একটি পাঠাগার এবং বইয়ের গ্রামে পরিণত হওয়া উপকূলের এই জনপদ


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


একটি পাঠাগার এবং বইয়ের গ্রামে পরিণত হওয়া উপকূলের এই জনপদ

গ্রামের নাম খুদুকখালী। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় সাড়ে ৫২ কিলোমিটার দুরত্বে এই গ্রামের অবস্থান। বঙ্গোপসাগরের তীরঘেষে বয়ে যাওয়া এই গ্রাম বাঁশখালী উপজেলার উপকূলীয় ছনুয়া ইউনিয়নের এক অনুন্নত জনপদ। এই গ্রামকে এখন সবাই বইয়ের গ্রাম বলে ডাকে। গ্রামের মাঝখানে আজ থেকে ১২ বছর আগে গড়ে উঠা এক গণপাঠাগার পুরো গ্রামের তিন শতাধিক পরিবারের ছেলে মেয়েকে বইয়ের সানিধ্যে নিয়ে এসে সৃষ্টি করেছে নতুনত্ব। পাঠাগারের বই ছাড়া এই গ্রামের কোন পরিবার খোঁজে পাওয়া যাবেনা। গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা গণপাঠাগারের সদস্য। প্রতিদিন দুপরের পর গ্রামে ছেলে মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে পাঠাগারে আসেন। পাঠাগারে বসে সবাই স্বাধীনভাবে পছন্দের বই পড়েন। অধিকাংশ সদস্য বাড়িতে বই নিয়ে যান। অবসর সময়ে বাড়িতে বসে বই পড়েন।  পুরো গ্রামের তরুণ প্রজন্মকে বইয়ের ছায়াতলে নিয়ে এসেছে এই পাঠাগার। প্রান্তিক জনপদে জ্ঞানের আলোর দ্যুতি ছড়ানো গণপাঠাগারটি হচ্ছে উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরী। এটি বর্তমানে উপকূলের বাতিঘর হিসেবে ব্যাপক সমাদৃত।

জানা যায়, ২০১০ সালে গ্রামের এক স্বপ্নবাজ তরুণ প্রতিষ্ঠা করেন এই গণপাঠাগার। পরিত্যক্ত এক সাইক্লোন শেল্টার থেকে  ক্ষুদ্্র পরিসরে এই গণপাঠাগারের যাত্রা শুরু হয়। গত ১২ বছরের কঠোর পরিশ্রমের ফলে এটি এখন স্বনামধন্য এক আলোকিত পাঠাগারে পরিণত হয়েছে। পাঠাগারের নামে ক্রয়কৃত ২২ শতক জমির উপর গড়ে উঠা পাঠাগার পুরো জনপদকে করেছে বইয়ের আলোয় আলোকিত। এই পাঠাগারের বদৌলতে খুদুকখালী হয়ে উঠেছে বইয়ের জনপদ। গ্রামের শতশত তরুণ- তরুনী এখন বইয়ের সানিধ্যে চলে এসেছে। 

পাঠাগারের সদস্য রফিকুল ইসলাম জানান, আমরা পাঠাগারে আসার  আগে পাঠ্যবই ছাড়া তেমন কোন বই দেখার সুযোগ পাইনি। কিন্তু আমাদের গ্রামে পাঠাগার স্থাপনের ফলে এখন আমরা অনেক বই দেখতে পাই , অনেক বই পড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমরা পাঠাগার থেকে  পছন্দের বইটি বাড়িতে নিয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছি। 
লাইব্রেরীর নারী পাঠক সদস্য তাহমিনা জানান, এই গ্রন্থাগার আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। আমাদের বিবেক খুলে দিয়েছে। এই পাঠাগারের মাধ্যমে আমরা বিশাল জ্ঞানরাজ্যে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়েছি। এই নারী পাঠক আরও জানান, এই পাঠাগার আমাদের জন্য এখন স্বপ্ন জাগানোর ঠিকানা। 

