তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
তামাক জাতীয় দ্রব্যাদি বিশেষ উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে শ্বাসের সাথে তার ধোঁয়া শরীরে গ্রহণের প্রক্রিয়া হচ্ছে ধূমপান। তামাকের পাতায় নিকোটিন নামক একপ্রকার উপক্ষার থাকে। তামাকের ধূমপান মানুষকে কিছুটা আনন্দ দিলেও প্রকৃতপক্ষে নিকোটিন বিষাক্ত পদার্থ। তাই তামাকের ধোঁয়া মোটেও ভাল নয়। এর প্রভাবে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। তার মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসার অন্যতম। প্রতি বছর ৩১ মে তারিখে বিশ্বজুড়ে পালন করা হয় বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস । বিশ্বজুড়ে ২৪ ঘণ্টা সময়সীমা ধরে তামাক সেবনের সমস্ত প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকাতে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে দিবসটি প্রচলিত হয়েছে।
এছাড়াও দিবসটির উদ্দেশ্য তামাক ব্যবহারের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব এবং স্বাস্থ্যের উপর এর নেতিবাচক প্রভাবের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করানো যা বর্তমানে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিবেচিত এবং যার মধ্যে ধুমপানের পরোক্ষ ধোঁয়ার প্রভাবের কারণে প্রায় ছয় লক্ষ অ-ধূমপায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রসমূহ ১৯৮৭ সালে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস চালু করে। দিবসটি সরকার, জনস্বাস্থ্য সংগঠন, ধূমপায়ী, উৎপাদনকারী, এবং তামাক শিল্পের কাছ থেকে উদ্যম এবং প্রতিরোধ উভয়ের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে পালিত হয়ে আসছে।
তামাক গাছের আদি নিবাস উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায়। তামাক গাছের শুকানো পাতাকে তামাক বলা হয়। তামাক গাছ ১২-১৮ ইঞ্চি লম্বা হয়। তামাক অত্যন্ত নেশাদায়ক পদার্থ। তামাকে আগুন দিয়ে সিগারেট, বিড়ি, চুরুট, হুঁকা, ও অন্যান্য ধূমপানের মাধ্যম প্রস্তুত করা হয়। ধূমপান ছাড়াও তামাক নানা রকম ভাবে ব্যবহার হয়, যেমন চিবিয়ে জর্দা, যা পানের সাথে খাওয়া হয়, ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে যেমন গুল, বা নাকে ঠুসে যেমন নস্যি।
তামাকের মূল নেশাদায়ক উপাদান নিকোটিন এক প্রকারের স্নায়ুবিষ বা নিউরোটক্সিন, যা একধরনের অ্যাসিটাইলকোলিন রিসেপ্টরের উপর কাজ করে। কিন্তু তামাকের ধোঁয়াতে নিকোটিন ছাড়াও নানা ক্যান্সারপ্রদায়ী পদার্থ থাকে, যেমন বেঞ্জোপাইরিন ইত্যাদি বহুচক্রী আরোমাটিক যৌগ। তামাক অত্যন্ত বিষাক্ত পদার্থ। একখানি সিগারেটে যতখানি তামাক আছে তা চিবিয়ে খেলে পুরপুরি শরীরে যদি প্রবেশ করত, তা থেকে দ্রুত মৃত্যু অনিবার্য। তবে ধূমপানের ফলেও ধীরে ধীরে আয়ু কমে আসতে থাকে যা শুধু ক্যান্সারের প্রবণতার জন্যই নয়, হৃদরোগের জন্যেও বটে।
সাধারণ যেকোনো দ্রব্যের পোড়ানো ধোঁয়া শ্বাসের সাথে প্রবেশ করলে তাকে ধূমপান বলা গেলেও মূলত তামাকজাতীয় দ্রব্যাদির পোড়া ধোঁয়া গ্রহণকেই ধূমপান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিকগণসহ সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত যে, ধূমপান যক্ষ্মা, ফুসফুসের ক্যান্সার সহ নানা রোগের অন্যতম প্রধান কারণ এবং ধারক ও বাহক। গবেষণায় দেখা গেছে সিগারেটের ধূমপানে নিকোটিনসহ ৫৬টি বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ বিরাজমান। ২০১০ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিশ্বের ১৯২টি দেশে পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, নিজে ধূমপান না করলেও পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ছয় লক্ষ মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে এক লক্ষ পয়ষট্টি হাজার-ই হলো শিশু।
