কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলগুলোর উন্নয়নে বড় বাঁধা যোগাযোগের জনদুর্ভোগ


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলগুলোর উন্নয়নে বড় বাঁধা যোগাযোগের জনদুর্ভোগ

বাদলা দিনে ‌কাঁদা আর শুষ্ক মৌসুমে ধূলাবালির খেলা। এ দুইয়ে মিলে তাদের জীবন বিপর্যস্ত। যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না থাকলে কোনোদিক থেকে উন্নতি ধরা দেয় না।

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার ধরলা নদীর জেগে ওঠা বিশাল চর এলাকা। সেখানে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট দুই জেলার ৪ টি ইউনিয়নের ৭/৮ টি গ্রাম রয়েছে। সেখানে প্রায় ৪/৫ হাজার মানুষের বসবাস। যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকায় মুখ থুবড়ে পড়ে যায় তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন। 

ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাংগা ইউনিয়নের চর গোরকমন্ডল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি রাস্তাই অনেক ভাঙ্গাচোরা। কোথাও কোথাও অনেক বড় বড় গর্ত পড়ে গেছে। যাত্রীবাহী কোন যান ঐসব এলাকার ভাড়ার নাম শুনলেই আঁতকে উঠে। এজন্য যাতায়াত ব্যবস্থা নাই বললেই চলে। সব মিলিয়ে বলা যায়, প্রত্যন্ত চরাঞ্চল বাসীর যেন এক দূর্বিষহ জীবন যাপন। 

আনন্দবাজার থেকে ইন্তুর ঘাটের রাস্তাটি একদম চলাচলের অনুপযোগী। রাস্তাঘাটের এতটাই বেহাল অবস্থা যে, পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাই এখন আর কোনো প্রকার যান চলাচল করে না। অথচ ওই রাস্তাটি দিয়েই তাদের আসতে হয়‌ ইউনিয়ন পরিষদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ হাট-বাজার। প্রায় ২/৩ হাজার মানুষের অতি প্রয়োজনীয় একটি রাস্তা এটি।

চর এলাকা গুলোতে কোনো বাড়িতে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যেতে পারবে না। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেও দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার কোনো উপায় নেই। এক কথায় অসুস্থ রোগীকে কাঁধে করে আনন্দবাজারে নিয়ে এসে তারপর গাড়িতে তুলতে হবে। এছাড়াও প্রতিটি ক্ষেত্রে পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ। পথঘাট ভালো না থাকায় এখানকার উৎপাদিত ফসল ধান,গম, পাট, ভুট্টা, সরিষা ইত্যাদি বিক্রি করতে লোকসান গুনতে হয়। পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীরাও এ এলাকাগুলো থেকে কিছু কিনতে চায় না। বাধ্য হয়ে কম দামেই বিক্রি করে। এভাবে ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। 

সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয় চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের। সেখানে কোনো মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় নির্ভর করতে হয় পশ্চিম ফুলমতি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, নাওডাংগা ডিএস দাখিল মাদ্রাসা, নাওডাংগা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, বালারহাট আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ এই প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর। আর এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসতে হলে এই রাস্তাটিই ব্যবহার করতে হবে। বিকল্প অন্য রাস্তা ব্যবহার করলে দুই গুণ দুরত্ব বৃদ্ধি পায়। 

সহজ রাস্তা চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ায় তারা প্রতিনিয়ত কষ্ট করে ডাবল দুরত্ব ঘুরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া আসা করে। এই দুর্ভোগের ফলে প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনেক বেশি। প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে নেমে পড়ে মাঠের কাজে। মেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। কোনোরকমে প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করলেই বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। কোমল বয়সেই কাঁধে চেপে বসে সংসারের বোঝা। তাই সরকারের কাছে চরাঞ্চলের পথঘাট চলাচলের উপযোগী করে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করে দেয়ার আকুল আবেদন জানান চরাঞ্চলের বাসিন্দারা।

