সম্রাটের বিকল্প কেবল সম্রাটই!


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


সম্রাটের বিকল্প কেবল সম্রাটই!

তিন-চার দিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ঘাটাঘাটির সময় সামনে আসে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে ২০১৯ সালে প্রচারিত সংবাদের ভিডিও ক্লিপ। মিনিট তিনেকের ওই প্রতিবেদনটি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটকে নিয়ে। তখন তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি। সংবাদের সারাংশ হচ্ছে- ১১ মাস ধরে প্রত্যেক রাতে দেড় হাজারের বেশি অসহায় দরিদ্র মানুষের মাঝে নিজেদের রান্না করা খাবার বিতরণ করে আসছিল দক্ষিণ যুবলীগ। যে আয়োজন ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের সরাসরি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়। দীর্ঘ ৩২ মাস কারাবাসের পর গত ১০ মে জামিনে কারামুক্ত হন সম্রাট। হয়তো তার মুক্তির বিষয়ে গণমাধ্যম-সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হওয়ার কারণেই তিন বছর আগের প্রতিবেদনের ভিডিওটি ফেসবুকের অটোমেটিক সিস্টেমের মাধ্যমে আবারো সামনে এসেছে।

সম্রাট কি কারণে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, কোন অভিযোগে কয়টি মামলা হয়েছে- এ সবই সবার জানা। তবে একটি প্রশ্নের উত্তর হয়তো কেউ জানেও না, জানার চেষ্টাও করেনি। যেই দেড় সহস্রাধিক মানুষ প্রতিদিন সম্রাটের উদ্যোগে রান্না করা খাবার খেতে যেতেন, তার গ্রেপ্তারের পর সেই অসহায়দের মধ্যে একজন মানুষের এক বেলা খাবারের দায়িত্বও কি কেউ নিয়েছিলেন? সম্রাট ছিলেন না বলে তারা না খেয়ে ছিলেন, নিশ্চয়ই এমনটা ঘটেনি। তবে তাদের মধ্যে যে নিশ্চয়তা ছিল, রাতের খাবার তো কাকরাইল মোড়ে যুবলীগের অফিসের সামনে গেলেই জুটে যাবে- এই ভরসার জায়গাটা কি আর তৈরি করতে পেরেছে? না, পারেনি।

বাস্তবতার হিসেব কষলে- যেকোন সরকারের সময়েই ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি করা নেতারা কম-বেশি সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন, অর্থ উপার্জনের নানাবিধ মাধ্যম তৈরি হয় বা তৈরি করে নেন। রাজধানী ঢাকার মত শহরের একাংশের যুবনেতা হয়ে সম্রাটও সেই ধারাবাহিকতার বাইরে যাননি। সরকারি দলের লোক হিসেবে বিভিন্ন দপ্তরের উন্নয়ন কাজে বাড়তি সুবিধা পেয়েছেন। বিভিন্নভাবে উপার্জন করেছেন, আবার খরচ করেছেন সাংগঠনিক কাজে। যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটকে উপাধি দিয়েছিলেন সেরা সংগঠকের। দলীয় কর্মসূচী হোক কিংবা বিরোধীদের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা, সবখানেই সম্রাট নেতৃত্ব-নির্দেশনা ছিল সাফল্যমন্ডিত। তার কর্মকাণ্ডের ফসল হিসেবে ঢাকা দক্ষিণাংশে ছিল আওয়ামী লীগের জয়জয়কার। আর সম্রাটের বিকল্প যে একমাত্র সম্রাটই, নেতা-কর্মীদের উপর তার অভিভাবকত্বের অবস্থান নেওয়ার মত নেতা যে আর তৈরি হয়নি- তা সম্রাট কারাগারে থাকাকালেই প্রমাণ হয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতির পরিচয় তিনি ছাপিয়ে আরো উচ্চতায় গিয়েছিলেন নিজের সাংগঠনিক দক্ষতা ও সাহসী নেতৃত্বগুণে। হয়ে উঠেছিলেন ঢাকা মহানগরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির অন্যতম ‘প্রাণভোমরা’ এবং দলীয় নেতা-কর্মীদের আবেগ-ভালোবাসার ‘মধ্যমণি’।