শিশুরা পরোক্ষ ধূমপানের কারণে নিউমোনিয়া ও অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ে। এছাড়া পরোক্ষ ধূমপানের কারণে হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার সহ শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগও দেখা দেয়। গবেষণায় আরও বেরিয়ে এসেছে যে, পরোক্ষ ধূমপান পুরুষের তুলনায় নারীর উপর বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বেশিরভাগ ধূমপায়ী কৈশোর বা প্রাথমিক বয়ঃসন্ধিকালে ধূমপান শুরু করে। যেহেতু কিশোর-কিশোরীরা প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় তাদের সমবয়সীদের দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়, তাই মানুষকে ধূমপানের চেষ্টা থেকে বিরত রাখার জন্য পিতামাতা, স্কুল এবং স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের প্রচেষ্টা সবসময় সফল হয় না।
ধূমপায়ীদের বর্ণনা করা দৈনন্দিন মেজাজের অবস্থা থেকে এটা নিশ্চিত করা হয়েছে যে, ধূমপানের সময় মেজাজ স্বাভাবিক থাকে এবং যখন ধূমপান করা হয়না তখন মেজাজ খারাপ খারাপ হয়ে যায়। ধূমপানে নির্ভরশীল ব্যক্তির স্বাভাবিক বোধের জন্য নিকোটিনের প্রয়োজন হয়। সিগারেটের ধোঁয়ায় ক্যান্সার সৃষ্টিকারী মিউটাজেন থাকে। এরা মানুষের মুখ, শ্বাসনালি, গ্রাসনালি এবং ফুসফুসে ক্যান্সার সৃষ্টি করে। ধূমপান থেকে শ্বাসনালিতে প্রদাহ এবং কাশির সৃষ্টি হয় যাকে ব্রংকাইটিস বলে। এতে শ্বাসনালি ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে হাঁপানি ও শ্বাসকষ্ট হয়। ফুসফস অনেকাংশে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। ধূমপানের ফলে শ্বাসনালিগুলোর বায়ুপথসমূহ সরু হয় এবং ফুসফুসে অতি স্ফীতি দেখা দেয়। ধূমপানের জন্য অনেকের প্রচন্ড কাশি এবং কাশির সাথে ফুসফুস থেকে মিউকাস বেরিয়ে আসতে দেখা যায়।
শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষা এবং কাউন্সেলিং তামাক ব্যবহারের ঝুঁকি কমাতে কার্যকর ভ’মিকা পালন করতে পারে। যেহেতু ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ৫৬তম সম্মেলনে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য Framework Convention on Tobacco Control (FCTC) নামীয় কনভেনশনে বাংলাদেশ ১৬ জুন, ২০০৩ তারিখে স্বাক্ষর এবং ১০ মে, ২০০৪ তারিখে অনুস্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ অনুযায়ী কোন ব্যক্তি কোন পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহণে ধূমপান করতে পারবেন না৷ কোন ব্যক্তি এই বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি অনধিক তিনশত টাকা অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং উক্ত ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ একই ধরণের অপরাধ সংঘটন করলে তিনি পর্যায়ক্রমিকভাবে উক্ত দন্ডের দ্বিগুণ হারে দন্ডনীয় হবেন।
কোন ব্যক্তি- (ক) প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়, বাংলাদেশে প্রকাশিত কোন বই, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, পোস্টার, ছাপানো কাগজ, বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ডে বা অন্য কোন ভাবে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করবেন না বা করাবেন না; (খ) তামাকজাত দ্রব্য ক্রয়ে প্রলুব্ধকরণের উদ্দেশ্যে কোন নমুনা বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে জনসাধারণকে প্রদান বা প্রদানের প্রস্তাব করবেন না বা করাবেন না; (গ) তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার