অ্যাসিডের বিষাক্ত ধোঁয়ায় বিপর্যস্ত চুয়াডাঙ্গার পরিবেশ


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


অ্যাসিডের বিষাক্ত ধোঁয়ায় বিপর্যস্ত চুয়াডাঙ্গার পরিবেশ

চুয়াডাঙ্গা শহরের প্রাণকেন্দ্রে বছরের পর বছর ধরে গড়ে উঠেছে গহনা তৈরির শতাধিক ছোট ছোট কারখানা। আর এসকল কারখানা থেকে নিঃসৃত অ্যাসিডের বিষাক্ত ধোঁয়া যেমন বাড়াচ্ছে স্বাস্থঝুঁকি, তেমনি বিষিয়ে তুলেছে আশেপাশের পরিবেশ। ৬-৭ ফুট আয়তনের এসব ছোটছোট কারখানায় ৭-৮ জন কারিগর গাদাগাদি করে অ্যাসিড নিয়ে কাজ করায় খোদ কারিগররাই রয়েছে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। জেলায় মাত্র পাঁচজনের বৈধ লাইসেন্স থাকলে ১০০ টির বেশি গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে এই কারখানাগুলো। অসচেতন কারখানার মালিকরাও তোয়াক্কা করছেন না অ্যাসিড ব্যবহারের বিধি-নিষেধ। অনিয়ন্ত্রিতভাবে অ্যাসিড ব্যবহারে কারখানাগুলো থেকে দিন রাত নির্গত হচ্ছে অ্যাসিডের বিষাক্ত ধোয়া। নাইট্রিক অ্যাসিড ও সালফিউরিক অ্যাসিড থেকে নিঃসৃত ধোঁয়া কারখানার স্বল্প উচ্চতার পাইপ দিয়ে বের হয়ে মিশে  যাচ্ছে বাতাসে, প্রবেশ করছে পথচারীসহ আশপাশের ভবন, ব্যাংক বীমা, অফিসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।

ঘুরে দেখা যায়, চুয়াডাঙ্গা শহরের নিউ মার্কেট এলাকা থেকে ভিক্টোরিয়া জুবিলি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে গহনা তৈরীর কারখানার। এ স্থানগুলো বলা হয় শহরের প্রাণ কেন্দ্র। এরমধ্যে রয়েছে সদর থানা, বড়বাজার, ব্যাংক, খাবার হোটেলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এতে চলাচলকারী প্রত্যেক পথচারীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ এই অ্যাসিডের বিষাক্ত ধোঁয়ার সাথে নিঃশ্বাস নিয়ে চলতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে শ্বাস কষ্ট, হৃদরোগ, চর্ম ও চক্ষুরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এই এলাকায় চলাচল ও বসবাস করা সকল শ্রেণী পেশার মানুষ।

স্থানীয়দের অভিযোগ অধিকাংশ কারখানারই নেই অ্যাসিড ব্যবহারের লাইসেন্স, নেই পরিবেশ ছাড়পত্রও। তারপরও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে হরহামেশা ব্যবহার হচ্ছে মানবদেহের জন্য চরম ক্ষতিকর এই অ্যাসিড।

চুয়াডাঙ্গা জেলার স্বর্ণপট্টি বলতে মুলত ভিক্টোরিয়া জুবিলি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে থেকে নিউ মার্কেট এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই এলাকার বিভিন্ন অলি-গলি, বাড়ির ছাদ, সিঁড়ির নিচে, টয়লেটের পাশে গাদাগাদি করে গড়ে উঠেছে ১শ’র বেশি গহনা তৈরীর কারখান। এসকল কারখানার মধ্যে মাত্র ৫ জনের অ্যাসিড ব্যবহারের লাইসেন্স আছে। চুয়াডাঙ্গাতে স্থানীয়ভাবে কোনো প্রতিষ্ঠান অ্যাসিড বিক্রি করে না। তবে শহরসহ আশেপাশের এলাকাতে ১৫ থেকে ২০ টি ব্যাটারী বিক্রির দোকান রয়েছে। 

