নিরপেক্ষতা না নিঃস্বার্থ সুবিধা, বিতর্কে দুদক পরিচালক


Janobani

বশির হোসেন খান

প্রকাশ: ০৩:০৯ পিএম, ৯ই সেপ্টেম্বর ২০২৫


নিরপেক্ষতা না নিঃস্বার্থ সুবিধা, বিতর্কে দুদক পরিচালক
ছবি: পত্রিকা থেকে নেওয়া।

রাজধানীর একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে বের হওয়া একটি ইনভয়েস ও হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ নথি ঘিরে আলোচনায় উঠে এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একজন পরিচালকের নাম। বিষয়টি শুধু একটি বিল পরিশোধের ঘটনাই নয়, বরং তা রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতা, নৈতিকতা ও দুর্নীতি দমনের বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে। 

 

জানা গেছে, দুদকের পরিচালক হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন  খান মো. মিজানুল ইসলাম। তিনি কমিশনের বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-২ বিভাগে কর্মরত। এই বিভাগের অধীনেই রয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিভিল এভিয়েশন) এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এর মতো স্পর্শকাতর খাতের দুর্নীতি অনুসন্ধানের দায়িত্ব।  


চিকিৎসার প্রয়োজনে তিনি গত ১৭ আগস্ট রাজধানীর গুলশানস্থ এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে তিন রাত চিকিৎসা শেষে ২০ আগস্ট তাকে ছাড়পত্র (ডিসচার্জ) দেওয়া হয়। হাসপাতালের নথি অনুযায়ী, তার মোট বিল দাঁড়ায় ৪ লাখ ৩৪ হাজার ১৩১ টাকা। ভর্তি হওয়ার সময় মাত্র ৩০ হাজার টাকা ডিপোজিট করেছিলেন তিনি।  


হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ ইলেকট্রনিক লগে দেখা যায়, ২০ আগস্ট সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে রোগীর পক্ষ থেকে জানানো হয় ‘অ্যাটেন্ডেড উইল ডিপোজিট টুডে’। বিষয়টি নথিভুক্ত করেন হাসপাতালের কর্মকর্তা গৌতম রায়। তবে একই দিন বিকেল ৫টা ২৭ মিনিটে অন্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ হান্নান একটি এন্ট্রি করেন, যেখানে উল্লেখ থাকে- ‘অ্যাজ পার ইনস্ট্রাকশন বাই ডিরেক্টর মাহবুবুল আনাম স্যার, দ্য উইল বি ক্রেডিটেড আন্ডার হিম। কনফার্মড বাই ডিউটি ম্যানেজার  মাসুম’।


এখানে উঠে আসে নতুন এক নাম মাহবুবুল আনাম। তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক এবং অতীতে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের জন্য কাজ করা একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক। অর্থাৎ যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালানোর দায়িত্ব দুর্নীতি দমন কমিশনের, তাদের সঙ্গেই এই আর্থিক লেনদেনের যোগসূত্র তৈরি হয়েছে।


এছাড়া ৫টা ৩৯ মিনিটে হাসপাতালের আরেক কর্মকর্তা আল মামুন অর রশিদ লগ করেন ‘প্লিজ অ্যালাও স্পেশাল ফাইভ পারসেন্ট ডিসকাউন্ট অ্যাপ্রুভড বাই সিইও’। আর মাত্র দুই মিনিট পর, অর্থাৎ ৫টা ৪১ মিনিটে খান মো. মিজানুল ইসলামের ডিসচার্জের সময় চূড়ান্ত করা হয়।


এই ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে প্রশ্ন ওঠে  কে বিল মিটিয়েছে, কীভাবে ছাড় দেওয়া হলো, আর কেনই বা এমন সময়ে বিশেষ ছাড় অনুমোদিত হলো, যখন বিল পরিশোধের দায়িত্ব একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি গ্রহণ করছেন বলে নথিতে উল্লেখ রয়েছে।


একজন দুদক পরিচালক যদি এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহযোগিতা নেন, যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে, তাহলে তা কি নৈতিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সাধারণভাবে রাষ্ট্রীয় পদে কর্মরত কোনো কর্মকর্তার কাছেই জনগণের প্রত্যাশা থাকে তিনি নিজের অবস্থান ব্যবহার করে কোনো প্রকার সুবিধা নেবেন না। বিশেষত, তিনি যদি দুর্নীতি দমনের দায়িত্বে থাকেন, তাহলে এ ধরনের অভিযোগ আরও গুরুতর হয়ে ওঠে। দুদক হলো এমন একটি সংস্থা, যা রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি প্রতিরোধে জনগণের আস্থা ধরে রাখতে কাজ করে। এর কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যদি সুবিধা গ্রহণ বা প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগ ওঠে, তাহলে প্রতিষ্ঠানটির বিশ্বাসযোগ্যতা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। 