ওই এলাকার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নূরনবী ও দশম শ্রেণির শামীম আহমেদ। তারা দুজনই নাওডাংগা ডিএস দাখিল মাদ্রাসায় পড়ে। তারা জানালেন তাদের কষ্টের কথা। তারা বাইসাইকেল চড়ে মাদ্রাসায় যাওয়া আসা করে। তাদের বাড়ি থেকে মদ্রাসার দুরত্ব মাত্র ৪ কিলোমিটার হলেও রাস্তা খারাপ হওয়ার কারণে ৮/১০ কিলোমিটার ঘুরে যেতে হয়। তাও বাড়ি থেকে বের হয়ে বালুর কারনে আড়াই তিনশো গজ পায়ে হেঁটে যেতে হয়। এর ফলে মাঝেমধ্যে সঠিক সময়ে মাদ্রাসায় পৌঁছাতে পারে না। খুব কষ্ট করে স্কুল কলেজ যেতে হয় জন্য অনেকে পড়ালেখা ছেড়ে কাজে নেমেছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকার আমাদের চরাঞ্চলের রাস্তাগুলো চলাচল যোগ্য করে দিলে আমাদের অনেক কষ্ট লাঘব হবে।

স্থানীয় শফিকুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম, সুরুজ্জামাল হক, ময়ছারা বেওয়া, রেজিয়া বেগম, হনুফা বেগম সহ আরো অনেকে বলেন, ‍“আমাদের এই চরাঞ্চল বাসীর কষ্টের শেষ নেই। এখানকার মানুষজন মাঠে অনেক পরিশ্রম করে। আমরা যতই পরিশ্রম করি না কেন, রাস্তার কারনে লোকসান গুনতে হয়। ফসল বাড়িতে বা বাজারে নেয়া অনেক কষ্টের। নিলেও অনেক খরচ হয়ে যায়। এই যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপের কারনে আমাদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয় না। এমনকি আমাদের ছেলে মেয়েকে বিয়ে দিতে গেলেও বড় সমস্যায়‌ পড়তে হয়। রাস্তাঘাট ভালো না হওয়ায় কেউ আত্নীয়তাও করতে চায় না। আমাদের রাস্তা ভালো হলে তবে আমরা সবদিক থেকে চাঙ্গা হয়ে উঠবো। ”

ওই এলাকার রাস্তাঘাটের উন্নয়নের বিষয়ে জানতে চাইলে নাওডাংগা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাছেন আলী বলেন, “আমি এবারে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার মাত্র অল্প কিছুদিন হলো। চরাঞ্চলের রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থার বিষয়ে আমি অবগত আছি। ভোটের সময় আমাকেও এই দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। চল্লিশ দিনের কর্মসৃজনের মাধ্যমে কিছু রাস্তা সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। আনন্দবাজার থেকে ইন্তুর ঘাটের রাস্তাটি বালু মাটির কারনে চলাচলের একদম অনুপযোগী। বিশেষ কোনো বরাদ্দ বা সবকারি টেন্ডার ছাড়া এই রাস্তার কাজ সম্ভব না। কনক্রিট বা জিও ব্যাগের বাঁধ দিয়ে কয়েক স্থানে ভাঙন রোধ করে পাকা সড়ক নির্মাণ করলে তবে রাস্তাটি চলাচলযোগ্য হবে। এই রাস্তাটির কাজ হলে চরাঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষের কষ্ট লাঘব হবে। চরাঞ্চলের রাস্তাঘাটের উন্নয়নের জন্য যথাযথ মাধ্যমে সরকারের কাছে আমরা আবেদন জানাবো। আমার বিশ্বাস, সরকার আমাদের এই চরাঞ্চল বাসীর দিকে সুদৃষ্টি দিবেন।”

তিনি আরো বলেন, “এই চরাঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত। আশাকরি আমি যতদিন চেয়ারম্যান আছি, একটা নজর সবসম চরাঞ্চলের মানুষের প্রতি থাকবে। এই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নাওডাংগা ইউনিয়নকে ঘুষ মুক্ত, হয়রানি মুক্ত, উন্নয়ন বান্ধব একটি মডেল ইউনিয়ন হিসেবে উপহার দেয়ার অঙ্গীকার করেছি। আমি জনগণকে ওয়াদা দিয়েছি, জনগণের কল্যাণে কাজ করেই যাবো।”

এসএ/