব জগতের জ্ঞানের প্রতীক। আবার মহাপবিত্র মেরাজের মাধ্যমে হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) স্বয়ং আল্লাহপাকের জাতপাক মোবারক দর্শন করিয়া আল্লাহতায়ালার জ্ঞানে জ্ঞানী হইলেন।
তাই হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) স্রষ্টা আল্লাহ ও সৃষ্টি বিশ্বনিখিলের জ্ঞানে বা এলমে হুজুরী (আল্লাহতায়ালার জ্ঞান) ও এলমে হুজুলী বা সৃষ্টি জগতের জ্ঞান। জ্ঞানী। ইসলামের নবী (সাঃ) এই উভয় জ্ঞানে জ্ঞানী বলিয়া ইসলামই জ্ঞানের প্রতীক- ইসলাম তাই আলোকের পথ। জ্ঞানবিহীন পৌত্তলিকতা ও অন্যান্য সকল মত তাই অন্ধকার। আল্লাহতায়ালা স্বয়ং কুরআন মজীদে ফরমাইয়াছেন- ‘এবং তিনি (আল্লাহ) নিজ নিজ কক্ষ পরিভ্রমণকারী সূর্য ও চন্দ্রকে তোমাদের অধীন করিয়া দিয়াছেন। অধীন করিয়া দিয়াছেন দিন ও রাত্রিকে’ (সূরা ইব্রাহিমঃ ৩৩) জ্ঞানের এই শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব। অন্য কোন নবী (আঃ)-এর নিকটে প্রেরিত গ্রন্থে আল্লাহ বলেন নাই, নভোমন্ডল ও চন্দ্র সূর্য এবং দিবারাত্রিকে তোমাদের অধীন করিয়া দেয়া হইয়াছে। জ্ঞানের প্রতীক ইসলামের আগমনের পরেই তাই পৃথিবীতে জ্ঞানের নতুন বিপ্লব শুরু হইল। জ্ঞান চর্চায় মানুষ নতুন শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করিল। ইসলাম তাই জ্ঞানের প্রতীক। আর পৌত্তলিকতা অন্ধকারের প্রতীক।
পৌত্তলিকতার অন্ধকারের বিরুদ্ধে রাসূলে করীম (সাঃ) তৌহিদের যে বাণী প্রচার করিলেন তাহা ছিল সত্যের আলোর বাণী। তাই আলো ও অন্ধকার, সত্য ও মিথ্যার যে দ্বন্দ; সেই দ্বন্দু অনিবার্য হইয়া উঠিল। হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) ও তাহার উপরে ঈমান আনয়নকারীদের উপর অত্যাচার শুরু হইল। যতই বেশী লোক হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) এর অনুসারী হইতে লাগিল- মুসলমানদের উপর অত্যাচার ততই বাড়িতে লাগিল। মুসলমানদের জান-মালের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করিয়া তিনি হিজরত করিতে মনস্থ করিলেন। আল্লাহতায়ালার নিকট হইতে পূর্বাহ্নে তিনি এরূপ ইশারাও পাইয়াছিলেন আল্লাহতায়ালার ইঙ্গিতে মদীনা হইতে আগত হজ্ব যাত্রীদের সহিত রাসূলে করীম (সাঃ)-এর যোগাযোগ হইল। তাহারা ইসলাম গ্রহণ করিলেন। নবী করীম (সাঃ) ও মুসলমানগণ মদীনা নগরীতে আমন্ত্রিত হইলেন। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত মক্কা নগরীতে তদীয় উম্মত অসহায় অবস্থান করিতেছিলেন ততদিন পর্যন্ত তিনি নিজের নিরাপত্তার জন্য হিজরতে গমন করেন নাই।
সকল মুসলমানকে মদীনায় প্রেরণ করিয়া তিনি নিজে আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ) কে সঙ্গে করিয়া হিজরত করিলেন। সর্বশেষে আসিলেন হযরত আলী (রাঃ) ছাহেব। মদীনা নগরীতে আসিয়া হযরত নবী করীম (সাঃ) পূর্ণ উদ্যমে ইসলাম প্রচার শুরু করিলেন। কাফের বা পৌত্তলিক কোরায়েশগণের নিকট হইতে বাধাও আসিল অনেক। একে একে বদর, খন্দর ও খায়বারের যুদ্ধ দ্বারা হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) কোরায়েশগণকে পরাস্ত