গ্রন্থাগারের আরেকজন পাঠক উম্মে হাবিবা বলেন, আমরা প্রান্তিক জনপদের মানুষ। আমরা পাঠ্যবই ছাড়া সহসা অন্য বইয়ের দেখা পাইনা। দেখার সুযোগও নাই। কিন্তু এখন এসব আমাদের জন্য একেবারে সহজ করে দিয়েছে আমাদের গ্রামের পাঠাগারটি। শহরের মত আমরা গ্রামের এই পাঠাগারের সানিধ্যে এসে বই পড়ার সুযোগ পাচ্ছি। আমরা এখন হাজারো বইয়ের মাঝখানে বসে বই পড়ার সুযোগ লাভ করেছি। 

জানা যায়, বর্তমানে এই গ্রন্থাগারে বইয়ের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার। সদস্য সংখ্যা তিন শতাধিক। প্রতিদিন ২ টা  সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত পাঠাগারটি পাঠকের জন্য উন্মুক্ত থাকে। পাঠাগারে দুজন কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন।  পাঠাগার চালু হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে গ্রামে ছেলে মেয়েদের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে উঠে। গ্রামের শিক্ষার্থীরা বইমুখী হতে শুরু করে। বর্তমানে খুদুকখালী গ্রামের তরুণ সমাজের মধ্যে  বইপাঠের গুরুত্ব ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। শহর থেকে প্রায় অর্ধশত কিলোমিটারের দুরে বাস করা এই গ্রামের ছেলে মেয়েরা এখন মেধায় মননে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। তাদের চিন্তা চেতনায় সৃজনশীল মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। 

'অন্ধকারে আলোর প্রদীপ' এই  স্লোগানকে ধারণ করে শুরু হয়েছিল পাঠাগার প্রতিষ্ঠার কাজ। শুরুর জার্নিটা ছিল অন্যরকম। শুরুর শুরুতে বইপাঠের অভ্যাস, বইয়ের আলো পৌঁছানো ছিল রীতিমতো দুঃসাধ্য। কিন্তু আলো ফোটানোর মিশন থেকে ছিটকে পড়েননি পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা সাঈফী আনোয়ারুল আজীম। তিনি জয় করলেন। দীর্ঘ ত্যাগের পর অজপাড়া গায়ে অন্ধকারে আলো ছড়িয়ে দিলেন। সে আলোর আলোয় উদ্ভাসিত আজ খুদুকখালী গ্রাম। গ্রামের প্রতিটি পরিবার আজ জ্ঞানের আলোয় আলোকিত।

গ্রামের এই পাঠাগারে নিয়মিত পালন করা করা হয় সরকার ঘোষিত দিবস সমূহ। এছাড়া শিক্ষা, সাহিত্য এবং সমসাময়িক বিষয় নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন সভা সেমিনার। এসব সভা সেমিনারে বড় বড় শিক্ষাবিদরা অংশ গ্রহণ করেন। তারা অনুষ্ঠানে এসে পাঠকের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। তারা বক্তব্যের মাধ্যমে পাঠকদেরকে আলোর পথ দেখান। ভবিষ্যত গড়ার স্বপ্ন দেখান। তারা গ্রামের কোমলমতি শিশু কিশোরদেরকে বুঝিয়ে দেন, অধ্যবসায় ছাড়া সফলতা আসবেনা। জীবনে বড় হতে হলে বেশি বেশি পড়তে হবে। পড়ারা কোন বিকল্প নেই। 
 
এই গ্রামের মানুষ এখন বুঝতে পেরেছে,  হাসপাতালের  চেয়েও লাইব্রেরির গুরুত্ব কম নয়, প্রমথ চৌধুরীর এ কথা উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরী এই জনপদের প্রতিটি মানুষকে আলো দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন।  গ্রামে অনেক চ্যালেঞ্জিং বিষয় থাকে। গ্রামে শিক্ষার আলো পৌঁছালেও পাঠাগার শিক্ষার আলো পৌঁছাতে পারেনি, এটা নিরেট সত্য কথা। কারণ গ্রামের মানুষ খেটে-খাওয়া মানুষ। তারা সার্টিফিকেট শিক্ষার গুরুত্ব বোঝে।  সে জায়গায় লাইব্রেরির সার্থকতা বোঝার মানুষ খুব কম। কিন্তু সেখানে ব্যতিক্রম উপকূলের এ্ই গণপাঠাগার।  