বা ব্যবহার উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে কোন দান, পুরস্কার, বৃত্তি প্রদান, বা কোন অনুষ্ঠানের ব্যয়ভার বহন করবেন না বা করাবেন না; (ঘ) কোন প্রেক্ষাগৃহে, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বা ওয়েব পেইজে তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য সম্পর্কিত কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার করবেন না বা করাবেন না; (ঙ) বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত বা লভ্য ও প্রচারিত এবং বিদেশে প্রস্তুতকৃত কোন সিনেমা, নাটক বা প্রামাণ্য চিত্রে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের দৃশ্য টেলিভিশন, রেডিও, ইন্টারনেট, মঞ্চ অনুষ্ঠান বা অন্য কোন গণমাধ্যমে প্রচার, প্রদর্শন বা বর্ণনা করবেন না বা করাবেন না।
তবে, কোন সিনেমার কাহিনীর প্রয়োজনে অত্যাবশ্যক হলে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার দৃশ্য রয়েছে এরূপ কোন সিনেমা প্রদর্শনকালে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে লিখিত সতর্কবাণী বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে পর্দায় প্রদর্শনপূর্বক প্রদর্শন করা যাবে; (চ) তামাকজাত দ্রব্যের মোড়ক, প্যাকেট বা কৌটার অনুরূপ বা সাদৃশ্য অন্য কোন দ্রব্য বা পণ্যের মোড়ক, প্যাকেট বা কৌটার উৎপাদন, বিক্রয় বা বিতরণ করবেন না বা করাবেন না; (ছ) তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়স্থলে যে কোন উপায়ে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করবেন না বা করাবেন না।
কোন ব্যক্তি সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচীর অংশ হিসেবে সামাজিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করলে বা উক্ত কর্মকান্ড বাবদ ব্যয়িত অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে কোন তামাক বা তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, সাইন, ট্রেডমার্ক, প্রতীক ব্যবহার করবে না বা করাবে না অথবা ব্যবহারে অন্য কোন ব্যক্তিকে উৎসাহ প্রদান করবেন না। কোন ব্যক্তি এই ধারার বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি অনূর্ধ্ব তিন মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড বা অনধিক এক লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং উক্ত ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ একই ধরনের অপরাধ সংঘটন করলে তিনি পর্যায়ক্রমিকভাবে উক্ত দন্ডের দ্বিগুণ হারে দন্ডনীয় হবেন।
আমরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে তামাকের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ সহ প্রতিকার করতে পারি। যা শুরু হতে পারে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, পাড়া, মহল্লা, থানা, উপজেলা, জেলা, বিভাগ ক্রমান্নয়ে দেশ পর্যায়ে। যারা কর্তা ব্যক্তি প্রশাসনে আছেন সবার আগে তাদের আইন প্রয়োগের মাধ্যমে তামাক ব্যবহার বন্ধ করার জন্য কঠিন থেকে কঠিনতর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে হবে। বেসরকারী এনজিও, ইলেক্ট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়াকে ধুমপানের কুফল সম্পর্কে বিজ্ঞাপন, নাটক, সিনেমা, আর্টিকেল সহ এর তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের বিরুপ প্রভাব সম্পর্কে জনগণের কাছে সরাসরি প্রচার করতে হবে। শুধু তাই নয়, সকল প্রকার ধর্মীয় উপসানলয়ে দায়িত্বরত কর্তা ব্যক্তিরা এর কুফল সম্পর্কে প্রচার করলে ভাল ফল পাওয়া সম্ভব।
কলাম লেখক, মোঃ আরাফাত রহমান, সহকারি কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।
এসএ/