করিলেন। ইসলামের কেন্দ্রস্থল মদীনা শত্রুমুক্ত হইল। অবশেষে মক্কায় অভিযান। অষ্টম হিজরীর দশই রমজান হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) দশ হাজার ন্যায়নিষ্ঠ সহচরসহ মক্কা অভিযানের উদ্দেশ্যে মদীনা ত্যাগ করিলেন। মক্কার উপকণ্ঠে এক পার্বত্য স্থানে হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) শিবির সন্নিবেশ করিলেন। সন্ধ্যার পর শিবিরে খাদ্য প্রস্তুতের জন্য চুল্লী জ্বালানো হইল। শিবিরে শিবিরে আলো জ্বালানো হইল। পর্বত উপত্যকা এক অপূর্বদৃশ্য লাভ করিল। অনতিদূর মক্কা হইতে কাফেরগণ আলোময় অসংখ্য শিবির দেখিয়া ভীত হইয়া পড়িল। তাহারা হতভম্ভ হইয়া গেল। রাত্রির অন্ধকারে কাফেরদের ছর্দার আবু ছুফিয়ান নিজে দুইজন সহচরসহ সংবাদ সংগ্রহের জন্য শিবিরের নিকটে গেল। তাহারা শিবির রক্ষীদের নিকট বন্দী হইল। বন্দী তিনজনকে হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) এর নিকট নেওয়া হইল।
চির শত্রু আবু ছুফিয়ান, যাহার আত্মীয়া হেন্দা হযরত আমীর হামযা (রাঃ) এর কলিজা চিবাইয়া খাইয়াছিল, তাহাকে পাইয়া হযরত (সাঃ) রাগান্বিত হইলেন না। মধুর সুরে বলিলেন, ‘আবু ছুফিয়ান। এখনও কি তোমাদের ভুল ভাঙ্গিল না? এখনও কি তোমরা আমাকে আল্লাহর রাসূল বলিয়া স্বীকার করিবে না?’ আবু ছুফিয়ান বলিল, তাহারও কিছুদিন যাবত সত্য ধর্ম ইসলাম কবুল করিতে ইচ্ছা হইয়াছে। রাসূলে করীম (সাঃ) তখন বলিলেন, বল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। আবু ছুফিয়ান ভাঙ্গা ভাঙ্গা আড়ষ্ট গলায় তাহাই উচ্চারণ করিল। হযরত (সাঃ) আবু ছুফিয়ানকে আলিংগণ করিলেন। রাসূলে করীমকে (সাঃ) আবু ছুফিয়ান জিজ্ঞাসা করিল, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি কি আজ কোরায়েশ গোত্রকে নিশ্চিহ্ন করিয়া দিবেন? আজ যদি আপনি অনুগ্রহ না দেখান তাহা হইলে আপনার স্বজাতি, স্বগোত্রের লোকেরা নিশ্চিহ্ন হইবে।’ এই সময়ে হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) এর চাচা হযরত আব্বাসও রাসূলে করীম (সাঃ)-এর সহিত দেখা করিতে আসিয়াছিলেন। তিনিও হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) নিকট বায়াত গ্রহণ করিলেন।
প্রত্যুষে বীর নবী (সঃ) মক্কা নগরে প্রবেশ করিলেন। বিভিন্ন দলপতিকে বিভিন্ন দিক দিয়া মক্কা প্রবেশের আদেশ দিলেন। কিন্তু আক্রমণ করিতে নিষেধ করিলেন। নিশান উড়াইয়া কাতারে কাতারে সেনাদল বীরপদভরে মক্কা নগরীতে প্রবেশ করিল। সর্বশেষে এক ক্রীতদাসের সহিত হযরত একই উটের পিঠে সওয়ার হইলেন। ক্রীতদাসের সহিত একই আসনে সম্রাট। তাহার মধ্যে না আছে কোনো অহংকার, না বিজয়ের গর্ব, না শত্রুর উপর প্রতিহিংসার কোনো ইচ্ছা।
মক্কা বিজয়ের পর নবী করীম (সাঃ)-এর উল্লেখযোগ্য অভিযান হইল তাবুক অভিযান। গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্র ও রমজানের কৃচ্ছতা সত্ত্বেও হযরত নবী করীম (সাঃ) এর সঙ্গে এই অভিযানে ৪০,০০০ মুসলমান অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন। তৎকালীন খৃষ্টান জগতের প্রধান শক্তি রোমান সম্রাট মদীনা আক্রমণের ইচ্ছায় সিরিয়ার খৃষ্টানদের অনুরোধে সসৈন্যে অগ্রসর হইতেছে; এই সংবাদে নবী করীম (সাঃ) স্বয়ং এই অভিযান পরিচালনা করেন। মুসলমানদের এই বিপুল বাহিনী দেখিয়া খ্রষ্টান নেতাদের জ্ঞান হইল।