লাইব্রেরীর প্রতিষ্ঠাতা সাইফী আনোয়ারুল আজিমের  পেছনের গল্প অনেক কণ্টকাকীর্ণ। সে পথ অনেক দুরধিগম্য। কিন্তু তিনি পাঠকের সহযোগিতায় সব জয় করে নিয়েছেন খুব সুন্দরভাবেই। বইপাঠের সুন্দর অভ্যাস দিয়ে তিনি  যেভাবে বাধা বিপত্তি মোকাবিলা করছেন সেসব দেখে অন্যরা সাহস পায়। স্বপ্ন দেখে।। 

লাইব্রেরীর সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম আল হাবিব জানান, উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরী এখানকার উপকূল এলাকার জন্য একটি আলোকিত বাতিঘর। গ্রামের সব শিক্ষার্থী , শিক্ষক ও বইপ্রেমী মানুষের জন্য এটি জ্ঞানার্জনের জন্য একটি নিরিবিলি প্রতিষ্ঠান। জাহাঙ্গীর আলম আরও জানান, পাঠকের তুলনায় গ্রন্থাগারে এখনো বইয়ের সংখ্যা কম। তিনি আরো বলেন, অন্য দশটি গ্রন্থাগারের চেয়ে আমাদের গ্রন্থাগারে পাঠকের উপস্থিতি অনেক বেশি। তবে চাহিদার তুলনায় বই কম।  

লাইব্রেরীর নামে ক্রয়কৃত প্রায় ২২ শতক জমির জমির ওপর নির্মিত এ পাঠাগারে রয়েছে তিন হাজারেরও অধিক বই। ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ , ধর্মীয়, সাহিত্য ও বিজ্ঞানসম্মত এসব বই দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রহ করে আসছে লাইব্রেরী কর্তৃপক্ষ। আর এসব বই সংগ্রহের পিছনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে  দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত লেখক, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যানুরাগীরা।  

বর্তমানে লাইব্রেরীতে রয়েছে ১২টি বুক সেলফ। ৮ টেবিল ও ৭০টি চেয়ার। এসব আসবাবপত্র দিয়ে  সেখানেই গাদাগাদি করে সাজানো হয়েছে সব বই। তাই পছন্দের বই খুঁজে পেতে একটু বেগ পেতে হয় পাঠক মহলের। লাইব্রেরীতে নিয়মিত পত্রিকা পড়ারও ব্যবস্থা আছে। প্রতিদিন জাতীয়-স্থানীয় তিনটি পত্রিকা রাখা হয়। এর ফলে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থী ও পাঠকরা খুব সহজেই দেশ-বিদেশের খবরাখবর পেয়ে থাকে। 
লাইব্রেরীর প্রশাসনিক কর্মকর্তা সারজিনা মনি ও মিতু আকতার জানান, এই গ্রন্থাগার এলাকার শত শত শিক্ষার্থীকে বইমুখী করেছে। বইয়ের সানিধ্যে নিয়ে এসেছে। তারা জানান, এটি আমাদের এলাকার জন্য একটি গর্বিত প্রতিষ্ঠান, আমাদের এলাকার জন্য আলোকবর্তিকা। 

পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা সাঈফী আনোয়ারুল আজিম জানান, অন্ধকারে আলোর প্রদীপ এই শ্লোগানকে ধারণ করে ২০১০ সালে এলাকার স্থানীয় একটি সাইক্লোন সেল্টারে চারটি চেয়ার একটি টেবিল আর একটি বুক সেলফ নিয়ে লাইব্রেরীর কার্যক্রম করি। শুরুটা ছিল অনেক কষ্টের। ছিল অনেক বাধা বিপত্তি। তবে পাঠাগার প্রতিষ্ঠার অদম্য ইচ্ছা থেকে থেমে থাকিনি। তিনি বলেন, দীর্ঘ ১২ বছরের দীর্ঘ পরিশ্রমের ফলে আজ এই গণপাঠাগার একটি আলোকিত পাঠাগারে পরিণত হয়েছে এবং অজপাড়া গায়ের শতশত শিক্ষার্থীকে বইয়ের সানিধ্যে নিয়ে এসেছে। 

এসএ/