আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ভাষা ও সংস্কৃতিতে অমর থাকবেন
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
বাঙালির জাতির যেসব শ্রেষ্ঠ সন্তান এ যাবত সময়ে পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হয়েছেন তাদের মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রিয় মানুষ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী অন্যতম। তিনি গত বুধবার ১৮ মে ২০২২ খ্রি. লন্ডনের বার্নেট হাসপাতালে ভোর ৬টা ৪৫ মিনিটে ইন্তেকাল করেন। (ইন্না .... রাজিউন) মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ৮৮ বছর। বাঙালির মহান ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা যুগের এক বজ্রকণ্ঠ, সত্যাদর্শী শব্দবিন্যাসী, স্পষ্টভাষী, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার আপোষহীন চেতনাধারক, কলম সৈনিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তাঁর একুশের অমর গান বাঙালি জাতিকে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তির আন্দেলনে অসীম সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছিল। ভাষার জন্য বাঙালির রক্তদানের স্মৃতি পড়ানো একুশের জ্ঞানের রচয়িতা, সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। ‘আমার ভাইয়ের রক্তের রাঙানো একুশের ফেব্রুয়ারিÑআমি কি ভূলিতে পারি।’ একুশের অমর এই গানই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে চিরকাল। রক্তে কেনা বাংলাদেশ যতোদিন দুনিয়ার বুকে থাকবে, যতোদিন আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসে সারাবিশ^ব্যাপী পালিত হবে। ততোদিন থাকবে ‘আমার ভাইয়ের রক্তের রাঙানো’ গানটি আর গানটির স্রষ্টা হিসেবে উচ্চারিত হবে আবদুর গাফ্ফার চৌধুরীর নাম। নানামাত্রিক প্রতিভায় নিজেকে বিকশিত করেছিলেন এ অমর মানুষটি।
১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর তার জন্ম বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ থানার উলানিয়া গ্রামে। তার মায়ের নাম জোহরা খাতুন, বাবা ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী। তার বাবা ছিলেন রাজনীতি সচেতন এবং ব্রিটিশ শাসিত ভারতের কংগ্রেস নেতা। গাফফার চৌধুরীর পিতা ওয়াহেদ চৌধুরী বরিশাল জেলা কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সদস্য ছিলেন অল ইন্ডিয়া কংগ্রেম ওয়ার্কিং কমিটির। ১৯৪২ সালের আগস্ট আন্দোলনের সময় ওয়াহেদ চৌধুরীকে জেলে যেতে হয়। কংগ্রেস নেতা মতিলাল নেহেরুর সেক্রেটারি হিসেবেও ওয়াহেদ চৌধুরী কাজ করেছেন। ওয়াহেদ চৌধুরী ১৯৬৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ওয়াহেদ চৌধুরীর সুযোগ্য পুত্র আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে বিএ অনার্স পাস করেন। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর পিতা মারা যাওয়ার পর অভাব অনটনের কারণে তিনি বরিশাল চলে আসেন সেই থেকে তিনি উপার্জেনের পথ খুঁজতে থাকেন। ১৯৪৭ সালে তিনি কংগ্রেস নেতা দুর্গামোহন সেন সম্পাদিত ‘কংগ্রেস হিতৈষী’ পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে ‘সওগাত’ পত্রিকায় তার লেখা প্রথম গল্প ছাপা হয়। তারপর তিনি সাংবাদিকতা করেছেন ঢাকার বিভিন্ন পত্রিকায়। ১৯৫৩ সালে মোহাম্মদ নাসির উদ্দীনের ‘মাসিক সওগাত’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। এ সময় তিনি ‘মাসিক নকীব’ও সম্পাদনা করেন। একই বছর তিনি আবদুল কাদির সম্পাদিত ‘দিলরুবা’ পত্রিকার ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। ১৯৫৬ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৫৮ সালে জনাব আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার রাজনৈতিক পত্রিকা ‘চাবুক’র সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান।