দোকান মালিকরা বলছেন, ‌‘তারা খোলা অবস্থায় অ্যাসিড বিক্রি করেন না। ব্যাটারীতে যেভাবে থাকে, তারা সেভাবেই বিক্রি করেন। আর স্বর্ণ কারখানার মালিকরা বলছেন, তাদের অ্যাসিডের প্রয়োজন হলে যশোর থেকে সরবরাহ করা হয়। ফোন করলেই তারা আমাদের নিকট পৌঁছে দেন অ্যাসিড। তাতে কতটুক এসিড কে কিনলো, আর কতটুকু কে ব্যবহার করলো- তারও হিসেব নেই কারও কাছে।’

এদিকে এসকল কারখানায় কারিগর ও সহকারী মিলে প্রায় ৭ থেকে ৮শ’র অধিক কর্মী কাজ করছেন। এসকল কর্মীদের প্রত্যেকেরই বিষাক্ত অ্যাসিড নিয়ে কাজ করতে হয় প্রতিদিন। নাইট্রিক অ্যাসিড দিয়ে সোনা খাঁটি করার সময় যে ধোঁয়া বের হয়, তা বাতাসের সাথে মিশে অম্লীয় বাষ্পে রুপ নেয়। পরে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডযুক্ত ওই বাতাস শ্বাস- প্রশ্বাসের সঙ্গে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এতে করে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি,হৃদরোগসহ নানা রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। এনিয়েই কাজ করছেন এ সেক্টরের কর্মীরা।

কারিগররা বলছেন, ‘সোনার গহনা তৈরিতে মুলত দুই ধরনের অ্যাসিড ব্যবহার করা হয়। একটি নাইট্রিক অ্যাসিড অপরটি সালফিউরিক এসিড। নাইটিক অ্যাসিড সোনাকে পুড়িয়ে সোনার খাদ বের করা হয়। আর তৈরি গহনার সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা হয় সালফিউরিক অ্যাসিড।’

সরেজমিনে গহনা তৈরির কারখানাগুলোতে গেলে, সেখানে দেখা মেলে ১৬ বছরের কিশোর সেতু'র সাথে। সেতু প্লেটে সোনার পাত রেখে নাইটিক অ্যাসিড দিয়ে তা পুড়িয়ে সোনার খাদ বের করছে। ওই সময় প্লেট থেকে নাইট্রিক অ্যাসিডের রগরগে ধোঁয়ার কুন্ডলি বের হচ্ছিল। সেসময় তার মুখে ছিলোনা মাক্স, হাতে ছিলোনা গ্লাভস। সেদিকে সেতুর এতটুকু ভ্রুক্ষেপও নেই। সে শুধু জানে নাইট্রিক অ্যাসিড দিয়ে সোনার খাদ বের করত হয়। আর কিছু তার জানার প্রয়োজন নেই।

এক পর্যায়ে কথা হলো কিশোর সেতুর সাথে। গত তিন বছর ওই কারখানায় কাজ করে সে। নাইট্রিক অ্যাসিডের ধোয়াতে তার কি কি ক্ষতি হচ্ছে সে বিষয়ে কিছুই জানে না সে। সে বিষয়ে এত গভীরভাবে জানারও কথা না সেতুর। তার এখন লেখা পড়া খেলাধুলা করার কথা। অথচ সংসারে অভাব অনাটনের কারনে এই বয়সে এত কঠিন কাজের সামনে দাঁড়াতে হয়েছে তাকে। স্বর্ণপট্টির এরকম শত শত সেতু রয়েছে তাদের খবরও রাখে না কেউ।

এই অবস্থায় নাইট্রিক অ্যাসিডের ধোঁয়াতে কিশোর সেতুর কোন ক্ষতি হচ্ছে কিনা জানতে কারখানা মালিক মজনু মিয়ার সাফ জবাব, ‘অ্যাসিড ব্যবহারে জন্য তার লাইসেন্স আছে। কিশোর সেতুর কি হচ্ছে বা হবে এটা আমার জেনে কোন লাভ নেই ‘

