৫১তম বাজেট


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


৫১তম বাজেট

জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন শুরু হয়েছে। 

বৃহস্পতিবার (৯ জুন) বিকেল ৩টায় সংসদে বাজেট পেশ শুরু করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করছেন। শুরুতে কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ শুরু করেন। এ সময় স্পিকার বলেন, ‘মাননীয় মন্ত্রী, আপনি চাইলে বসে বসে বাজেট পেশ করতে পারেন।’

মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ

নতুন অর্থবছরের বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সাময়িক প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। 

গত ১৩ এপ্রিল বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে চলতি অর্থবছরে (২০২১-২২) জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে বলে আভাস দেয়া হয়েছিল।

এ ছাড়া সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের ৬ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ৭ দশমিক ১ শতাংশ হতে পারে।

গত ১৩ বছরে জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৬ শতাংশ, যা ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ শতাংশের ওপরে ছিল এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ শতাংশ অতিক্রম করে।

গড় মূল্যস্ফীতি ৫.৬% রাখার লক্ষ্য

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে গড় মূল্যস্ফীতি ৫.৬% রাখার লক্ষ্য ঠিক করে নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এই সূচককে ৫ দশমিক ৩ শতাংশে বেঁধে ঘোষণা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী।

তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, কয়েক মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি বেশ বেড়েছে। সরকারি হিসাবে এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি এর হার আরও বেশি।

গত ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত টানা তিন মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের ওপরে আছে। গত পাঁচ-ছয় বছরে এমন দেখা যায়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ গত এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। এটি গত দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ হয়েছিল।

স্বাস্থ্য খাতে ৪ হাজার ১৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ল

২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য সরকারের বরাদ্দ বেড়েছে চার হাজার ১৩২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। যা এবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকায়।

অর্থমন্ত্রী বলেন, “কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গৃহীত কার্যক্রমসহ কোভিড-পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক উন্নয়নের বিষয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতে আগামী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জন্য ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা প্রস্তাব করছি যা গত  অর্থবছরে ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা ছিল।”

তিনি বলেন, “জনস্বাস্থ্য ও জনজীবনের ওপর ‘কোভিড-১৯’ অতিমারির প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন অব্যাহত রাখা, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন, স্বাস্থ্যসেবা খাতের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও অর্থায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ, যথাসময়ে কোভিড ভ্যাকসিন ক্রয় এবং পর্যায়ক্রমে তা জনসাধারণের মধ্যে প্রয়োগ করার মতো অতি জরুরি পদক্ষেপ আমরা যথাসময়ে গ্রহণ করেছি। ফলে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রেখে মৃত্যুর হার অন্যান্য দেশের তুলনায় বহুলাংশে হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে।”

‘পাশাপাশি, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতের কার্যক্রমে অগ্রাধিকার প্রদান করার ফলে জনজীবন সুরক্ষিত রেখে জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে সরকার।’

মুস্তফা কামাল বলেন, “অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ছয়টি মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের উন্নয়ন পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘মানবস্বাস্থ্য, আত্মবিশ্বাস, কর্মসংস্থান, আয় ও অর্থনৈতিক অবস্থা স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনতে কোভিড-১৯ থেকে দ্রুত পুনরুদ্ধার’। বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়ে জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে জনগণের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা, অর্থনৈতিক অবস্থা স্বাভাবিক রেখে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সরকার নিরন্তর বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।”

‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’ স্লোগান নিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে জাতীয় সংসদে। নতুন এ বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এতে মূল্যস্ফীতি ধরা হচ্ছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।

দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ বৈধ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে নতুন বাজেটে

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেন, “কর দিয়ে এসব অর্থ বৈধ হয়ে গেলে এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না আয়কর কর্তৃপক্ষসহ যেকোনো কর্তৃপক্ষ।” 

তিনি বলেন, “বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। এ অবস্থায় আগামী অর্থবছরে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হতে পারে।” 

“এমতাবস্থায়, আর্থিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অধিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শী পন্থা অবলম্বন করতে হবে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য একদিকে আমাদের অধিক পরিমাণে রাজস্ব জোগান দিতে হবে, অন্য দিকে বেসরকারি খাতেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনতে হবে।”

এ অবস্থায় বিদেশে অর্জিত অর্থ ও সম্পদ অর্থনীতির মূল স্রোতে আনার মাধ্যমে বিনিয়োগ ও আর্থিক প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিনি আয়কর অধ্যাদেশে নতুন বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব দেন।

নতুন বিধানের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, “প্রস্তাবিত বিধান অনুযায়ী বিদেশে অবস্থিত যে কোনো সম্পদের ওপর কর পরিশোধ করা হলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ যে কোনো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করবে না। বিদেশে অর্জিত স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনা না হলে এর ওপর ১৫ শতাংশ, বিদেশে থাকা অস্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনা না হলে ১০ শতাংশ ও বাংলাদেশে পাঠানো (রেমিটকৃত) নগদ অর্থের ওপর ৭ শতাংশ হারে করারোপের প্রস্তাব করেন তিনি। এ সুবিধা ২০২২ সালের ১ জুলাই হতে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।”

শিক্ষায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বৃদ্ধি

নতুন অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট জাতীয় সংসদের সামনে উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আসন্ন অর্থবছরে (২০২২–২৩) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন শিক্ষাখাতে টাকার অংকে মোট বরাদ্দ বাড়ছে। চলতি অর্থ বছরের তুলনায় আসন্ন অর্থ বছরে মোট ৯ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।

এই দুই মন্ত্রণালয়ের জন্য আসন্ন অর্থ বছরে মোট ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা চলতি বছরের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ৭১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা।

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল শিক্ষাখাতে বরাদ্দের এই তথ্য উল্লেখ করেন।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য এবার ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা চলতি অর্থ বছরের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ২৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা এ বছরের জন্য করা হয়েছিল ৩৬ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা চলতি অর্থ বছরে বরাদ্দ করা হয়েছিল ৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা।

সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমছে না

আসছে অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুদহার অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, ‌‌‍“স্বল্প-আয়ের লক্ষ্যভিত্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য উচ্চ সুদ হারের সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের ব্যবস্থা রাখা হলেও অনেক উচ্চ-আয়ের বিনিয়োগকারীরা এ স্কিমগুলোর সুবিধা নিচ্ছিল বেশি। সে কারণে আমরা ইতোপূর্বে বিক্রয় ব্যবস্থাপনা অটোমেশন করেছিলাম। যার ফলে নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের ক্ষমতা সীমিত হয়েছে। এছাড়াও, সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ও টিআইএন নম্বর দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল।”