সামরিক শাসন জারির পর ‘চাবুক’ বন্ধ হয়ে যায়। পরে তিনি মাওলানা আকরাম খাঁর ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। এ সময় তিনি মাসিক ‘মোহাম্মদী’র ও খ-কালীন সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬২ সালে জনাব আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী দৈনিক ‘জেহাদ’ এ বার্তা সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে তিনি সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’র সম্পাদক হন। ১৯৬৪ সালে সাংবাদিকতা ছেড়ে ছাপাখানার ব্যবসায় নামেন এবং ‘অনুপম মুদ্রণ’ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। দুই বছর পর পুনরায় সাংবাদিকতায় ফিরে আসেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু’র ৬ দফা আন্দোলনের ‘মুখপত্র’ হিসেবে ‘দৈনিক আওয়াজ’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। এ পত্রিকাটি দু’বছরের মত চালু ছিল। ১৯৬৭ সালে তিনি ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় ফিরে যান সহকারী সম্পাদক হিসেবে। ১৯৬৯ সালে দৈনিক আজাদের মালিকানা নিয়ে সহিংস বিবাদ শুরু হলে জনাব আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ‘দৈনিক ইত্তেফাকে’ যোগ দেন। ১৯৬৯ সালের ১ জানুয়ারি ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া মারা গেলে গাফ্ফার চৌধুরী আগস্ট মাসে হামিদুল হক চৌধুরী ‘অবজারভার গ্রুপের দৈনিক ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকায় যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ‘জয় বাংলা’ ‘যুগান্তর’ ও আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজ করেন। আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় রচনা করেন। প্রথমে তিনি নিজেই গানটিতে সুর করেছিলেন। পরে শহীদ আলতাফ মাহমুদ এ গানের সুরারোপ করেন এবং এ সুরেই এখন গানটি গাওয়া হয়। বিবিসি বাংলা বিভাগের দর্শকদের জরিপে এই গান বাংলা গানের ইতিহাসে তৃতীয় সেরা গানের মর্যাদা পেয়েছে। অমর সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর স্ত্রী অসুস্থ হলে তার চিকিৎসার জন্য স্ত্রীকে নিয়ে ১৯৭৪ সালের ৫ অক্টোবর সপরিবারে লন্ডন চলে যান। সেই লন্ডনে তিনি ‘নতুন দিন’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিষ্ঠুর হত্যাকােন্ডের পর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী হাতে কলম তুলে নেন। ১৯৭৬ সালে লন্ডন থেকে ‘বাংলার ডাক’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন। এ পত্রিকা ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকােন্ডর প্রতিবাদের প্রথম সংবাদপত্র। এম.আর. আখতার মুকুল, আবদুল মতিনও এ পত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের স্ত্রী লায়লা চৌধুরী হাসিও এ পত্রিকায় কাজ করতেন। ‘বাংলার ডাক’ পত্রিকায় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী প্রথম লিখেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আসল খুনি জিয়াউর রহমান’। বছর দুই প্রকাশের পর অর্থাভাবে ‘বাংলার ডাক’ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ‘প্রবাসী’ নামে আরেকটি পত্রিকা বের করেন গাফ্ফার চৌধুরী। সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীও তখন লন্ডন ছিলেন তিনি ‘প্রবাসী’ পত্রিকার অফিসে যেতেন। এরপর প্রকাশিত হয় ‘নতুন দিন’। এ পত্রিকার ১০ জন মালিকের মধ্যে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও তারা মিয়াও ছিলেন। এ পত্রিকার জন্য স্টার অব বোম্বে নামে এক রেস্টুরেন্টের অধিকারী অর্থের ব্যবস্থা করে দেন ব্যাংক থেকে। ব্রিক লেনে ‘নতুন দিনের’ অফিস ছিল। ১৯৭৫ সালের পর অনেক দিন ঢাকার পত্রিকাগুলো আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা প্রকাশ করত না। সে সময় লন্ডনে জীবনধারণের জন্য আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও এম.আর. আখতারমুকুল রেষ্টুরেন্টে কাজ করেছেন। এমনকি অর্থের অভাবে স্টার ক্যাল অ্যান্ড ক্যাটির নামে এক প্রতিষ্ঠানে এ দুইজন মাছ কাটার কাজও করেছেন কিছু দিন। এই কিংবদন্তী সাংবাদিক স্বাধীনতার আগেই সংবাদপত্রে ইতিহাস গড়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য লড়েছেন এই সাংবাদিক। তিনি বঙ্গবন্ধু’র আদর্শ বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমৃত্যু লড়েগেছেন।