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন কারখানার কারিগররা বলেন, ‘বিভিন্ন ধরণের অসুস্থ্যতার জন্য চিকিৎসকের কাছে গেলে বিষাক্ত অ্যাসিড নাড়া চাড়ার বিষয়ে বললে তখন চিকিৎসকরাও বিরক্ত হন। এমনকি এই কাজ থেকে সরে যাওয়ার জন্যও পরামর্শ দেন। এবং এই কাজে জড়িতদের সচেতন হয়ে কাজ করারও পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।’

চুয়াডাঙ্গা জুয়েলারি কারিগর সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘গহনা তৈরীতে অ্যাসিড ব্যবহারে শরীরে নানা রকম সমস্যা হয়। তারপরও জীবন ও জীবিকার তাগিদে তাদেরকে এই কঠিন কাজই করতে হচ্ছে। সদর উপজেলায় মাত্র ৫ জনের বৈধ ছাড়পত্র আছে।  সব কিছু ঠিক করে একটি কারখানা করতে গেলে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা খরচ হবে। তারপরও সাধারণ জনগণের কথা চিন্তা করে তিনি বলেন, এখনই সঠিক সময় কারখানাগুলো অনত্র সরিয়ে নেওয়ার।’

এ ব্যপারে চুয়াডাঙ্গা সরকারী কলেজের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘স্বর্ণের কারিগররা যে অ্যাসিড ব্যবহার করেন সেটাকে বলা হয় রাজ অম্ল। নাইট্রিক ও হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড ১:৩ এর মিশ্রণ। যা সোনা ও প্লাটিনামকে গলিয়ে দেয়, যা অন্য কোনো অ্যাসিড গলে না। তিনি আরও বলেন, যে অ্যাসিড সোনাকে গলিয়ে দেয় তার ধোঁয়া পরিবেশের চরম ক্ষতি করে, এর থেকে যে কালো ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় তার থেকে গাড় পদার্থ নির্গত হয়। অ্যাসিড বৃষ্টি হয়। শ্বাস- প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরের ভিতর প্রবেশ করলে শ্বাসযন্ত্রে ইনফেকশন হয়। শরীরের অভ্যন্তরে নরম যে অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলো আছে সেখানে আক্রমন করে।’

চুয়াডাঙ্গা জেলা জুয়েলারি মালিক সমিতির সভাপতি সাইফুল হাসান জোয়ার্দ্দার টোকন অ্যাসিডের ব্যবহার ও এর ক্ষতির বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে তারাও চিন্তিত। চুয়ডাঙ্গাতে স্বর্ণের কারখানাগুলোর পরিবেশগত বেশ কিছু সমস্যা আছে। আর এসকল সমস্যার কারণে এই সেক্টরসহ আশেপাশের পরিবেশেরও চরম ক্ষতি হচ্ছে। তিনি ঢাকার স্বর্ণের গহণা তৈরির কারখানাগুলোর উদহরণ দিয়ে বলেন, ঢাকাতে যেভাবে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশবান্ধব কারখানা গড়ে উঠেছে তাতে সেখানকার স্বর্ণকারীগররা সুস্থ্য স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারছেন। তিনি আরও বলেন, স্থানীয় প্রশাসন যদি স্বর্ণ তৈরীর কারখানাগুলো স্থানান্তরসহ নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে চান,  সে বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা জুয়েলারি সমিতি তাঁদেরকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করবে।’

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) এএসএম ফাতেহ আকরাম বলেন, ‘নাইট্রিক ও হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের ধোয়ায় শ্বাসকষ্টসহ চর্মরোগের অত্যান্ত ঝুকি রয়েছে। এমনকি মৃত্যুর ঝুকিও রয়েছে। অ্যাসিডের সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে, নাক-মুখে মাস্ক, হাতে গ্লোবস ব্যবহার করতে হবে। তাহলে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।’  

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম খান বলেন, ‘অ্যাসিডের ধোঁয়া মানবদেহের জন্য চরম ক্ষতিকর। স্বর্ণের কারখানাগুলোতে ব্যবহৃত অ্যাসিডের ধোঁয়া নির্গমনের জন্য যে পাইপ দেওয়ার কথা সেগুলো আছে কিনা দেখতে হবে। তাছাড়াও এই কারখানাগুলোতে শিশুশ্রমসহ বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে পরিদর্শন করে নিয়ম ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এসএ/