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সম্রাট। দলীয় বিভিন্ন মহল বলে থাকেন, গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ঢাকা মহানগরীতে আওয়ামী লীগের সর্বাধিক প্রভাবশালী নেতা। অন্যরা যখন দুর্নীতি করেন বা দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে যুক্ত হন, তখন তারা দলেও নি:সঙ্গ হয়ে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হন। তৃণমূলের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়ে, হারিয়ে যান রাজনীতি থেকে। তবে ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ঠিক যেন বিপরীত এক ‘রাজনৈতিক চরিত্র’। কারণ, আওয়ামী লীগের ঘোর দু:সময়েও অন্যতম কান্ডারি ছিলেন সম্রাটই।

দুই দশক পেছনের প্রেক্ষাপটে গেলে দেখা যায়, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট আলোচনায় আসেন। ওই সময়ে ঢাকা মহানগরীতে বিপর্যস্ত ও চাপের মুখে থাকা আওয়ামী লীগকে শক্ত হাতে সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন সম্মুখে থেকে। ‘কর্মীবান্ধব’ মনোভাবের কারণে দ্রুতই তৃণমূলের সঙ্গে তার আত্মার সম্পর্ক হয়ে উঠে। নিজে বিভিন্নভাবে যে উপার্জন করেছেন, সেই উপার্জনের অর্থ বেশিরভাগই তিনি ব্যয় করেছেন সংগঠন আর নেতা-কর্মীদের পেছনে। কর্মীদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করার কারণে তিনি দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার যখন ক্ষমতা ছাড়ে তখন পল্টন এলাকায় বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সহিংসতা ঘটে। সেই সময় বিএনপি-জামায়াতের পরিকল্পনা ছিল আওয়ামী লীগ অফিস জ্বালিয়ে দেওয়া। কিন্তু ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটসহ আরও কয়েকজন নেতা সেদিন জীবন বাজি রেখে তাদের সহিংসতা প্রতিহত করেছিল। না হলে আওয়ামী লীগের ঢাকায় অস্তিত্ব কতটুকু থাকতো সেটি নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গণে নানা রকম আলোচনা রয়েছে।

২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন আসার পর বঙ্গবন্ধুকন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হলে ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। শেখ হাসিনার পক্ষে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। শেখ হাসিনা মুক্তি আন্দোলনেও রাখেন বিশেষ ভূমিকা। ক্রমশ রাজনীতিতে নিজের সুসংহত অবস্থান গড়ে তুলেন। দলটির বড় বড় নেতারাও তার ওপর যেমন আস্থা রাখেন তেমনি নির্ভরশীলও হয়ে পড়েন।

আওয়ামী লীগের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত থাকা সম্রাটের ভাগ্যে এমন অন্ধকার সময় নেমে আসবে সেটি কশ্মিনকালেও ভাবতে পারেনি কেউই। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন করে। ক্ষমতায় আসার পরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করে বলেন, দুর্নীতিবাজ যেই হোক না কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই প্রক্রিয়ায় ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। গ্রেপ্তারের আগেই অবশ্য তাকে দল বহিষ্কার করেছিল। 

দীর্ঘ আড়াই বছরের বেশি সময় পর সম্রাট জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া চারটি মামলায় জামিন পাওয়া নিয়ে জোর আলোচনা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গণে। কারণ, সময়টা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। দলগুলোর দরজায় কড়া নাড়ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আবার সামনেই আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল। জনপ্রিয়তা অর্জন এবং শক্তি প্রদর্শন, দুটোই প্রভাব ফেলে নির্বাচনের ওপর। অপরদিকে, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে নানা অপতৎপরতায় লিপ্ত বিএনপি।

জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যে মুক্তি পাওয়া ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের রাজনীতির মাঠে ভূমিকা কি হবে? মনে-প্রাণে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করা সম্রাট কী কর্মীবান্ধব নেতা হিসেবে স্বরূপে ফিরবেন? নাকি আওয়ামী লীগের দু:সময়ের হাল ধরা এই নেতা রাজনীতির মাঠ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবেন? যুবলীগের রাজনীতিতে কি আর তাকে দেখা যাবে, নাকি আগামী সম্মেলনে আওয়ামী লীগে জায়গা হবে তার? এসব প্রশ্ন এখন ঢাকার রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক ঘুরপাক খাচ্ছে। সময়ের ব্যবধানে সামনে আসবে এসব প্রশ্নের উত্তর।

লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক জনবাণী

এসএ/