তাহারা এতদিন মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রকে ক্ষুদ্র শক্তি বিবেচনা করিয়াছিল। নবী করীম (সাঃ) যে এত বিপুল শক্তির অধিকারী ইহা দেখিয়া রোমান সম্রাট যুদ্ধ না করিয়াই প্রত্যাবর্তন করিল। রোমান সম্রাটের প্রত্যাবর্তনের পর সিরিয়ার ইহুদী ও খৃষ্টান নেতারা ভীতসন্ত্রস্ত হইল। তাহারা আসিয়া নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিল। নবী করীম (সাঃ) ইহাতেই সন্তুষ্ট হইলেন। এইরূপে দেখিতে দেখিতে হিজরতের নবম বৎসর কাটিয়া গেল। তবে ইহার প্রতিটি বৎসরই ছিল ঘটনাবহুল, যাহা হইতে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা এখানে উল্লেখ করা হইল। অবশেষে দশম হিজরী উপস্থিত হইল। এই হিজরীতেই হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) এর বিদায় হজ্ব। বিদায় হজ্বের পূর্বেই হযরত রাসূলে করীম (সাঃ)-এর পুত্র হযরত ইব্রাহিম মৃত্যুমুখে পতিত হন। এই বৎসর রাসূলে করীম (সাঃ) দিকে দিকে হেদায়েতের দাওয়াত পাঠাইলেন। অবশেষে হিজরীর শেষ প্রায়। জিলক্বদ মাস উপস্থিত হইল। হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) এই মাসের ২৫ তারিখ উম্মতগণের একাংশ লইয়া হজ্ব যাত্রা করিলেন।
মক্কা নগরীতে প্রবেশ করিয়া কা’বার মিনার দেখিতে পাইয়া আল্লাহতায়ালার দরবারে মোনাজাত করিলেন, ‘ইয়া আল্লাহ, এই গৃহকে চিরকল্যাণ ও চিরমহিমায় মন্ডিত কর। যাহারাই এই কাবা শরীফে হজ্ব করিতে আসিবে তাহাদের সুখ-শান্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি কর।’ হযরত (সাঃ) বিশাল জনতার সম্মুখে ভাষণ দান করিলেন। সেই ভাষণ আজও বিদায় হজ্বের ভাষণ নামে কালজয়ী হইয়াছে। এই ভাষণে রাসূলে করীম (সাঃ) ঘোষণা করিলেন, মানুষে মানুষে সাম্যের অধিকার। ঘোষণা করিলেন তওহীদের বাণী। বলিলেন, ‘সাবধান। পৌত্তলিকতার পাপ যেন কোনো দিন তোমাদের স্পর্শ না করে। বলিলেন, চুরি করিও না, ব্যতিচার করিও না, মিথ্যা বলিও না, সর্ব প্রকার মলিনতা হইতে নিজেকে পবিত্র রাখিয়া জীবন যাপন করিতে। সত্যাশ্রয়ী হইতে। বলিলেন, ‘হে উম্মতগণ। তোমাদের নিকট যাহা গচ্ছিত রাখিয়া যাইতেছি তাহা যদি দৃঢ়ভাবে ধারণ কর, তবে কিছুতেই তোমাদের পতন হইবে না- সেই গচ্ছিত সম্পদ হইল কুরআন মজীদ ও আল্লাহতায়ালার রাসূলের সুন্নাত। আবেগে ও আল্লাহতায়ালার প্রতি প্রেমে রাসূলে করীম (সাঃ)-এর মুখমন্ডল জ্যোতির্ময় হইল। তদীয় কণ্ঠস্বর ক্রমেই করুণ ও ভাবগম্ভীর হইল- তিনি আবেগে বলিতে লাগিলেন- হে আল্লাহ! হে আমার প্রভু! আমি কি তোমার বাণী পৌছাইয়া দিতে পারিলাম? আমি কি আমার কর্তব্য সম্পাদন করিতে পারিলাম? লাখ লাখ মুসলমান, যাহারা সেদিন আরাফাতের ময়দানে হজ্ব উপলক্ষে রাসূলে করীম (সাঃ)-এর বাণী শুনিতেছিলেন, বলিয়া উঠিলেন, ‘নিশ্চয়, নিশ্চয়।’ তখন নবী করীম (সাঃ) বলিলেন, প্রভু হে, শ্রবণ কর। সাক্ষী থাক। ইহারা বলিতেছে, আমার কর্তব্য আমি সম্পাদন করিয়াছি। এই সময়ে পাক কুরআনের আয়াত নাযিল হইল ‘হে মুহাম্মদ। আজ আমি তোমার দ্বীনকে পূর্ণ করিলাম এবং তোমার উপর আমার নেয়ামতকে পূর্ণ করিলাম, ইসলামকেই তোমাদের ধর্ম হিসাবে মনোনীত করিলাম।’ (সূরা মায়েদাঃ ৩) ইহার পর রাসূলে করীম (সাঃ) কয়েক মুহূর্ত নীরব রহিলেন।