এই কিংবদন্তী সাংবাদিক আওয়ামী লীগের মধ্যে কোন ধরনের অসংগতি দেখলে সমালোচনা করতেন। তিনি শুধু কলম লেখক নন, তিনি একজন বড় মাপের সাহিত্যিকও ছিলেন। তিনি ৩৫টি বই লিখেছেন। তিনি গল্প, উপন্যাস, গান, নাটক, কবিতা ছড়া সব লিখেছেন। সাহিত্যের সব শাখা-প্রশাখায় ছিল তাঁর বিচরণ। জনাব আদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত আলোচিত বইয়ের মধ্যে ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ ‘রক্তাক্ত আগস্ট’ তিনটি গল্পগ্রন্থ কৃষ্ণপক্ষ (১৯৫৯), সর্ম্রাটের ছবি (১৯৫৯), সুন্দর হে সুন্দর। উপন্যাসগুলোর মধ্যে চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান, তিমির সঙ্গিনী, নীল যমুনা (১৯৬৪), নাম না জানা ভোর (১৯৬২), শেষ রজনীর চাঁদ (১৯৬৭), ডান পিটে শওকত (১৯৫৩) ইত্যাদি। জনাব আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী স্বাধীনতার পর স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য দেশ ছাড়তে হয়, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশের ফেরার পথ বন্ধ হয়ে যায়। প্রবাস জীবনে কষ্ট করে অর্থ উপার্জন করতে হয়। তিনি দিন যাপন করতে অনেক ধরনের কাজ করেন। কিংবদন্তি সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যুরতে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, ‘আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে বাংলাদেশের প্রগতিশীল, সৃজনশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একজন অগ্রপথিককে হারাল। তাঁর একুশের অমর সেই গান বাঙালি জাতিকে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তির আন্দোলনে অসীম সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছিল। তাঁর মৃত্যু দেশের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জন্য এক অপুরণীয় ক্ষতি। তিনি তাঁর কালজয়ী গান ও লেখনীর মাধ্যমে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে চির অম্লান হয়ে থাকবেন।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা, বাংলাদেশের সফল রাষ্ট্রনায়ক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশের ফেব্রুয়ারি’ গানের রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর মেধা-কর্ম ও লেখনীতে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখেছেন এবং বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মননকে ধারণ করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে সমর্থন করে জাতির সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’ পত্রিকায় তাঁর লেখনীর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। বিদেশে অবস্থানকালে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ নিয়ে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে লেখালেখি করেছেন।’ বীর কলমযোদ্ধা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বাংলাদেশ যেন তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত না হয় তা-ই তিনি চেয়েছেন। মৃত্যুপূর্বে তিনি বলে যান, ‘যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই, যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই।’ আমার দেখা কলম সৈনিকদের মধ্যে তিনিই সেরা, তিনিই উত্তম। তাঁর বিদায়ের শোক কাটাবার শক্তি আমাদের নেই। জীবনে দুইবার তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, কথা বলেছি-প্রাণিত হয়েছি। জানিনা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে এখন কে কলম ধরতে এগিয়ে আসবে? আল্লাহ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে বেহেস্তে ঠিকানা করে দিনÑআমিন।
লেখক : মো. আবদুর রহিম, সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতা স্মৃতি পরিষদ।
এসএ/