বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ: রোজগার্ডেন থেকে গণভবন
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
স্বাধীন, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক এবং উন্নয়নশীল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে যে দলটি সামনে থেকে এককভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে, দলটির নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজগার্ডেনে পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রগতিশীল নেতারা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামের একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলেন, যা সে সময় পাকিস্তানের প্রধান বিরোধীদল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দলটির প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক এবং তরুণ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাবন্দি অবস্থায় যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সাল ১৯৫৭। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তৎকালীন পূর্ব বাংলার অন্যতম নেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর পদত্যাগ। আওয়ামী লীগে ভাঙ্গনের শুরু হয়। তিনি পদত্যাগের পর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
এরপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একদল তরুণ কর্মী নিয়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরে এবং পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের অন্যায় অপশাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেন। তারপরই বঙ্গবন্ধু বাংলার অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৪-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ, ৬৬-এর ছয় দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় এবং সর্বোপরি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। কারাবন্দি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
মাত্র চার বছরের ব্যবধানে ১৯৫৩ সালে দ্বিতীয় কাউন্সিলেই ঢাকার মুকুল প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। সে সময় থেকে একটানা ১৩ বছর সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিব।
শুরু থেকেই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ‘মুসলিম' শব্দটি নিয়ে প্রবল মতবিরোধ ছিল। ভূখণ্ডের চিরায়িত সম্প্রীতির বন্ধন ও অসাম্প্রদায়িক নীতিকে ধারণ করে ও তা পুরোপুরি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৫ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে আওয়ামী মুসলিম লীগের ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নাম চূড়ান্তভাবে ‘আওয়ামী লীগ রাখা হয়। এভাবে দলটি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষর প্রাণের সংগঠনে পরিণত হয়। আর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই পরিচিতি পায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নামে। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের যাত্রাই শুরু হয় বাঙালির স্বার্থের সত্যিকার ও আপসহীন প্রতিনিধি হিসেবে।
এর আগে মুসলিম লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে কয়েকটি দল মিলে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট, যার নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৩টিই পায় এই জোট। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ এককভাবে পেয়েছিল ১৪৩টি আসন।
যুক্তফ্রন্টে ছিল কৃষক শ্রমিক পার্টি (শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক), পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খিলাফত দল। সাথে আরো ছিল মৌলানা আতাহার আলীর নেজামে ইসলাম পার্টি। বামপন্থী গণতন্ত্রী দলর নেতা ছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ এবং মাহমুদ আলি সিলেটি।
স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। মাত্র সাড়ে তিন বছরে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে যখন অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখন স্বাধীনতাবিরোধী ষড়ডন্ত্রকারীরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে।দেশের বাইরে থাকায় সে সময় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কণ্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে আওয়ামী লীগ দিশেহারা হয়ে পড়ে। দলে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়। একাধিক উপদলে বিভক্ত হয় দল।
ছয় বছর পর দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়ে দেশে ফিরে আসেন। তখন থেকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সামরিক শাসকবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় আওয়ামী লীগ।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে লড়াই-সংগ্রাম করে দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। পাঁচ বছর দেশ পরিচালনার পর ২০০১ সালের নির্বাচনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। এরপর আবার ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি-জামায়াত জোটের শত প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং তৃতীয় বারের মত প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। সর্বশেষ, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মত প্রধানমন্ত্রী হন।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে দলটি অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণের লড়াই-সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিটি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে এদেশের গণমানুষের দলে পরিণত হয়েছে আওয়ামী লীগ।
আজ ২৩ জুন গৌরবের ৭৩ বছরে পা দিয়েছে দলটি। জন্মদিনে শুভেচ্ছা উপমহাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে।
লেখক
এসএ পলাশ
সভাপতি
যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ছাত্রলীগ।