তাহার পর বলিলেন ‘বিদায় বন্ধুগণ, বিদায় হে বন্ধুগণ।’ বিদায় হজ্বের দিনে হযরত রাসূলে করীম (সাঃ)-এর নিকট যে আয়াত নাযিল হইয়াছিল সেই আয়াত হইতে হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) বুঝিয়াছিলেন যে তদীয় কর্তব্য সমাধা হইয়াছে। আল্লাহপাক পূর্বেই একটি ওহীর মাধ্যমে জানাইয়াছিলেন-’যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসিবে এবং যখন তুমি দলে দলে লোকদিগকে আল্লাহর ধর্ম গ্রহণ করিতে দেখিবে, তখন আল্লাহতায়ালার গুণগান করিও এবং তাহার নিকট ক্ষমা চাহিও, কারণ তিনি তওবা কবুলকারী। (সূরা নছর)।
বিদায় হজ্বের প্রাক্কালে অসংখ্য মানুষকে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করিতে দেখিয়া তিনি বুঝিয়াছিলেন আল্লাহতায়ালার সাহায্য ও বিজয় আসিয়াছে, কাজেই তাহার বিদায়ও ঘনাইয়া আসিয়াছে। বিদায় হজ্ব হইতে ফিরিয়া তিনি ক্রমেই দুর্বল হইয়া পড়েন। সফর মাসে তিনি খুবই অসুস্থ হইয়া পড়িলেন। তাহার উঠিতে বসিতে কষ্ট হইতে লাগিল। তবুও তিনি নামাজে গমন করিতেন। একদিন জুমার নামাজে গমন করিয়া খোল্লার সময়ে কিছুটা খাপছাড়া ভাবে বলিলেন, ‘আল্লাহতায়ালা এক বান্দাকে দুনিয়ার সমস্ত সুখ সম্পদ দান করিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু তাহা সে ত্যাগ করিয়া আল্লাহকেই গ্রহণ করিল।’ কেহই এই কথার অর্থ বুঝিলেন না কিন্তু জ্ঞানবৃদ্ধ আবুবকর (রাঃ) এই কথার তাৎপর্য অনুধাবন করিয়া ক্রন্দন করিতে লাগিলেন। সকলেই হযরত আবুবকরের উপর অসন্তুষ্ট হইলেন। শুধু রাসূলে করীম (সাঃ) বলিলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মধ্য হইতে প্রেম ও ভক্তিতে আবুবকরকে শ্রেষ্ঠ বলিয়া জানি।’
অবশেষে রবিউল আউয়াল মাসের ১১ তারিখ উপস্থিত হইল। এশার নামাজের আজান ধ্বনিত হইল। হযরত অজুর জন্য পানি চাহিলেন। তিনি উঠিতে চাহিলেন কিন্তু পারিলেন না। নামাজ পড়াইবার জন্য হযরত আবুবকর (রাঃ) কে আদেশ দিলেন। হযরত (সাঃ) কে না দেখিয়া সকলে উৎকন্ঠও হইল। অবশেষে দু’জন উন্মতের কন্ধে ভর করিয়া তিনি মসজিদে আসিয়া হযরত আবুবকর (রাঃ) ছাহেবের পাশে বসিয়া নামাজ আদায় করিলেন। দাঁড়াইতে পারিলেন না। সারা রাত্রি তিনি কষ্ট পাইলেন। সকালের দিকে রাসূলে করীম (সাঃ) একটু সুস্থ বোধ করিলেন। তিনি সকলের সহিতই হাসিমুখে কথা বলিলেন। অপরাহ্নে হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) এর অবস্থার হঠাৎ পরিবর্তন হইল। পীড়ার গতি মন্দের দিকে চলিল। সংবাদ শুনিয়া সকল জাহাবী ছুটিয়া আসিলেন। হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) ভীষণ যন্ত্রণা পাইতেছিলেন। এই সময়ে হযরত (সাঃ) একখানি কাগজ চাহিলেন। হযরত উমর (রাঃ) বলিলেন, ‘লিখিত উপদেশের কি প্রয়োজন। ইয়া রাসূলাল্লাহ। আপনি মুখেই বলুন।’ ক্রমে ক্রমে হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) এর দেহ নির্জীব হইয়া আসিল।