 

এ বিষয়ে  খান মো. মিজানুল ইসলাম অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, তার হয়ে বিল মিটিয়েছেন তার বন্ধু সাইফুল। তিনি বলেন,, সাইফুল এভারকেয়ার হাসপাতালের পাশেই থাকেন এবং এ হাসপাতালের পূর্ববর্তী পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমার দেওয়া টাকাই তিনি হাসপাতালের কাছে জমা দিয়েছেন।


অর্থাৎ, তার দাবি মাহবুবুল আনামের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তবে হাসপাতালের নথিতে মাহবুবুল আনামের নাম উঠে আসায় বিষয়টি আরও জটিল হয়ে পড়েছে। 


মাহবুবুল আনামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, তখন তিনি এমন জায়গায় ছিলেন যেখানে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তিনি দুই মিনিট পর কলব্যাক করবেন বলে জানান। তবে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করার পরও তিনি আর ফোনে ফিরে আসেননি। ফলে তার অবস্থান পরিষ্কার হয়নি।  যদি সত্যিই বন্ধু সাইফুল বিল মিটিয়ে থাকেন, তবে হাসপাতালের নথিতে মাহবুবুল আনামের নাম কেন এলো। এভারকেয়ারের সিইও কেন এবং কীভাবে ৫ শতাংশ বিশেষ ছাড় অনুমোদন করলেন?


একজন দুদক কর্মকর্তার চিকিৎসা খরচে অন্যের অর্থ ব্যবহার করাটা কি নৈতিকতার দিক থেকে গ্রহণযোগ্য? যে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালানোর দায়িত্ব তার বিভাগে, সেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত কোনো পরিচালক বা ঠিকাদারের নাম কেন ইনভয়েস লেনদেনে আসবে? এই প্রশ্নগুলো কেবল একটি ব্যক্তির আচরণ নিয়ে নয়, বরং পুরো ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি করছে।  


বাংলাদেশের সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য পরিষ্কার নীতিমালা রয়েছে তারা কোনোভাবেই অঘোষিত আর্থিক সুবিধা নিতে পারবেন না। এমনকি উপহার বা আতিথেয়তার ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট সীমারেখা নির্ধারিত। এসব নীতি ভঙ্গ করলে তা ‘অসদাচরণ’ হিসেবে গণ্য হয় এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে।  


দুদকের কর্মকর্তারা যেহেতু দুর্নীতি দমনের দায়িত্বে, তাই তাদের ক্ষেত্রে নৈতিক মানদণ্ড আরও উচ্চ হওয়া উচিত। যদি তারা নিজেরাই প্রশ্নবিদ্ধ হন, তাহলে পুরো প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়।  


দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মতো সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠলে সেটিকে হালকা ভাবে নেওয়া উচিত নয় এমনটাই মনে করেন প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, শুধু অভিযুক্ত কর্মকর্তার ব্যাখ্যা শুনে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হলে, সাধারণ মানুষের মধ্যে দুদকের প্রতি আস্থার সংকট আরও গভীর হবে।


প্রশাসন বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. রাশেদুল হাসান বলেন, দুদক একটি অনুসন্ধান ও তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান। এর কর্মকর্তারা যদি নিজেরাই অনৈতিক সুবিধা গ্রহণে জড়িত হন, তবে এটি শুধু ব্যক্তিগত নয় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা হিসেবেও বিবেচিত হবে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।


অবসরপ্রাপ্ত  জেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা মো. শামসুল হক বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান জনগণের করের টাকায় পরিচালিত হয়, তাদের কর্মকর্তারা যদি সেই সুবিধার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে অনৈতিক সুযোগ গ্রহণ করেন, তবে তা শুধু তার ব্যক্তিগত আচরণ নয় সেই প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ নৈতিক কাঠামোকেই দুর্বল করে। এই ধরনের অভিযোগ এলে নিরপেক্ষ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রয়োজন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিলে, শুধু দুদক নয়, বরং দেশের গোটা দুর্নীতি দমন প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।


দুদকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সানাউল হক বলেন,  হাসপাতালের নথি, আর্থিক লেনদেনের কাগজপত্র, এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য যাচাই করলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে প্রকৃত ঘটনা কী।  জনগণ চায় যারা দুর্নীতি দমনের দায়িত্বে, তারা যেন নিজেরাই দুর্নীতির সঙ্গে আপস না করেন। আর যদি কেউ নৈতিকতা লঙ্ঘন করেন, তবে তার বিরুদ্ধে যেন সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই ঘটনা প্রমাণ করে, দুর্নীতি কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিকও। একজন দুদক পরিচালক যদি প্রশ্নবিদ্ধ হন, তাহলে তা গোটা সংস্থার ভাবমূর্তিতে আঘাত হানে। তাই প্রয়োজন নিরপেক্ষ তদন্ত, কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।



আরএক্স/