তিনি একদৃষ্টে উর্ধ্বাকাশের পানে চাহিয়া রহিলেন, তারপরে মৃদুস্বরে বলিলেন, ‘হে আমার পরম বন্ধু। তোমারই কাছে।’ এই কথা বলিয়া তিনি চুপ হইয়া রহিলেন, আর তনীয় মুখ হইতে কোনো শব্দ বাহির হইল না। পত্নী আয়েশা, দুহিতা ফাতেমা, প্রিয় উম্মত হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ), হযরত উমর (রাঃ), হযরত উসমান (রঃ), হযরত আলী (রাঃ) সহ সহস্র মুসলমান কাঁদিয়া উঠিলেন- আকাশ, বাতাস কাঁদিয়া উঠিল। কেহই বিশ্বাস করিতে পারিলেন না যে নবী করীম (সাঃ) এর ওফাত হইয়াছে।
হযরত উমর ঘোষণা করিলেন, যে কেহ বলিবে যে, নবী করীম (সাঃ) এর ওফাত হইয়াছে, তাহাকে তিনি হত্যা করিবেন। হযরত আবুবকর সিদ্দিকী (রাঃ) তখন হযরত উমরকে বলিলেন, আল্লাহপাক কি কুরআন মজীদে বলেন নাই, নিশ্চয়ই মুহাম্মদ একজন প্রেরিত নবী ভিন্ন ইন্তেকাল করিয়াছেন। এক্ষেত্রে তোমরা কি করিবে? তিনি যদি মারাই যান, তোমরা ফিরিয়া যাইবে? আলে ন্ন আর কিছুই নহেন? নিশ্চয়ই তাহার পূর্ববর্তীগণ ইমরানঃ ১৪৩)
হযরত আবুবকর (রাঃ) বলিলেন, তোমরা যদি মুহাম্মদের অনুসারী হইয়া থাক তবে, জান তিনি ইন্তেকাল করিয়াছেন। আর যদি আল্লাহতে বিশ্বাসী হও তবে জান তিনি অমর। হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ)- এর জবানে কুরআন মজীদের উক্ত আয়াত শ্রবণে উমর সম্বিৎ ফিরিয়া পাইলেন। ইহার পর উমরের প্রস্তাবনায় হযরত আবুবকর (রাঃ) কে নেতা নির্বাচিত করা হইল। হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) পূর্বেই বলিয়াছিলেন, আমার কালবে যে জ্ঞান আল্লাহ আমাকে দান করিয়াছিলেন তাহা আমি আবুবকরের কালবে রক্ষিত করিয়াছি। এক্ষেত্রেও জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই হযরত আবুবকর সিদ্দিক নবী করীম (সাঃ) এর স্থলাভিষিক্ত হইলেন। অবশেষে প্রশ্ন উঠিল, নবী করীম (সাঃ) এর দাফন কোথায় হইবে? হযরত আবু বকর (রাঃ) এ প্রশ্নে মতভেদের সমস্যার সমাধান দিলেন। তিনি বলিলেন, নবী করীম (সাঃ) এর জীবিতকালে বলিতে শুনিয়াছি, পয়গম্বরগণ যেখানে ইন্তেকাল করেন, তাহাদিগকে সেখানেই সমাহিত করা হয়। তাই মা আয়েশার গৃহে, যেখানে তিনি রোগশয্যায় শায়িত ছিলেন ও যেখানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, সেখানেই তাঁহাকে দাফন করা হয়।
হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) মানবজাতির জন্য লইয়া আসিয়াছিলেন অবারিত করুণাধারা- তাহার মধ্যে মানবতার শ্রেষ্ঠত্ব, জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব ও আল্লাহতায়ালার নেয়ামতের পূর্ণতা ছিল- তাহা উপরে তুলিয়া ধরিবার চেষ্টা করা হইয়াছে। তিনি নবুয়ত প্রাপ্তির পর যেমন ইসলামের সত্য ও আল্লাহতায়ালার নৈকট্যের আলোতে জগদ্বাসীকে আলোকিত করিতে চাহিয়াছিলেন, তেমনি দাসপ্রথার উচ্ছেদ করিয়া মানুষে মানুষে সমান অধিকারের বাণী প্রচার করিয়াছিলেন।
তথ্যসূত্র: বিশ্বওলী খাজাবাবা ফরিদপুরী (কু:ছে: আ:) ছাহেবের পবিত্র নসিহত নং ৯৫।
এমএল/